একটু একটু করে বুঝতে পারছি কি করে রবীন্দ্রনাথ অপার বিস্ময়ে লিখে গেছেন গল্প কবিতা মধু রস সিক্ত কালজয়ী সব সৃষ্টি । যতবার পড়ি তাকে নতুন করে শিখছি , জানছি । এ জানার শেষ এ জনমে ফুরাবে না । এক একবার ভাবি রবীন্দ্রনাথ কি একজন ছিলেন , কেবল এক মানুষ । একজনে কি করে ধারন করা সম্ভব অনেকের মন , অনেকের কথা , অনেকের ব্যথা , অনেকের অভিজ্ঞতা । আনন্দ বেদনা চাঞ্চল্য প্রাঞ্জল সব ধারার উৎসে বসে উনি শব্দের পসরা সাজিয়েছেন ।
শিলাইদহ তাকে কোন মুগ্ধতায় বশ করেছিল সে সবার জানা ; শিলাইদহের প্রকৃতি এবং মানুষের সরলতা তাকে বার বার আকর্ষন করেছে । তাই ফিরে ফিরে এসেছেন এখানে ।
আমাদের যাওয়া ছিল সেই রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে , তাকে পাবো বলে মনের ঘরের দুয়ার খুলে বের হয়েছি সেই কবে থেকে । ' কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে , সে আজকে নয় ' । আজকে নয় , কয়েকদিন আগে । যাবার আগে প্রস্তুতি ছিল দেখবার মত । এ শাড়ী পরি , সে শাড়ি পরি । মেয়ের সাথে আলোচনা চলে , ছোট হলেও অন্ধের যষ্টি । ভ্রমনে জর্জেট , সিল্ক ভাল জানে সে । তবু সূতী পরতে হবে পাড়ওয়ালা ওকে বোঝাই । পথে যেতে যেতে মেয়ের পাপাকে বললাম , " রবীন্দ্রনাথ যদি জানতেন তার অবর্তমানে তার সাথে দেখা করতে যাবার এহেন পরিচর্যা , না জানি আরো কি কি লিখে যেতেন ।"
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি , স্বপ্নের বাড়ি আমাদের । সেখানে গিয়ে ছুটছি যেন আপ্রান ; রবীন্দ্রনাথ কোথায় , কিভাবে ! সে ছাড়া এক দন্ড চলে না যে ।
এত মন ছোটাছুটির ধার ধারল না এক কুলফিমলাই বিক্রেতা । ধরিয়ে দিল সবার হাতে । ঘন দুধের কুলফি হাতে নিয়ে ছেলে আমার তার মায়ের মতই দিক্ হারা । বেশ অনেকক্ষন পর দেখা দিল বিক্রেতা । আমার ছেলের হাতে যে কুলফিপাত্র ছিল ছোট মত , সেটি সে ফেরত পায় নি ।
রবীন্দ্রনাথ পড়ে রইলেন আমাদের চিন্তানদীতে ডুব মেরে । তিন ইঞ্চি সাইজের সে টিনের পাত্র দেখা দিচ্ছে না । বিক্রেতা সে লোকটির হাতে ১০ টি টাকা ধরিয়ে দিলাম । সে আরো অমন সংগ্রহ করে নেবে ।
সন্ধ্যা হয় হয় , বেরিয়ে আসছি । সেই কুলফি বিক্রেতা অপূর্ব সুন্দর হাসি মেলে দিয়ে ১০ টাকা এগিয়ে দিল । জানাল সে পেয়ে গেছে সেটি ঘাসের মধ্যে । টাকাটা তাকে দেবার ইচ্ছে ছিল । বললাম, " রাখুন আপনি , দিতে হবে না ।" ।
জবাব শুনে অবাক । হেসে বলল , " সেই টে তো আমি পেয়ে গেছি , এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো ? "
প্রায় জোর করে দিয়ে চলে গেল চোখের আড়ালে ।
কি বলি তাকে ? টাকা দিয়ে মানুষ কি করে ? টাকার জন্য মানুষ কিনা করে ?
বড় ভাবনায় পড়ে গেলাম । মাঝে মাঝে স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পায় এমন পরিস্থিতে পড়লে । গাড়ী স্টার্ট দিতে বরকে বললাম , " চলে গেল লোকটা , তুমি কেন ওর সাথে আমার একটা ছবি তুলে দিলে না ?"
বর বলল মুচকি হেসে , " এইটুকু বাকী আছে ?"
চলে আসতে আসতে অনেকটা সময় সেই হাসিমাখা গ্রাম্য সরল লোকটার কথা মনে হচ্ছিল । রবীন্দ্রনাথ কেন এ শিলাইদহের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন খানিকটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি ।
ছবি : আমার কন্যা ,আমার প্রধান সহকারী , দ্বিতীয় অঘটন ঘটন পটিয়সীর তোলা --- বকুল তলায় যাবার পথে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১০ রাত ৯:৪৯