(পূর্বাপর)
-বরইবহুল দেশের সীমান্তবর্তি এক বাসিন্দা বরইর মওসুমে-,
অর্থাৎ বরই বাগান যখন বরই ফলে আচ্ছাদিত থাকে এমন মৌসুমে অনুরূপ কোন এক ব্যক্তিও ‘তাকে’ দেখেছেন। তিনিও বিভ্রান্ত নন, লক্ষচ্যুত নন, মনগড়া কথা বলেন না; বরং তিনিও অনুরুপ আল্লাহর বাণীপ্রাপ্ত।
এই মহামানব হযরত মুহাম্মদ নন; কারণ তিনি বরইবহুল দেশের বা সীমান্তের বাসিন্দা ছিলেন না। আর হযরত মুহাম্মদের পরিচয় বিক্ষিপ্ত দু’একটি আয়াতই নয় বরং সমগ্র কোরান।
ইসলামিক ফাউন্ডেসন অনুদিত কোরানে ফুটনোটে লেখা আছে যে, ‘রাছুলুল্লাহ (সাঃ) দ্বিতীয়বার মে’রাজ এ জিব্রাইল (আঃ) কে দেখেছিলেন তার পূর্ণ অবয়বে ৬ বা ৭ম আসমানে কূল বৃক্ষের নিকটে। কুল বৃক্ষটি আল্লাহর নূর দ্বারা আচ্ছাদিত। (কোরান, ই. ফা. ফুটনোট নং-৩১১, ৩১৩)
ফুটনোটগুলি আজব কল্পনা প্রসূত; শরিয়ত মতেই জিব্রাইল অহি আদান-প্রদানে রাছুলের সাথে দিন নেই রাত নেই শত-হাজার বার সাক্ষাৎ হয়েছে; বিশেষ করে কথিত মে’রাজ কালে রাছুলের পাশাপাশি সঙ্গী-সাথী ছিলেন। সেই জিব্রাইলকে ২য় মে’রাজে ৬/৭ম আসমানে বরই বাগানের প্রান্তে পূর্ণ অবয়বে দেখার বর্ণনা স্ব বিরোধী ও হাস্যকরই নয় বরং বিভ্রান্তকর! তা’ছাড়া উক্ত বর্ণনায় পূর্ণ অবয়বে দেখেননি, দেখেছিলেন ধনুকের অবয়বে। ১ নং ধারায় পরিস্কার লেখাই আছে যে ‘স্বরূপ’ বা নিজ আকৃতি দেখেছিলেন! এখানে জিব্রাইল দেখা বা দ্বিতীয় মে’রাজ ইত্যাদি কল্পনা করা এবং তা আল্লাহর কোরানের ফুটনোটে লেখা ঘোর আপত্তিকর!
৭ম আসমানে অবস্থিত বরই গাছ! মটকীর মত বরই ফলে! কিন্তু খায় কারা! তার কোন সদুত্তর নেই!
হযরত মুহাম্মদ বালুময় খেজুরবহুল দেশের বাসিন্দা ছিলেন, প্রধানতঃ খেজুর খেতেন! সুতরাং খেজুর গাছ ছেড়ে বরই গাছ নূরে আচ্ছাদিত করার তাৎপর্য অস্পষ্ট! বরই গাছ আচ্ছাদিত থাকে বরই ফলে, আম গাছ জাম ফলে আচ্ছাদিত থাকে না, কল্পিত আল্লাহর নূরেও নয়! বরই গাছের সঙ্গে মে’রাজ, নূর, জিব্রাইল বা ধর্মের কোন সম্পর্ক আছে বলে প্রমান নেই! অতএব আয়াতগুলি নতুন করে একমাত্র কোরানের আলোতেই ব্যাখ্যা-অনুবাদ করা উচিৎ যে, সেখানে কি আকার ইঙ্গিত দিচ্ছে!
বালুরদেশ, ভূস্বর্গ, ডলারেরদেশ, নদীমাতৃকদেশ, পাহাড়ীদেশ, মাছ-ভাতেরদেশ, দারুচিনিরদেশ ইত্যাদির মতই 'সীমান্তবর্তি বরইরদেশ;' সহজ সরল ইংগিতপূর্ণ ঠায়-ঠিকানা খুবই সুশোভিত, সহজবোধ্যের জন্য আলোকিত বা নূর মন্ডিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
ঘ. ১ ও ৩ নং আয়াতে স্পষ্ট প্রমান মিলে যে, ব্যক্তিগণ ভিন্ন; ৪ নং আয়াতে অনুরূপ আর এক ব্যক্তির পরিচয় দেয়া হয়েছে। বলে রাখা ভালো যে, শরিয়ত ‘শবে মে’রাজ-১’সহ উপর-নীচে বর্ণিত আয়াতের বরাতে রাছুলের অন্তত ৩ বার মে’রাজ হওয়ার দাবি অনাআসেই করতে পারতো এবং উচিৎ ছিল; কিন্তু কেন করলো না! তা একান্তই ভাববার বিষয়!
আয়াতটির শুরুতেই অনুদিত আছে যে:
‘নিশ্চয়ই এই কোরান সন্মানিত বার্তাবাহকের বাণী।’
বাক্যে ব্যবহৃত ‘এই’ (হাজা) ও ‘কোরান’ (পাঠ্য) শব্দদ্বয়ের অস্তিত্ত্ব নেই, এমনকি ‘সন্মানিত’ শব্দটিও নেই; ব্যবহৃত সর্বনাম ‘হু’র অনুবাদ করা হয়েছে ‘এই কোরান;’ কিন্তু কওল, কালা, কেরাত, একরা থেকেই ‘কোরান’ শব্দের উৎপত্তি, অর্থ বলা, পড়া, আবৃতি, পাঠ্য বা বাণী ইত্যাদি। এতদ্বর্থে আয়াতে ‘কওল’ শব্দটিই স্বয়ং উল্লেখ থাকতে ‘এই কোরান’ (মূল আয়াতে নেই) শব্দদ্বয় টেনে আনার কোনই হেতু নেই। ‘হু’ অর্থ তার, ইহা ‘গায়েবুন’ (থার্ড পারসন) বা নাম পুরুষ, অর্থাৎ অনুপস্থিত ব্যক্তি/বস্তু এবং সম্বন্ধবাচক সর্বনাম; সুতরাং ‘হু’ নাম পুরুষকে মধ্যম পুরুষ অর্থাৎ উপস্থিত ‘এই কোরান’ অনুবাদ কেবল অসঙ্গতই নয় বরং বিভ্রান্তকর। উপরন্তু ‘রাছুল’ বলতেই যে একমাত্র ‘মোহাম্মদ রাছুল’ তা’ও সঙ্গত নয়।
পুনশ্চুঃ
ইন্না হু লাকাউলু রাছুলিহীল কারীম; শব্দার্থ: ইন্না=অবশ্যই, হু=তার; কওল= বাণী; রাছুল=বার্তাবাহক; করিম= দাতা।
অতএব প্রচলিত মতেই অর্থ হওয়া উচিৎ ছিল: ‘অবশ্যই ইহা দয়ালু রাছুলের/ বার্তাবাহকের বাণী।’ কিন্তু শরিয়ত যেহেতু ‘রাছুলের বাণী’ বলে আলাদা লক্ষ লক্ষ হাদিছ রচনা করে কোরানকে রাছুল থেকে ভিন্ন করে রেখেছে, সেহেতু উল্লিখিত অনুবাদটি গ্রহণের যুক্তি/সাহস পায়নি, আর এজন্যই অহেতুক ‘এই কোরান’ বাক্যটি জুড়ে দিয়েছে।
‘রাছুল’ শব্দের সূক্ষ্ম অর্থ প্রেরণাপ্রাপ্ত, বার্তাবাহক নয়। বার্তাবাহক হলেন স্বয়ং যিনি শুণ্যে/সামনে ধনুকের ব্যাসার্ধে প্রকাশ হয়ে খবরাখবর বহন করেছেন, তিনি জ্যোতি বা নূরদেহ, যাকে কাল্পনিক জিব্রাইল বলা হয় (স্ব স্ব দেহে স্ব স্ব আকৃতিতে বিরাজমান)। এই বার্তাবাহক (জ্যোতিদেহ) যেখানে খবর পৌঁছান তা হলো চিঠির বাক্স, প্রাপক অথবা রেকর্ড, সিডি, ক্যাছেট বা কম্পিউটার অর্থাত দেহটি; ইহা জ্যোতিদেহের খবরের রক্ষক ও অবিকল প্রকাশক; সেখানে রদ-বদল, সংযোগ-বিয়োগ করার কোনই ক্ষমতা নেই। সহজ কথায় নূরদেহের প্রেরণায় যিনি প্রেরণাপ্রাপ্ত হন তিনিই রাছুল-নবি; কেহ দাবি/প্রকাশ করুক বা না করুক। কারণ প্রকাশ করা/না করা তাদের ইচ্চাধীন নয় (১৪: ১১; ৪০: ৭৮)।
সুতরাং আয়াতটির মূলার্থ হওয়া উচিৎ:
‘অবশ্যই তার (জ্যোতিদেহের) প্রদত্ত্ব (দাতা/বাহিত) বাণীই প্রেরণাপ্রাপ্তের (রাছুলের বাণী)।’
১ ও ৩ নং ধারায় বর্ণিত ব্যক্তিগণের মত ইনিও তাঁকে (নূরদেহকে) দর্শন করেছেন; তিনিও বিশ্বস্থ, পাগল নন; তার বাণী শয়তাণের বাণী নয়, অথচ তোমরা এমন লোকদেরকে গ্রহণ না করে কেন অন্য পথে চলছো!
প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে (হৃদয়ে) এই জ্যোতিদেহ আছেন (দ্র: ৮: ২৪; ২৪: ৩৫)। মানুষ তার নিরলস নামাজ বা ধ্যান-সাধনায় চাইলেই তিনি (নূরদেহ) দর্শন দেন, বাণী দেন; এতে সংশয়, সন্দেহ করার কিছু নেই; কারণ ‘অজানা (অদৃশ্য) জ্ঞান দানে তিনি মোটেই কৃপণ নন (৪ নং ধারা) যে, চাইলেও তিনি আর কাকেও কখনও দর্শন দেন না বা দেবেন না। সুতরাং ৩টি ছুরায় অনুরূপ ৪টি ইঙ্গিত বা পরিচয় একজনের নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির।
ঙ. অন্য আর একজনের ইঙ্গিত দেয়া আছে বর্ণিত ৫ নং ধারায়। সেখানেও অনুরূপ সাক্ষি দেয়া হয়েছে যে, তিনিও নূর দেহপ্রাপ্ত; তিনি কবি, গণক নন; নিজে যদি কিছু রচনা করতেন,তবে তার ঘাড়ের শিরা কেটে দিতেন।
উপরন্তু পুনঃ স্মরণীয় যে:
৪ নং ধারায় সর্ব সাধারণের অবগতির জন্য ঘোষনা দেয়া হয়েছে যে, তিনি `কৃপণ নন এবং সহজ-সরল পথে যারাই চলতে চায় তারাই তার দেখা পায়।' ঘোষনাটি নিম্ন বর্ণিত আয়াতে পুনঃ নিশ্চিৎ করা হয়েছে:
অ মা কানা- হাকিম। [ ২৪: ৩৫; ৪২: ৫২] অর্থ: -আমি ইহাকে করেছি জ্যোতি যা দ্বারা আমি আমার বান্দাগিগের মধ্যে যাকে ইচ্ছা ঐ জ্যোতির পথ-নির্দেশ করি-।
সুতরাং জনসাধারণের উচিৎ কথিত এবং স্বঘোষিত নেতা, ইমাম আল্লামা, শায়েখ বা দল-উপদলকে অন্ধ অনুসরণ না করে স্ব স্ব জ্যোতিদেহ আবিস্কারে রত হওয়া এবং অনুরূপ জ্যোতিদেহধারীদের হন্যে হয়ে খুঁজে বের করে সমাজের সকল দায় দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্বস্থতার সহিত তাদের বাধ্য হয়ে থাকা। এমন কম-বেশি জ্ঞান প্রাপ্ত লোক সব জাতির মধে এবং সবসময়ই থাকেন। নিরপেক্ষ, নিঃস্বার্থ, সহজ-সরল লোকদের পক্ষে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন নয়। (শেষ পর্ব)
বিনীত।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১:৪১