somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশী বন্ধুদের তিনটি অজানা গল্প শুনুন

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের প্রতি সংহতি আন্দোলনের মোটা দাগের পরিচয় হয়তো আমরা জানি, তবে তারও পরতে পরতে মিশে আছে আরও অনেক ছোট-বড় ঘটনা; তাৎপর্যে যা মোটেই ছোট নয়। এমনই তিনটি গল্প নিয়ে এ আয়োজন।

১.ভারতের বুট- পালিশ বালকদের একদিনের উপার্জন বাংলার মানুষের জন্য

(ছবিটি সামু ব্লগার এ. এস. এম. রাহাত খান এর সৌজন্যে)

আজকের মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি রেলস্টেশন, সেদিনের বোম্বের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাল বা ভিটি রেলস্টেশনের সামনে, একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে স্টেশনের খেটে খাওয়া বুট পালিশ বালকের দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের এক দিনের রোজগার তুলে দেবে মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ-সহায়ক সমিতির হাতে। তারা সবাই মিলে তুলেছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। বোম্বাইয়ের বিশিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্রের প্রধান নির্বাহী সকালে জুতা পালিশ করিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন অর্থ সংগ্রহ অভিযানের। বুট পালিশ বালকদের এই পরম ভালোবাসার অর্ঘ্যদানের বার্তা শুনে বিশেষ আলোড়িত হয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন গভর্নর আলী ইয়ার জং। হায়দরাবাদের নিজাম-পরিবারের এই সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ-আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল, ভারতের অবাঙালি মুসলিমদের মধ্যে যা এক ব্যতিক্রম। এক বিকেলে তিনি বুট পালিশ বালকদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মালাবার হিলের শ্বেতপ্রাসাদে, গভর্নরের ভবনে।

২.লিভারপুলের লি ব্রেনান ও তাঁর সঙ্গীরা
নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’, লন্ডনের ‘কনসার্ট ইন টিয়ার্স’, বোম্বের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘স্ট্রিংস্ অ্যান্ড ফায়ার কনসার্ট’ ইত্যাদি বড় মাপের আয়োজনের কথা জানা হলেও প্রায় অজ্ঞাত রয়ে গেছেন লিভারপুলের লি ব্রেনান ও তাঁর সঙ্গীরা। বাংলাদেশের সংগ্রামী বার্তা পেয়ে বিচলিত এই তরুণ লিখেছিলেন দুটি গান, বন্ধুদের নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছোট এক স্টুডিও থেকে এই গানের ৪৮ আরপিএমের রেকর্ডও বের করেছিলেন। মামুলি একরঙা মোড়কে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাণীসংবলিত করে দীনহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছিল রেকর্ড। একটি গানের কথা ছিল, ‘ইন দ্য নেম অব হিউম্যানিটি/ ডোন্ট অ্যালাউ বাংলাদেশ টু ফাইট অ্যালোন।’ কথা ও সুর যে খুব উঁচুমানের, তা হয়তো বলা যাবে না; কিন্তু অনুভব করা যায় প্রাণের আবেগ। লি ব্রেনান ঝোলায় রেকর্ড নিয়ে গিটার বাজিয়ে এই গান গেয়ে বেড়াতেন শহরের এক পানশালা থেকে আরেক পানশালায়, রেকর্ড বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতেন বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি নিশ্চয়ই হয়েছিলেন আমাদের মতোই উল্লসিত, তারপর কোথায় হারিয়ে গেছেন এই যুবক, তাঁর গানের একটি ছোট্ট রেকর্ড কেবল রয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

৩.এবং একজন জঁ ইউজিন পল কে
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বহু ধরনের মানুষ বিচিত্র ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাঁদের একজন ছিলেন জঁ ইউজিন পল কে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এই ফরাসি লেখক জীবনে বিবিধ অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়েছিলেন, চিন্তা-চেতনার দিক দিয়েও ছিলেন বিচিত্রমুখী। গোড়াতে তিনি ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর সদস্য, তারপর সেনাবাহিনী ত্যাগ করে যোগ দেন কুখ্যাত ওএএসে; যে গোপন বাহিনী মনে করত আলজেরিয়া হচ্ছে ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা কখনো হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। আঁদ্রে মালরোর রচনা পড়ে বোধোদয় হয় পল কের। তিনি ওএএস ত্যাগ করে হয়ে ওঠেন বিশ্বপথিক। তবে পুরোনো মতাদর্শের জের একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারেন না। স্পেন, লিবিয়া ও বায়াফ্রায় বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিড়ে যান।
একাত্তর সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের বার্তা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। এরপর আঁদ্রে মালরো যখন বাংলাদেশের পক্ষে লড়বার ব্রত ঘোষণা করেন, তখন গুরুবাক্যে বিশেষ অনুপ্রাণিত বোধ করেন পল কে। ৩ ডিসেম্বর তিনি প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে ব্যাগে বোমা নিয়ে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৭১১ বিমানটি দখল করতে সমর্থ হন। তাঁর ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসা বৈদ্যুতিক তার জানান দিয়েছিল ভেতরে বহন করা বোমার। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য জরুরি ওষুধ বহন করে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর ওষুধের কার্টন বোঝাই করবার অজুহাতে পুলিশ বিমানে ঢুকে তাঁকে পরাভূত করতে সমর্থ হয়। ব্যাগ খুলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে কতক বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার।
এই ঘটনার পরপরই উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল সর্বাত্মক যুদ্ধ। সেই ডামাডোলে হারিয়ে গেল পল কে-র ঘটনা। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলা চলেছিল বেশ কিছুকাল। আদালতে অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আঁদ্রে মালরো স্বয়ং। অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়া পল কে আবারও ঘুরে ফিরেছেন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে। ১৯৮১ সালে তাঁকে দেখা গিয়েছিল হিমালয় এলাকায় তপস্যারত, এরপর কিছুকাল ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়, পরে আবারও তাঁকে দেখা গেল কলকাতায়, সেখানে জননিরাপত্তা ভঙ্গের অভিযোগে কিছুদিন কাটান কারাগারে। ভারত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ১৯৮৫ সালে তিনি যান ওয়েস্ট ইন্ডিজে। এরপর তাঁর আর খোঁজ মেলেনি।

সূত্র:
(৮ ডিসেম্বর ২০১০ প্রথম আলো পত্রিকায় জনাব মফিদুল হকের (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি) কলামে খোঁজ পেলাম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা ভিনদেশী মমতাময় কিছু মানুষের । তাঁর বিশাল কলাম থেকে শুধু তিনটি ঘটনা প্রয়োজনীয় সম্পাদনা শেষে তুলে ধরলাম ব্লগারদের জন্য-)
মূল কলামটি পড়তে এখানে ক্লিকান

মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশি মানুষের অবদান নিয়ে আমার সীমিত জ্ঞান আর পড়াশোনায় যেসব তথ্য জেনেছিলাম তা নিয়ে একটি পোস্ট পড়তে চাইলে ক্লিকান তাঁদের জন্য ভালোবাসা
ব্লগার সন্দীপন বসু মুন্না মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশী মানুষদের অবদান নিয়ে ৫ পর্বের একটি অসাধারন সিরিজ লিখেছেন। পোস্টটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিকান।

সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:৫০
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×