somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছবি তোলার দিন

২২ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি তোলা আজকাল কত সহজ হয়ে গেছে। প্রায় প্রত্যেকের পকেটেই থাকে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল, যখন খুশি পকেট থেকে বের করে নিয়ে বোতাম টিপলেই ছবি তৈরি! ছবি পছন্দসই না হলে আরেক বোতাম টিপে ছবি মুছে আবার নতুন ছবি তোলা যায়। তাই নিজের নানা ভঙ্গির ছবি, ফুল-পাতা, পাহাড়-নদী এমনকি খাবারের থালারও সামনে ছবি তোলা হচ্ছে। বাচ্চা মায়ের পেটে থাকতেই ডাক্তারসাহেব তার ছবি তুলে দিচ্ছেন! আর জন্মের পরমূহুর্ত থেকেই অজস্র ছবি তোলা হতে থাকে! সেই ছবিও সাথে সাথেই অন্তর্জালের মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রিয়জনের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে।

আমরা ছবি তুলতাম কালে ভাদ্রে- বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে স্টুডিয়োতে গিয়ে বা বাসায় ক্যামেরা হাতে কোন অতিথি এলে।সাধারণত বিদেশ ফেরত ছাড়া অন্যদের হাতে ক্যামেরা থাকত না বললেই চলে। সেযুগে আর কজনই বা বিদেশ যেতেন! তাই ক্যামেরা থাকত খুব কম লোকের হাতেই। আমার প্রথম ছবি যেটা আছে সেটা আমার তিন বছর বয়সে তোলা, ষাটের দশকে। কোন কারণে আমার ব্লাড টেস্ট করতে হয়েছিল তাই আমি খুব কাঁদছিলাম। মন ভাল করতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্টুডিয়োতে, ছবি তুলতে। এই বিরাট প্রাপ্তিতে সত্যিই মন ভাল হয়ে গিয়েছিল।

তখনকার সব ছবি ছিল সাদাকাল। সেই ছবি তোলার সময় খেয়াল রাখতে হত যেন পোশাক একরঙা না হয়। কারন হাল্কা রঙের পোশাক ছবিতে দেখাত সাদা আর গাঢ় রঙের পোশাক দেখাত কালো। তাই হাল্কা আর গাঢ় এই দুই রঙ আছে এমন পোশাকই ছবিতে সবচে ভাল দেখাত। তখন আমাদের নতুন জামা বানানোই হত বছরে বড়জোর চারটা, তারমধ্যে অন্তত একটা বানানো হত ছবি তোলার কথা মাথায় রেখে- হাল্কা আর গাঢ় রঙের মিশেলে। কখনো সেই একমাত্র গাঢ়- হাল্কা রঙের জামা পড়ে কয়েকটি উপলক্ষ্যে ছবি তোলা হত। একবারো ভাবতে হত না এই জামা আগে কেউ দেখেছে কিনা- তখন তো ফেইসবুক ছিলই না। ছবি তোলার একটা উপলক্ষ্যে ছিল বিয়ে- বিয়ের ক'দিন পর বাড়ীতে ফটোগ্রাফার ডাকা হত। নববধূ - বরকে পাশাপাশি বসিয়ে ছবি তোলা হত, আরেকটা তোলা হত বাড়ীতে সমবেত সবাইকে নিয়ে গ্রুপ ছবি যার মাঝখানে বর-বঁধু বসে থাকতেন আর একেবারে সামনে মেঝেতে বসত বাড়ীর ছোটরা। সেই ছবি যেদিন প্রিন্ট হয়ে, বেশিরভাগ সময়ই ফ্রেমবন্দী হয়ে বাড়ীতে আসত সেদিন যেন এক উৎসবের দিন। আজ ওয়েডিং ফটোগ্রাফারকে দিয়ে তোলা নিখুঁত সুন্দর ছবি দেখেও সেই উৎসবের আমেজ পাইনা!

সেইসব ছবি লাগানোর জন্য যে এলবাম তাতে থাকত কাল মোটা কাগজের পৃষ্ঠা। এমন একটিমাত্র এলবামেই আমাদের পরিবারের সারা জীবনের সব সাদাকালো ছবি এঁটে গিয়েছিল! এখন কত এলবাম! কত অজস্র ছবি! হঠাৎ মনে পড়ল বহুদিন এলবামে ছবি সাজাইনি! মনে হয় গত দশ বছরে কোন ছবি প্রিন্টও করিনি। এই সময় থেকেই পুরানো এনালগ ক্যামেরা বাদ দিয়ে ডিজিটাল ক্যামেরা আর মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু হয়েছে, সেই ডিজিটাল ছবি প্রিন্ট না করেই যখন খুশি দেখেছি। এই ডিজিটাল ছবি তোলা সহজ কিন্তু প্রিন্ট করতে গেলে কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হয় তাই এখন সব ছবি থাকে ক্যামেরায়, ল্যাপটপে- বিভিন্ন নামের এলবামে। চাইলেই সেসব এলবাম খুলে দেখা যায়, কিন্তু পুরানো এলবামের পাতা উলটে দেখার যে আনন্দ তা কি আর এসব ভারচুয়াল এলবামে পাওয়া যায়!

অবশ্য সত্তরের দশকে ছবি তোলা আর তেমন বিরল ঘটনা হিসাবে থাকেনি। অনেকের হাতেই ক্যামেরা থাকত, বেশ ছবি তোলা হত।এমনকি এসময় মাঝে মাঝে কারো কারো রঙিন ছবিও দেখা যেত। কোডাকের ফিল্ম আনা হত বিদেশ থেকে, তার প্রিন্টও বিদেশ থেকে করে আনা হত। সত্তর দশকের শেষে আশি সালে এলিফ্যান্ট রোডে দেশের প্রথম রঙিন ছবির ল্যাব হয়। সেই প্রথম দিকে রঙিন ছবি ছিল পরম বিশ্ময়কর বস্তু। এই বিশ্ময়কর বস্তুটা কি করে তৈরি হয় জানার জন্য খুব কৌতূহল হল। অবশেষে একদিন সেই ল্যাব দর্শন করে কৌতূহল মেটানোর সুযোগ হয়েছিল।এক ক্লাসমেটের চাচাতো ভাইয়ের মামার বন্ধু সেই ল্যাবের মালিক ছিলেন এই সুবাদে ল্যাব পরিদর্শন করেছিলাম। অবশ্য এই বিশ্ময় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, চার/পাঁচ বছরের মধ্যেই অনেক স্টুডিয়ো তৈরি হল যেগুলোতে রঙিন ছবি তোলা আর প্রিন্ট করা যেত।

নিজের ক্যামেরা থাকলেও অনেকেই স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলতেন। কারণ ক্যামেরা ঠিকমত এডজাস্ট করে ভাল ছবি তোলা বেশ কঠিন ছিল। তাছাড়া স্টুডিয়োতে ছবি তোলার জন্য অনেকরকম দৃশ্যপট থাকত। ছবি তোলার কিছু আনুষঙ্গিক জিনিষপত্রও থাকত। তাই সাদামাটা ভাবে ছবি না তুলে স্টুডিয়োতে রাখা সানগ্লাস আর কোট পরে, তাজমহল কিংবা সমুদ্রের পটভূমির সামনে দাঁড়িয়ে বেশ ভাব নিয়ে ছবি তুলতেই অনেকে বেশি আগ্রহী হতেন। বিয়ের সম্ভাব্য পাত্র- পাত্রীদের ছবি স্টুডিয়োতেই তোলা হত। তবে ছবি তোলার সময় পটভূমির খেয়াল না রাখলে কখনো কখনো ছবি হাস্যকর হয়ে উঠত। যেমন, পাত্রী স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলেছেন, ছবিতে দেখা গেল পাত্রী সেজেগুজে এভারেস্ট শৃঙ্গ এর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবির পটভূমি বিভ্রাটে আমাকেও পড়তে হয়েছিল। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে খুব শখ করে মরুভূমির পটভূমিতে ছবি তুল্লাম, পরে দেখি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমরা দুস্তর মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি অথচ আমাদের একপাশে সাটিনের পর্দা দুলছে! রাগ করে তৎক্ষণাৎ সেই ছবি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।

অন্তর্জাল থেকে এই দুটো ছবি দিলাম সেকালের ছবির দৃশ্যপটের নমুনা হিসাবে।




ছবিতে ফুলহাতে যুবক পোজ দিয়েছেন, পেছনে দেখা যাচ্ছে একই সাথে পাহাড়, নদী আর দূর্গের দৃশ্য।




এই ছবিতে তাজমহলের সামনে মটোর সাইকেল চালাচ্ছেন বলে মহিলা বাহাদুরি নিতে পারতেন কিন্তু আনাড়ি ফটোগ্রাফার দৃশ্যপটের বাইরে কিছু ঝালরের ছবি তুলে সব মাটি করেছে।

আমার জীবনের প্রথম ক্যামেরাটি উপহার পেয়েছিলাম প্রথম সন্তানের জন্মের পর, আমার স্বামীর কাছ থেকে। সেটা ছিল একটা অটো ফোকাস ক্যামেরা, যেন সন্তানের বিশেষ মুহূর্তগুলো ছবিতে বন্দী করতে পারি। ক্যামেরা আর আমি সবসময়ই তৈরি থাকতাম, তাই এমন অনেক ছবি তুলেছিলাম যা এতদিন পর দেখতে খুব ভাল লাগে। একটা দুঃখ ছিল, অটো ফোকাস ক্যামেরায় কিছুটা দূর থেকে ছবি তুলতে হত বলে মুখের অভিব্যক্তির ছবি তোলা যেত না।

সামুর ভ্রমন ব্লগের কল্যানে কত জায়গার কত অপরূপ ছবি আমার ঘরে বসেই দেখতে পাই, কত শহর-গ্রাম, সাগর- পাহাড়- নদী, কত ফুল কত কিছু দেখলাম! আমার ছোটবেলায় কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে এমন নানা সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেলেও তাদেরকে এভাবে এত অজস্র ছবি তুলে আনতে দেখি নি। হয়ত নিজের কিছু ছবি তুলতেন, সেই ছবির সাথে আনতেন সেখানকার ভিউ কার্ড। এই ভিউ কার্ডও আসলে নানা সুন্দর দৃশ্যের ছবি, যেই ছবিগুলো তুলতেন কোন ভাল ফটোগ্রাফার,তারপর সেই ছবি দিয়ে কার্ড বানানো হত। কখনো বিদেশ থেকে কেউ ভিউকার্ডে স্ট্যাম্প লাগিয়ে পোস্ট করে আমাদের পাঠাতেন। বার বার তখন সেই কার্ড দেখতাম।

আশির দশকেই কি খুব বেশি মানুষের হাতে ক্যামেরা ছিল! আশির দশকে ছবি তোলার একটা স্মৃতি শেয়ার করি! তখন সবেমাত্র চাকরীতে যোগ দিয়েছি; তার কিছুদিন পর নবনিযুক্ত ২০/২৫ জন গেলাম দুই মাসের জন্য কাপ্তাইতে, প্রশিক্ষণের জন্য। কাপ্তাই লেক, বাঁধ, কর্ণফুলী নদী আর নানারকম গাছপালা আমাদের বিমোহিত করে তুলেছিল। কিন্তু সেসবের ছবি তুলব কি করে, আমাদের পুরো গ্রুপে মাত্র দুজনের ক্যামেরা ছিল। সেই দুজনের একজন ছিল আমার সহপাঠী,বন্ধু। সে খুশিমনে আমাদের কয়েকজনের জন্য অনেক ছবি তুলে দিয়েছিল। এক জটিল হিসাব করে সে ছবি প্রতি ফিল্মের দাম, ডেভেলপমেন্ট আর প্রিন্ট খরচ বের করেছিল। এক রোল ফিল্ম শেয হলে আমরা ছবির মোট সংখ্যা হিসাব করে তাকে টাকা দিতাম আর সে চিটাগাং গিয়ে ছবি প্রিন্ট করে এনে দিত। খুব সহজেই তখন নিজের ইচ্ছামত ছবি তুলতে পারতাম যদি নিজের একটা ক্যামেরা থাকত। ক্যামেরাও কিনে ফেলতে পারতাম সহজেই, কোন ছুটির দিনে চিটাগাং এর দুবাই মার্কেট গিয়ে এক মাসের বেতনের টাকা দিয়ে। তবু কেন যে ক্যামেরা কেনার কথা ভাবিনি! কিপটেমী নাকি অল্পে তুষ্টি কে জানে!

কত ছবি! ছবিগুলোর সাথে জীবনের কত হাসিকান্না জড়িয়ে আছে। পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে ছবি দেখে। একটা কথা মনে হয়- এই এলবাম নামিয়ে, পাতা উলটে ছবি দেখার শেয দর্শক কেবল আমার সমসাময়িক প্রজন্মই। পরবর্তী প্রজন্ম এটা করবে না বরং কখনো ইচ্ছা হলে তাদের ডিজিটাল এলবামে অনেক সহজে নির্দিষ্ট ছবি খুঁজে দেখে নেবে। দেখবে কি? কেন যেন মনে হয় এরা পেছন ফিরে চাইবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৩:২৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×