পিলখানা ! নামটা শুনলে পিলে চমকে যাবার মতো অবস্থা হয়। ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালের কথা মনে পড়ে এখন । ১৯৮৭ সালে আমার জন্ম ঐ পিলখানায়। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি ঐ পিলখানাতে, ও খানকার মাঠে খেলে আমি বড় হয়েছি । ঐ দিন আমি অনান্য দিনের মতো পিলখানার অভ্যন্তরে আমার পরিবার সাথে ছিলাম। আজ সেইদিনের অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আগেই বলে নিচ্ছি, আমি যা দেখেছি তাই শুধু বলব, কোন কারো পক্ষে ও না, বিপক্ষে ও না।
তার আগে কিছু তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি।
১. পিলখানা এলাকাটা অনেক বড় একমাথা থেকে আরেকমাথা পর্যন্ত হেঁটে যেতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা আর পুরোটা রাউন্ড বা ঘুরে দেখতে পায়ে হেটে ২.৩০ ঘন্টার ও বেশি লাগবে ।
২. বিডিআর মোট ৫ টি প্রবেশ গেট ।
১ নং গেট কামরাঙ্ঘীরচর সংল্গন (হাসপাতাল বিডিআর সদ্যস দের কোয়ার্টার )
২ নং গেট আজিমপুর/নিউপল্টন সংল্গন (গেটটি বন্ধ ১৯৯১ সাল থেকে সম্ভবত)
৩ নং গেট নিউমার্কেট সংল্গন (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,অফিসার কোয়ার্টার)
৪ নং গেট ধানমন্ডি সংল্গন (ডিজি বাসভবন ও অফিসার মেস এবং অফিসার কোয়ার্টার)
৫ নং গেট হাজারীবাগ সংল্গন (দরবার হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিডিআর সদ্যস দের কোয়ার্টার)
৩ বিডিআর সৈনিক দের পদবী
* সৈনিক/ সিপাহী
* ল্যান্স নায়েক
* নায়েক
* হাবিলদার
* নায়েব সুবেদার (জেসিও)
* সুবেদার (এই পোস্ট আসতে আসতে চাকরী মেয়াদ শেষ হয়ে যায়) (জসিও)
* ডিআইডি (ভাগ্যক্রমে হয়)
[যতটুকু আমি জানি]
এর পর কমান্ড সেকশন যা ৩ বছর প্রবেশনে আর্মি বা সেনাবাহিনি থেকে নিয়োগ পায়। বলতে গেলে পুরো কমান্ড আর্মির সেনাবাহিনি হাতে।
৪ পিলখানয় কয়েক ধরনের আবাস আছে।
*অফিসার মেস (১ টি)
*অফিসার কোয়াটার (বাংলো সহ ৬০ /৭০ টি)
* জেসিও ও এনসিও মেস বা ব্যারাক (৬০০০+ বিডিআর দের)
* জেসিও ও এনসিও কোয়াটার (৮০০+-)
**** আনুমানিক****
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে প্রতিটি বাহিনীর প্রতিটি বছর এর একটি নির্দিষ্ট সময় তাদের নিজস্ব অনুষ্ঠান থাকে ঠিক তেমনি বিডিআর দের ও বিডিআর সপ্তাহ নামে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয় । সাধারনত বিডিআর সপ্তাহ মার্চ মাসে হয় কিন্তু ২০০৯ সালে প্রথম (আমার দেখা) ফেব্রুয়ারিতে হল!! তাই চরিদিকে সাজসাজ রব ।
বিডিআর একটা নিয়ম ছিল, বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসেন, যেদিন প্রধানমন্ত্রী আসে সেদিন যেন এটা একটা জেলখান হয়ে যেত। কারন কার ও বাসায় গেস্ট এলাও না, বাসার বাইরে বেরোনো নিষেধ , পিলখানার বাইরে থাকলে প্রধানমন্ত্রী না যাওয়া পর্যন্ত আপনি বাসায় [পিলখানায়] ঢুকতে পারবেন না । সবই প্রটকল এর অংশ ।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে,
আমার বাবা একজন মেডিকেল স্টাফ (সুবেদার) হিসাবে বিডিআর হাসপাতালে কর্মরত ছিল । সেইসূত্রে আমার ও পিলখানায় বেড়ে ওঠা। ওনার চাকরি জীবনের শেষ দিন ছিল ২২-২৫ শে ফেব্রুয়ারি মধ্যে ছাড়পত্র সংগ্রহ করা। কিন্তু বিডিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে ছাড়পত্র না দিয়ে ২৫ তারিখে ছাড়পত্র প্রদান করবে বলে। কারন হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগমন উপলক্ষে। তাই ফেয়ার ওয়েল দিতে পারবে না এই সব আর কি ।
আমাদের বাসা ছিল বিডিআর ১ নং গেইট সংলগ্ন (হাসপাতালের সাথে)। তো সেইদিন আমার বাবা সকাল বেলা ৭.৩০ সময় অফিসে চলে যায়। কারন আজ তাকে ছাডপত্র দিবে। বাসায় আমি ও আমার মা ছিলাম। সকালে আমার বাসায় ৬.০০ টার দিকে আমার কিছু ছাত্র পড়তে আসত । তাদের আমি একাউটিং পড়াই এই আর কি । তো তাদের পড়ানো শেষ করে আমি নাস্তা করার জন্য বসলাম, ৯.২০ {আনুমানিক} এর দিকে বারান্দায় । আমাদের বাসা ছিল একতলা , বাসার সামনে একটা পার্ক ছিল দোলনা , স্লিপার নিয়ে । ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রা খেলা করছিল । আমার ছাত্ররা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল । হঠাৎ শুনি আওয়াজ হচ্ছে ৯.৩৫ এর মতো বাজে ভাবলাম হয়তো টাটোশো এ প্রস্তুতি (টাটোশো হচ্ছে বাজি পোড়ানো যা বিডিআর সপ্তাহ শেষে করা হয়) তো আওয়াজ দেখি বাড়ছে। ৯.৪৫ এর ও একটু বেশি দেখি আমার বাবা দৌড়িয়ে বাসার দিকে আসছে। সে বাসায় ঢুকে প্রথম যে কথা বলল আমাকে,
বাবা তুমি যেভাবে পারো বেরিয়ে যাও দরবার হলে গুলাগুলি হয়েছে, আর্মি যেকোন সময়ে এ্যাটাকে আসতে পারে।
বাবাকে জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছে ? তিনি বলেন জানি না তবে গন্ডগোল হইছে। উনি বললেন আমি আমার ইউনিটে যাই স্যার (আর্মি অফিসার) দের কাছে। আমি বেরোনোর চেষ্টা করলাম বাট দেরি হয়ে গেছে কারন আমাদের বাসার সামনে অনেক বিডিআর সদস্য সবাই অস্ত্র হাতে এবং ওপেন ফায়র করছে। যে যার মতো দোড়াছে , ফায়ার করছে। কিৃছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপর শুরু হলো মাইকিং
কেউ বাসার বাইরে বের হবেন না । আর্মি এ্যাটাকে আসতেছে, কোন বিডিআর জেসিও যদি বাসায় লুকায় থাকে তাহলে ধরে এনে রাস্তায় গুলি করা হবে।
আর বলা হল আমরা আর্মি অফিসার চাই না আমাদের সরকার নিজস্ব অফিসার দিক না হলে বিসিএস এর মাধ্যমে পারমান্টে অফিসার দিক। তিন বছরের জন্য ভাড়া করা অফিসার চাই না। ( মূলত দাবি এটাই ছিল যা পরে মিডিয়া ও সরকার ডালভাতে নিয়ে গেছে)
আমার বাবার জন্য আর ও ভীত হয়ে পড়লাম এরমাঝে সৈনিক রা আসলো বাসায় নক করে বলল স্যার আছে আমরা বলাম নাই উনি ওনার ইউনিটে।
আর ফোন এর পর ফোন যে মানুষ গুলো কে চিনি না পর্যন্ত তারা ও ফোন দিয়ে যোগাযোগ করে বলছিল ভাল আছি কি না ? এভাবে কখন যে দুপুর ৩.০০ টা বেজে গেলো টের পাইনাই।
বাসার সামনে দেখলাম এক বিডিআর সদস্য বমি করছে জিস্গাস করলাম আংকেল কোন সমস্যা সে বলল সকাল থেকে কিছু খাই নাই ঘুমায় ছিলাম ব্যারাকে হঠাৎ সবাই বলল অফিসার দের সাথে ঝামেলা বাধছে , আর্মি এ্যাটাকে আসছে .. অস্ত্র ধরায় দিল তাই চলে আসছি। আমি জিস্গাস করলাম আংকেল আসলে কি হইছে বলল বাবা জানি না । এরমাঝে আবার ফায়ার ওপেন হলো উনি বলল বাবা তারতারি বারান্দায় থেকে ঘরে যে মেঝে তে শুয়ে পড়। ৭১ যুদ্ধ কালীন যুদ্ধ এর অবস্থা কেমন হয় তা বুঝেছি।
আমার বাবার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলাম উনি বললেন উনি উনার ইউনিটের প্রধান ডাক্তার লে: কর্নেল ফ..... ও ডাক্তার মেজর রা..... (দুজনে জীবিত আছেন) সাথে আছেন। স্যার রা ভালো আছে নিরাপদে আছে । আমি বলাম আপনি কাধেঁ র উপরের
র্যাংক খুলে ফেলেন, কারন সৈনিক রা মাইকিং করছে কাধের ওপর র্যাংক তার দেখতে চায় না ।
আমার বাবা বলেন তিনি নিজেও সাথের অফিসার দের র্যাংক খুলে ফেলেছেণ এবং উনাদের জন্য ডাক্তারী গাউন এনে দিছেণ।
আমাদের সাবধানে থাকতে বলেন । এভাবে সন্ধ্যা হলো মাইকিং করে বাসার সকল লাইট নিভিয়ে ফেলতে বলল কারন হেলিকপ্টার থেকে ফায়র হতে পারে... আমাদের বাসায় শুধু টিভি চলছিল .........
আমার বাবা যখন বাসায় আসলো জিগাসা করলাম কি হয়েছে, আমার বাবা বলল কিছুই বুঝা যাচ্ছ এ না। আমারা বলাম কেউ কি মারা গেছে উনি বলেন কতজন মারা গেছে তা জানি না কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না । দরবার হলের ঐদিক থেকে কোন খবর আসতেছে না। তবে হাসপাতালে বলে শুনলাম কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আসছে ।
আমার বাবা কে আমরা আর যেতে দিলাম না কারন ২৫ তারিখ পর্যন্তই তো তার চাকরি ছিল । বাবা ও তার চাকরি জীবনের শেষ দিনে এই রকম পরিস্থিতে হতভম্ব হয়ে গেছিলেন কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না । রাত যেন আর কাটে ই না টিভি সামনে সারারাত বসে থাকলাম ........
সকালে ২৬.০২-২০০৯ মাইকিং করে বলা হলো পরিবার রা বের হয়ে যেতে পারেন কিন্তু বিডিআর সদস্য রা বের হতে পারবেন না । আমার বাবা আমাকে ও আমার মা কে বের হয়ে যেতে বলেন । আমার মা ও আমি বাবা সবাই ভাবলাম বেশি কিছু নেওয়ার দরকার নাই হয়তো বা আজ কাল এর মধ্যে সবঠিক হয়ে যাবে। ....... কারন তথন জানতাম না কি হয়েছে, কতজন মারা গেছে। তাই এক কাপড়ে ও কিছু টাকা সাথে নিয়ে আমি আর আমার মা বের হয়ে গেলাম কে জানত ! এই বের হওয়ার পর, ঘরের সকল মালপত্র পেয়েছিলাম ৪ মাস ১৩ দিন পর ..... রিফিউজির লাইফ কি জিনিস বুঝেছি ... অনার্স ৩ য় বর্ষ এর পরীক্ষা দিলাম বই ছাড়াই .........
যাক ফিরে আসি বের হয়ে যাবার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে .... আমার বাবা র জন্য ভীত হয়ে পড়ি...
পরিস্থিতি শান্ত হয় ... আমার বাবার সাথে ২৬.০২.০৯ শেষ দেখা হয় এর পর আর্মি নিয়ন্ত্রন নেয় .... আমার বাবার প্রসংসা ও করা হয় যে সে দুজন সেনা অফিসার কে সেভ করে রেখেছিল তাদের সকল নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ছিল এবং তাকে ০১.০৩.০৯ রিটায়ার্ড ধরে অবসর এর পক্রিয়া শুরু হয়। আমারা ও শুনে খুশি হই কারন রাতে ফোনে ১০ মিনিট এর মত কথা বলতে পারতাম শুধু। তখনই বাবার কাছে শুনি বিডিআর সদস্য দের খাবার এর কষ্ট। এভাবে আজ ছাড়ে, কাল ছাড়ে এরকম করতে করতে শুনি ০৬.৪.০৯ ছাড়পত্র দিবে । কিন্তু তা না হয়ে, ০৯.০৪.০৯ আমার বাবা এ্যারেস্ট হণ ।
আমি ও আজও বুঝতে পারি না কোন অপরাধে সে আজ কারাগারে?!
একজন মানুষ ৩৭ বছর একটা প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিল, সে শেষে দিনে তার সকল অর্জন এভাবে নষ্ট করতে পারে?!
আজ সবাই বিচার চায় ........ আমি ও বিচার চাই, বিচার করুক কোন সমস্যা নাই .... আমার বাবা যদি সেদিন কোন অপরাধ করে থাকে তার সাজ্জা হক কিন্তু সকল প্রমান তার পক্ষে থাকার পর ও কেন আজ সে অপরাধী?????????
আর একটি কথা ৫৪ টি মানুষ এর কথা যে বারবার বলা হয় .. কিন্তু বাকী ২০ টি মানুষের মধ্যে ১১ টি মানুষ যে বিডিআর সৈনিক ছিল যারা বিদ্রোহ দমনে মারা গেছে তাদের কথা কেউ বলে না ।
আর বিচার প্রকিয়া শুরুর পর থেকে এইপর্যন্ত যে কতজন বিডিআর সদস্য নির্যাতনে মারা গেছে তার হিসাব যে ঐ ৭৪ কে ও ছাড়িয়ে গেছে তার হিসাব কয়জন রেখেছে?
কেউ বলে না , ১০০০০+ অধিক পরিবারের বছরের পর বছর কিভাবে ঠিকে আছে, তাদের চোখের কোনায় জমে উঠা জলের খবর কেউ রাখে না । রাখে না তাদের দুর্বিষসহ জীবনের খোজ ।
জাতি পারে শুধু তেল মাথায় তেল দিতে!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৫৪