somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চার্লি চ্যাপলিন: শুধুই কমেডিয়ান নন, অসামান্য এক বোদ্ধা

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাদাসিধা ভবঘুরে একটা মানুষ, যার পরনে নোংরা ঢিলেঢালা প্যান্ট, শরীরে জড়ানো জীর্ণ কালো কোট, পায়ে মাপহীন জুতো, মাথায় কালো মতো হ্যাট আর হাতে লাঠি। যে ব্যাপারটি কারও চোখ এড়ায় না তা হচ্ছে লোকটার কিম্ভুত আকৃতির গোঁফ। লোকটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে আর ঘটাচ্ছে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। আর এসব দেখেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে বিশ্বের কোটি মানুষ। বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ স্যার চার্লস স্পেন্সর চ্যাপলিন। দ্য ট্রাম্প বা ভবঘুরে চরিত্রটি দিয়ে যিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। চলচ্চিত্র খুঁজে পেয়েছিলো সর্বকালের সেরা শোম্যানকে। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে মানুষকে হাসানোর মত দূরহ কাজটি শুধুমাত্র অঙ্গভঙ্গি দিয়ে যিনি করতেন অত্যন্ত সফলভাবে।

চার্লি মানে ব্যঙ্গ, চার্লি মানে হাসি। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দেখে দর্শক হাসতেই হাসতেই খুঁজে পাবে প্রতিটি মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণার উপস্থিতি। অট্টহাসির মাঝেই ধরা দেবে রূঢ় বাস্তবতা। হাসিতে হাসিতে দর্শকের পেটে খিল ধরতে না ধরতেই সামনে এসে উপস্থিত হবে যুদ্ধের উন্মত্ততা আর নিষ্ঠুরতা। তার মানে, চার্লি আসলে দর্শকদের সামনে আসতেন আনন্দ আর কষ্টগুলো ভাগাভাগি করতে। তখন তিনি কোনো চলচ্চিত্রকার নন, নন শুধু চিত্তবিনোদনকারী; চার্লি তখন দর্শকের বিবেক, তাদের সুখ-দুঃখের সাথী। তাই তিনি বলতেন, 'জীবনটা ক্লোজআপ শটে ট্র্যাজেডি; কিন্তু লং শটে কমেডি।'

হাস্যরসের মধ্য দিয়ে চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে উঠে এসেছিল সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারসহ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই স্যার চ্যাপলিন কোনো না কোনো বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি সেটা করেছিলেন তাঁর চিরচেনা দ্য ট্রাম্প স্টাইলে। বিশেষ করে বিভিন্ন ছবিতে তার রাজনৈতিক জ্ঞানের যে পরিস্ফুটন দেখা যেত তা ছিল সত্যিই অসাধারণ।
ট্রাম্প বা ভবঘুরে চরিত্রটি প্রথমবারের মতো পর্দায় আসে 'কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস' [১৯১৪] চলচ্চিত্রটি দিয়ে। এরপর একে একে তৈরি করেন 'শোল্ডার আর্মস' [১৯১৮], 'দ্য কিড' [১৯২১], 'দ্য সার্কাস' [১৯২৮], 'সিটি লাইটস' [১৯৩১], 'মডার্ন টাইমস' [১৯৩৬] প্রভৃতি কালজয়ী চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে তার ভূমিকা থাকত বহুমুখী। তিনি চলচ্চিত্রে প্রযোজনা, পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা, অভিনয়, নাচ, গান সবই করতেন।

দি সার্কাস ছবির একটি দৃশ্য

দি কিড চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্য

সিটি লাইটস চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্য

দিকে দিকে যখন চ্যাপলিনের জয়ধ্বনি, ঠিক এরকম সময়ই চলচ্চিত্র জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে সবাক চলচ্চিত্র বা টকির। চ্যাপলিন তখনও স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে চলছেন। তৈরি করছেন একের পর এক নির্বাক চলচ্চিত্র, যা রীতিমতো বক্স অফিস কাঁপাচ্ছে। টকি তার কাছে পাত্তাই পাচ্ছে না; কিন্তু মানুষ সবাক চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত হয়ে গেল। চ্যাপলিনও বুঝলেন পরিবর্তন আনতেই হবে। তাই টকির জন্মের ১৩ বছর পর চ্যাপলিন তাঁর প্রথম সবাক চলচ্চিত্র বানালেন_ 'দ্য গ্রেট ডিক্টেটর' [১৯৪০] এবং যথারীতি সৃষ্টি করল ইতিহাস।

দি গ্রেট ডিক্টেটর ছবির একটি দৃশ্য

তার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র 'দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে' তিনি অ্যাডলফ হিটলার ও ফ্যাসিবাদ নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করে চরম সাহসিকতার পরিচয় দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে মুক্তি পাওয়া এ চলচ্চিত্রটিতে নাজি বাহিনী কর্তৃক এক ইহুদি নাপিতের হেনস্থা হওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। চ্যাপলিন চলচ্চিত্রটিতে ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর ও ইহুদি নাপিতের দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেন। ডিক্টেটর চরিত্রটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিটলারের আদলে সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর হিটলারের সঙ্গে চ্যাপলিনের দৈহিক সাদৃশ্য ছিল। মজার বিষয়, হিটলার ছিলেন চ্যাপলিনের ভক্ত। শোনা যায়, তিনি নিজে এ ছবিটি দু'বার দেখেন এবং তার ব্যক্তিগত থিয়েটার রেকর্ডে রাখেন।

চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি দু'বার অস্কারে ভূষিত হন। ১৯২৯ সালে তিনি 'দ্য সার্কাস' ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও নির্দেশকের জন্য মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হননি; কিন্তু জুরি বোর্ড নির্দেশনা, প্রযোজনা, অভিনয় ও চিত্রনাট্য রচনা, সর্বোপরি বহুমুখী অবদানের জন্য তাকে বিশেষ সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭২ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো অস্কার সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে লাভ করেন নাইট উপাধি।

মর্ডান টাইমস ছবির একটি দৃশ্য

১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালওয়ার্থে জন্ম নেওয়া এ মহাতারকা ১৯৭৭ সালের বড়দিনে মারা যান। চ্যাপলিনের সর্বশেষ ছবি ছিল 'এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং' (১৯৬৭)। তাঁর মৃত্যুর পর আরেক অস্কারজয়ী নির্মাতা স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবোরো চ্যাপলিনের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করেন 'চ্যাপলিন' (১৯৯২)। চলচ্চিত্রটিতে তিনি স্যার চ্যাপলিনকে কমেডিয়ানের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন একজন দূরদর্শী নির্মাতা ও রাজনীতি বোদ্ধা হিসেবে যিনি হাসির খোরাক জোগানোর পাশাপাশি সবাইকে জানান দিয়ে গেছেন, বিশ্ব আজ ধ্বংসপুরী, লঙ্ঘিত মানবতা। তাই যুদ্ধটা হওয়া উচিত সুন্দর এক পৃথিবীর জন্য। যেখানে মানুষে মানুষে যুদ্ধ হবে না, থাকবে না কোনো হানাহানি।#

(২২ ডিসেম্বর ২০১১ দৈনিক সমকালের সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা নন্দনে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৫৭
৪২টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×