গাছ পাখি আর মানুষ মারা যায়। একই ভাবে নদীও যে মারা যেতে পারে তা প্রথম জেনেছিলাম দাপ্তরিক ভ্রমণে দক্ষিনাঞ্চলে গিয়ে।আমি যে দপ্তরে কাজ করতাম সেখানের একটি কর্মসূচীতে আমার একদিন শুধুই দক্ষিণাঞ্চলের অনেকগুলো নদী দেখবার কথা ছিল। ঠিক করলাম প্রতি নদীর তীরে কিছুক্ষণ করে বসে নদীতীরের দৃশ্য দেখব। তো নদী দেখার যাত্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেঠোপথ পেরিয়ে এক জায়গায় জিপ থামল। দেখি আদিগন্ত ধানক্ষেতের মধ্যে এক নালা।
-নদী কই?
-এটাই নদী, এখন মরে গেছে।
নদীর মৃত্যু আর গাছ, পাখি কিংবা মানুষের মৃত্যু এক না। গাছ, পাখি কিংবা মানুষ বংশধর সৃষ্টি করে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু একটি নদী, যা সৃষ্টি হতে লাগে কয়েকশ বছর তাকে এক বছরের মধ্যেই মেরে ফেলা যায়- কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মানুষ একটিও নদী সৃষ্টি করতে পারে না। তবু মানুষ নির্বিচারে নদীকে মেরে ফেলে। সেযাত্রায় আমাকে দশ/ বারোটা নদী দেখানো হয়েছিল যার সবকটাই ছিল মরা নদী। আমার বিস্ময় আর ক্ষোভ দেখে আমার প্রদর্শক খুব বিস্মিত আর বিরক্ত হয়ে বললেন,
-মানুষ বাড়ছে তাই ক্ষেতখামার ঘরবাড়ির জন্য জমি প্রয়োজন । এই নদী গুলো ব্যবহার না করলে কিভাবে সেই প্রয়োজন মিটবে বলেন?
আসল ব্যাপার কোন প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয় বরং মানুষ জমির লোভে পড়েই এদেশের অসংখ্য ছোট আর মাঝারি নদীকে মেরে ফেলে। এটা করতে নদীর বুকে দৈর্ঘ্য বরাবর প্রথমে পুঁতে দেয় সারি সারি বাঁশ বা গাছের গুঁড়ি, তাতে স্রোতধারা সংকীর্ণ হতে হতে একসময় পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। তখন তাতে মাটি, বালি দিয়ে ভরাট করে ঘরবাড়ি, কলকারখানা গড়ে তোলে, সেইখানে এক নদী ছিল জানবে না আর কেউ! ছোট নদীকে মারতে আরেকটা কাজ করে মানুষ - নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে বাঁশ পুঁতে দেয়, তাতে নদী কতগুলা স্রোতহীন পুকুরের মত হয়ে যায়। সেগুলো ভরাট করে নিলেই তৈরি হয়ে যায় দামী জমি। বলা ভাল, এভাবে নদীকে মেরে ফেলে যে মানুষগুলো তারা কোন সাধারন মানুষ নয়, তারা ক্ষমতার দাপটে উন্মত্ত মানুষ।
দেশের সকল এলাকাতেই শুকনা মৌসুমে যখন নদীতে খুব অল্প পানি থাকে তখন নদীর পানি পাম্প করে নদী তীরের ফসলী জমিতে সেচ দেয়া হয়। ফলে নদী শুকিয়ে যায়- সেই শুকানো নদীর বুকে তখন ধান ফলান হয়। এভাবে কিছু ধান উৎপন্ন করে লাভ হয় ঠিকই কিন্তু নদীর মাছ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ নদী শুকনো থাকে এপ্রিল মে মাস পর্যন্ত, এই সময়টা মাছের ডিম ছাড়া আর পোনা উৎপাদনের সময়, তাই পানির অভাবে মাছের উৎপাদন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বড় নদীতে পানি বেশি থাকে, নদীতীরের লোকবসতি আর নৌ চলাচলের ফলে মানুষের নজরদারীতে থাকে ফলে সেগুলোকে এতসহজে দখলদাররা মারতে পারে না। মরে কেবল বড়নদী থেকে উৎপন্ন উপনদী, শাখানদী আর প্রশাখানদী। অবশ্য কিছু কিছু বড় নদীও এখন মৃত্যুপথ যাত্রী। মানবসৃষ্ট কিছু স্থাপনা ও পরিকল্পনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুরু করি বুড়িগঙ্গাকে দিয়ে। বুড়িগঙ্গা যেন বুক পেতে দিয়েছে ঢাকা নগরের সমস্ত বর্জ্য ধারণ করবার জন্য।
বুড়িগঙ্গাতে প্রতিদিন ঢালা হয় বিভিন্ন শিল্প কারখানার, ট্যানারির, হাসপাতাল ও ইটভাটার বর্জ্য, কয়েকটন পলিথিন, সারা দেশের নানা অঞ্চল থেকে সদরঘাটে যে ফল আসে তার মধ্যেকার পঁচা ফল - যা ফল ব্যবসায়ীরা বুড়িগঙ্গায় ফেলেন। এভাবে বুড়িগঙ্গায় প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টন নানা ধরনের ধরনের আবর্জনা আর ট্যানারির বাইশ হাজার লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হয়। পলিথিন জমে বুড়িগঙ্গার তলদেশ দশ বারো ফুট ভরাট হয়ে গেছে। এই ঢালা কর্ম ঠেকানোর জন্য আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। বুড়িগঙ্গার দূষণ আরো বাড়িয়ে চলেছে ওয়াসা। প্রতিটি বড় শহরেই বৃষ্টিজল বাহী নালা আর পয়ঃনিষ্কাশন নালা আলাদা থাকে কিন্তু আমাদের ঢাকা ওয়াসা এই দুই ধরনের নালাকে একত্রিত করে বুড়িগঙ্গায় ফেলছে। ফলে বুড়িগঙ্গার অবস্থা দাঁড়াল এই- দুপাশ ভূমিদস্যুদের দখলকৃত, নদীতল পলিথিনে ভরাট আর পানি দূষিত! এই দূষিত পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়। জলজ জীবন বিকশিত হবার জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান অন্তত চার পিপিএম হতে হবে কিন্তু বুড়িগঙ্গায় তার পরিমান শূন্য পিপিএম।ফলে বুড়িগঙ্গায় কোন মাছ নেই, জীবন নেই। বুড়িগঙ্গা এক মৃত নদী।
এরপর পদ্মানদী- আমাদের এই পদ্মা নদীর ঢেউ নিয়ে কত গান আছে। অথচ শুকনো মৌসুমে আজ পদ্মায় ঢেউ নেই, জল নেই।
এখন পদ্মা মরে যাচ্ছে। পদ্মার প্রবাহ কমার পেছনে জলবায়ুর পরিবর্তন কিছুটা দায়ী হলেও এর মূল দায় নদীর উজানে ভারতে অবস্থিত বিভিন্ন স্থাপনা, যা পদ্মায় পানি আসতে দেয় না। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা এবং অন্যায় ভাবে ভারত গঙ্গার পানি আটকে রাখছে, এরফলে ভারতের কোন কোন প্রদেশ যখন বন্যায় ভাসছে তখন পদ্মায় ধূ ধূ চর। ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও গঙ্গা নদীর উপর কানপুরে নির্মিত হয়েছে গঙ্গা ব্যারেজ, হরিদ্বারে পানি প্রত্যাহারের জন্য নির্মিত হয়েছে কৃত্রিম খাল, উত্তরপ্রদেশ আর বিহারে গঙ্গানদীর উপর চারশ পয়েন্ট থেকে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ফলে ফারাক্কায় পানি কমে গেছে। আবার পদ্মা শুকিয়ে যাবার ফলে এর সাথে সংযুক্ত সমস্ত শাখা নদী আর খাল বিল শুকিয়ে গেছে, সেইসাথে আশংকাজনক ভাবে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। পদ্মার বুকে চর পড়ছে, ইলিশ দূরে থাক, পদ্মাতে মাছের প্রাপ্তি প্রায় শূন্য। অনেক গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ছে।
একই ভাবে শুকিয়ে মারা যাচ্ছে তিস্তা নদী। খরাপ্রবন রংপুর এলাকায় সেচ সুবিধা দেবার জন্য নীলফামারীতে তিস্তা নদীর উপর তিস্তা ব্যারেজ নির্মিত হবার কিছুদিন পর এর থেকে একশ দশ কিলোমিটার দূরে ভারতের গজালডোবায় নির্মাণ করা হয় ব্যারেজ আর তারপর থেকেই ভারত একতরফা ভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করতে থাকে। প্রয়োজনীয় পরিমান পানির অভাবে তিস্তা আর এর সাথে সংযুক্ত সমস্ত শাখানদী, উপনদী আর সেচখাল শুকিয়ে যেতে থাকে। নীলফামারী জেলার কুড়িটি নদীর অধিকাংশই মরে গেছে।
একটা নদী, ছোট বা বড় যাই হোক, তার সাথে অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িয়ে থাকে। যখন নদী মরে যায় তখন কি হয়? পানির অভাবে মাঝি নদীতে নৌকা চালাতে পারেনা, জেলে মাছ ধরতে পারে না, সেচের অভাবে কৃষকের ফসল শুকিয়ে যায়। নদীকে জমিতে রূপান্তরিত করে সেখানে কলকারখানা স্থাপন করলে যত লোকের কর্মসংস্থান হয় তার তুলনায় এই কর্মহীন জেলে, মাঝি ও কৃষকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। পরিবেশের যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়।
আমাদের দেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কয়েকটি সংস্থা আছে যেগুলোর কাজ নদী নিয়ে, নদীর তীর ভাঙনের কবল থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা কিন্তু নদী বাঁচানোর জন্য কেউ কাজ করে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য কাজ করে থাকে। এই বোর্ড অনেক কাজের মধ্যে নদী নিয়েও কাজ করে থাকে যেমন নদী ও অববাহিকার উন্নয়নকল্পে নদীতীর রক্ষণ, ব্যারেজ, রিজার্ভার, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ,বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন, নদীর পানি দিয়ে সেচ দেয়া ও খরা নিয়ন্ত্রন। এছাড়াও মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ,পরিবেশ উন্নয়ন ও নৌপথের নাব্যতা রাখতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে নদী খনন করে থাকে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী গবেষণাগার (River research institute) নদী নিয়ে গবেষণার কাজ করে। পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (Water resources planning organization) বাংলাদেশের পানি নীতি প্রনয়নের কাজ করে। Institute of water modelling নদীর গাণিতিক মডেল তৈরি করে বন্যার পূর্বাভাস, বন্যা নিয়ন্ত্রন করার জন্য আর আরো নানা ধরনের মডেল তৈরি করে। এই এতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে নদী সংক্রান্ত কাজের জন্য অথচ এর কোনটিই একটি মৃতপ্রায় নদীকে বাঁচাবার জন্য কাজ করে না। এছাড়াওআমাদের আছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, আন্তঃ নদী পরিবহন কর্তৃপক্ষ (IWTA) যার কাজ জলপথে যাতায়াত সুগম করা। এজন্যে তারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন নদীতে ড্রেজিং করে তার নাব্যতা বজায় রাখে কিন্তু যে নদী একেবারে শুকিয়ে গেছে তাতে নৌ চলাচলের উপযোগী করার জন্য কিছু করে না।
তাহলে নদীরা কি এভাবে মরতেই থাকবে? না, আমাদের সচেতনতা নদীকে বাঁচাতে পারে। নদী বাঁচানোর জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। আমাদের দেশীয় আইন দিয়ে নদীকে দখলদারিদের এবং দূষণকারীদের থেকে বাঁচানো সম্ভব। আমাদের সংবিধানের ১৮( ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, "দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সুরক্ষা করতে রাষ্ট্র সদা সচেষ্ট থাকবে।" পরিবেশের সুরক্ষার জন্য আমাদের বেশ কিছু আইন আছে যেমন ২০১০ সালে প্রণিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ২০১৩ সালে প্রণিত পানি আইন ও নদী উরক্ষা কমিশন আইন যাতে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও নিরসন করে পরিবেশ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৃথিবীর যে অল্প কয়টি দেশে আলাদা পরিবেশ আদালত আছে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। সুতরাং কোন নদী যদি দখলদার কবলিত হয় বা দূষিত হয় তবে ভুক্তভোগীরা পরিবেশ আদালতে বিচার চাইতে পারেন। সুবিচার হলে নদী বেঁচে যেতে পারে।
একসময় বলা হত মাছে ভাতে বাংগালী। সেসময় এদেশের নদীগুলো জালের মত ছড়িয়ে ছিল। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী এদেশের নদীর সংখ্যা সাতশ। কি সুন্দর সব নাম এই নদীগুলোর- ইছামতী, মধুমতী, ইরাবতী, পায়রা, চন্দনা, সুগন্ধা, দুধকুমার, তরসা। এর মধ্যে কতগুলো হারিয়ে গেছে কে জানে! যদি একটিও নদী বাঁচে তাতে নদীর ভূ- উপরিস্থ পানির সাথে সাথে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতাও বেড়ে যায়। ফলে নদীর আশপাশের অঞ্চলে গাছপালা বেশী হয়, পরিবেশ ভাল থাকে। বেঁচে যায় সে নদীর মৎসকূল, ফলে বাঁচে জেলে সম্প্রদায়।যদি আমাদের সমস্ত নদীগুলো কার্যকরী থাকে তবে সারাদেশে নৌপথে যাতায়াত ও পরিবহন করা যাবে- এটা হবে সড়কপথের চেয়ে সহজ, সস্তা এবং অনেক নিরাপদ।ফলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে বড় জনগোষ্ঠী।
আজ ১৪ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস, (International day of action for rivers) এদিন মূলত নদী বাঁচানোর চেষ্টাকরার দিন। এই দিন সম্পর্কে বলা হয়েছে, "এই দিনটিতে আমাদের পরস্পরকে জানাতে হবে আমাদের নদীগুলো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে, এবং আমাদের জানতে হবে কিভাবে আমরা পানি এবং শক্তির সুষ্ঠু সমাধান পেতে পারি।"
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:৫৪