somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসি হাসি পরবো ফাঁসিঃ বাংলার কিশোর বিপ্লবী “ক্ষুদিরাম” ও “প্রফুল্ল চাকী”

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





“There cannot however remain any doubt but that the misery inflicted by the British on the Hindustan is of an essentially different and infinitely more intensive kind than all Hindustan had to suffer before.” [Karl Marx]
ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের অগুনিত শহীদদের মধ্যে যাদের নাম অত্যন্ত গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মৃত্যু কে আলিঙ্গন করে ব্যাক্তিগত সুখ তারা বিসর্জন দিয়েছিলেন পরাধীন দেশের শৃঙ্খল মোচনের জন্য। ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়, অত্যাচার, অর্থনৈতিক শোষণ আর পরাধীনতার গ্লানি তাঁদের এক মুহূর্তও শান্তি দেয়নি। জননীর চেয়ে তাঁরা বড় করে দেখেছেন তাঁদের জন্মভুমিকে। প্রবাদের ফিনিক্স পাখি যেমন আগুনে আত্মাহুতি দিয়েও সেই ছাই থেকে পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়; ঠিক তেমনি এই দুঃসাহসী মহৎ প্রানদের মৃত্যু নেই। ক্ষণজন্মা বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম জন্মগ্রহন করেন যথাক্রমে ১৮৮৮ সালের ১০ ই ডিসেম্বর এবং ১৮৮৯ এর ৩ রা ডিসেম্বর।

তখন বাংলার সবচেয়ে অত্যাচারী এবং কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। নামে আইনের রক্ষক হয়েও যিনি বিচারের সময় প্রহসন ব্যাতীত আর কিছুই করতেন না। সেই সময় তার হুকুমে একজন ১৫ বছরের কিশোরকে চাবুক মারায় কলকাতায় তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার এই অবস্থায় ভয় পেয়ে কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল মজফফরপুরে। তখনি বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নেয় এই কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করবার। এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট করা হয় ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী নামের দুই কিশোরকে।

১৯০৮ এর ৩০ শে এপ্রিল। রাত ৮ টা। দুই কিশোর দাড়িয়ে আছে কিংসফোর্ড এর বাংলোর সামনে। এদের মধ্যে ক্ষুদিরামের পকেটে পিস্তল আর হাতে বোমা আর প্রফুল্ল এর হাতে একটি পিস্তল। তাঁদের কাছে নিশ্চিত খবর রয়েছে যে ক্লাবে কিংসফোর্ড আর তার স্ত্রী তাশ খেলছেন।

রাত ৮ টা ৩০। ক্লাব থেকে একই রকম দুটো গাড়ি বেরিয়ে এলো। প্রথম গাড়িটি দেখেই বিপ্লবী দুজন বেরিয়ে এলো। পরিকল্পনা ছিল বোমা না ফাটলে রিভলবার দিয়ে আক্রমন চালাতে হবে।

প্রথম গাড়িটি যখন বাংলোর গেইট এর সামনে ঠিক তখনি ক্ষুদিরাম তাঁর হাতে থাকা শক্তিশালী বোমা ছুড়ে মারলো গাড়ির উপর। প্রচণ্ড শব্দে তা বিস্ফোরিত হয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো গাড়িটিকে। এটি ছিল বিপ্লবীদের তৈরি প্রথম বোমা যা ব্রিটিশ শক্তিকে আঘাত করেছিলো।

কাজ শেষ ভেবে তাঁরা যখন আত্মরক্ষার জন্য পালাতে শুরু করলো তখন তাঁরা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে কিংসফোর্ড এর বদলে তাঁরা হত্যা করেছে মিস ও মিসেস কেনেডি নামের দুই মহিলাকে। তাঁদের আরেকটি ভুল ছিল যে তাঁরা তাড়াহুড়ো করার জন্য জুতো ফেলে যায় এবং বাকি পথ খালি পায়ে যাওয়াই তাঁদের বিপদের কারন হয়েছিলো।

ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল পালানোর সময় আলাদা হয়ে যায়। প্রফুল্ল চাকীকে মোকামঘাট স্টেশনে নন্দলাল ব্যানার্জি নামের এক সাব ইন্সপেক্টর যে কিনা ট্রেনে উঠবার পড়েই প্রফুল্লকে দেখে সন্দেহ হওয়ায় তাঁকে নজরে রাখছিল- স্টেশনে নামবার পড়ে তাঁকে গ্রেফতার করবার জন্য জড়িয়ে ধরে। প্রফুল্ল আর কোন উপায় না দেখে দৌড়িয়ে প্লাটফরম এর অন্যপ্রান্তে গিয়ে নিজের গলায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে গুলি করলো। প্রফুল্ল ছিলেন বাংলার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম প্রকাশ্য শহীদ যিনি পুলিশের হাতে ধরা দেননি।



প্রফুল্ল চাকীর পরিচয় নিশ্চিত হবার জন্য তাঁর ছিন্ন মস্তক স্পিরিটে ডুবিয়ে পাঠানো হলো কলকাতায়। নন্দলাল ব্যানার্জি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পেলো এক হাজার টাকা এবং এর ঠিক আট মাস আট দিন পর বিপ্লবীরা নন্দলালকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করেছিলো।

এদিকে ক্ষুদিরাম সারারাত হেটে চব্বিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌছায় ওয়েইনি স্টেশনে। খাবারের সন্ধানে বাজারে যেতেই সে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। রিভলবার দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা বৃথা ছিল কারন চারজন পুলিশ তাঁকে জাপটে ধরে রেখেছিলো। তখনি তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিলো এক অদ্ভুত হাঁসি যা তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে নেয়া পর্যন্ত অম্লান ছিল।





বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁসির দণ্ড হয়। আদালতে সে বলেছিল যে তাঁর বোমার আঘাতে দুজন মহিলার মৃত্যু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কিন্তু ভারতবাসীর শত্রু কিংসফোর্ডকে সে সজ্ঞানে মারতে গিয়েছিল এবং এই সম্পর্কে তাঁর মনে কোন গ্লানি নেই। ১৯০৮ সালের ১১ ই আগস্ট ভোর ৪ টায় এই মহান বিপ্লবীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর উকিল “উপেন্দ্রনাথ সেন” –
“ক্ষুদিরামের মুখের ভাব এমন ছিলো যেনো সে ফাঁসিতে যাচ্ছে না, সে তাঁর দু পাশের পুলিশ দুজনকেই ফাঁসিতে চড়াতে নিয়ে যাচ্ছে।“

এদেশের নবীন যৌবন আর স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উন্নত মস্তকে ভয়হীন ভাবে সে উঠে গেলো ফাঁসির মঞ্চে। তখনও তাঁর মুখে লেগেছিল সেই মৃত্যুঞ্জয়ী হাসি-

“হাসি হাসি পরবো ফাঁসি,
দেখবে জগৎবাসী
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
দশমাস দশদিন পরে
জন্ম নেবো মাসীর ঘরে মাগো,
চিনতে যদি না পারিস মা,
দেখবি গলায় ফাঁসি
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। “

বিপ্লবীরা শুধু মাত্র এদেশের স্বাধীনতার কথাই ভাবেননি বরং তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির। পরাধীনতার যে মর্মযন্ত্রণা তা উপলব্ধি করেই এ বিপ্লবীরা সহ আরও নাম না জানা অসংখ্য বিপ্লবী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রান তুচ্ছ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই আত্মদান বৃথা যায়নি। তাঁদের প্রতিটি রক্তবিন্দু লেগে আছে দেশের ভিত্তিপ্রস্থরে।





তথ্যসূত্রঃ
১. অগ্নিপুত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আড্ডা (বাংলাদেশ প্রকাশক), ১৯৯৫
ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে আরও পড়তে পারেন-
• নিমাই ভট্টাচার্য, মহাজাগরন, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪.


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×