প্রায় চার দশক মোটামুটি সততার সাথে দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা সরকারী চাকরী করে রশিদ সাহেব যেদিন অবসরে গেলেন, বাড়ি ফিরে মনে হলো জীবনের, শরীরের কি একটা কিছু তিনি চিরতরে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন। সেই শূন্যতার হাহাকারে তিনি ঘুমাতে পারলেন না, ঠিকমতো খেতে পারলেন না, প্রায় চাকরীর বয়েসী সংসারের স্ত্রীর সাথে বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ আচরণ করলেন এবং কি করবেন সেটা বুঝতে না পেরে আরো বেশি খটমট হয়ে রইলেন। ‘এত বছরের চাকরী, কত লোকের সাথে উঠাবসা! সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এভাবে ঘরবন্দী হয়ে থাকাটা কি সহজ কাজ!’ তার স্ত্রী মোরশেদা বেগম তাই ব্যাপারটাকে সহজভাবেই নিলেন।
রশিদ সাহেবের সাথে বিয়ে না হলে মোরশেদা বেগমের ভাগ্যে কি ঘটতো তা বলা যায়না, তবে রশিদ সাহেবের জীবনের চাকা ঘুরে তাকে যে কোন দুর্দশাগ্রস্ত প্রান্তে নিয়ে যেতো তা সহজেই অনুমেয়। বিয়ের চার বছরের মাথায় তিনখানা সন্তান নিয়ে রশীদ সাহেব বুঝলেন তিনি ভয়াবহ ভুল করেছেন। মোরশেদা স্বামীকে বললেন, সন্তান আল্লার দান সুতরাং ভুল হয় নাই, কিন্তু আল্লার দান আর নেয়া যাবে না। রশীদ সাহেব উৎপাদন করে যেন ভুলে গেলেন যে এদের বাজারজাত করতে হবে। এদের মানুষ করার ভারটা মোরশেদা তাই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। রশীদ সাহেব এমনভাবে অফিস করতে লাগলেন যেন মাসশেষে বেতনটা স্ত্রীর হাতে দেয়া ছাড়া তার আর কোন দায়িত্ব নাই। স্ত্রীর ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য, ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, পথ্য কোনকিছু নিয়েই তিনি ভাবলেন না। মোরশেদা কোন অভিযোগ করলেন না, সংসার চালালেন এবং ছেলেমেয়েদের মানুষ করলেন। বড় মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে স্বামীর সাথে এখন লন্ডনে। সিটিজেনশীপ পেয়ে গেছে, চাকরীও করছে। তারপরের ছেলেটি বুয়েট থেকে পাশ করে আমেরিকায় পিএইচডি করে চাকরী করছে, গ্রীনকার্ড হয়ে গেছে। ছোটটিও সেখানে। ও মাস্টার্স করে চাকরীতে ঢুকে গেছে। দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়িয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াটাকে মোরশেদা ‘মানুষ’ করা ভাবলেও, ছেলেমেয়েগুলোকে এভাবে রপ্তানী করে দেয়াটা রশীদ সাহেবের ঠিক পছন্দ হয়নি। কিন্তু বরাবরের মতোই তিনি কিছু বললেন না, মতামত জানালেন না। বরঞ্চ কিছুই করতে হলোনা অথচ ছেলেমেয়েগুলো ‘মানুষ’ হয়ে গেলো এটা ভেবে যেন একটু তৃপ্তিই পেলেন।
সংসার-উদাসীন রশীদ সাহেবের সাথে দ্বিতীয় শ্রেনীর সরকারী পদধারী রশীদ সাহেবের কোন মিলই ছিলোনা। অফিসে তিনি দক্ষতার সাথে কাজ করতেন, তার কড়া নজর এড়ানোর উপায় ছিলোনা অধীনস্থদের। সেখানে তার সুনামের কমতি ছিলোনা, ডাকলেই ছুটে আসার লোকের অভাব ছিলোনা। সেই রশীদ সাহেবের তাই অবসরে এসে মনে হলো তিনি নাই হয়ে গেছেন।
মোরশেদার বিদ্যার দৌড় সপ্তম শ্রেণী পার না হলেও বুদ্ধির দৌড় যথেষ্ট বেশিই ছিলো। তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন, সময় সময় হুমায়ুন-শরৎ উলটে দেখতেন এবং কথোপকথনে দু’একটা ইংরেজী শব্দও যথাস্থানে প্রয়োগ করতে পারতেন। স্বামীকে বললেন, ‘এভাবে শুয়ে বসে থাকলে তো একেবারে পড়ে যাবে। কিছু একটা করে ব্যস্ত থাকো ’
‘কি করবো ?’
‘নিয়ম করে সকাল বিকাল হাঁটতে পারো, বই পড়তে পারো, বাগান করতে পারো.........অন্য কোন হবি থাকলে করতে পারো। মানুষ আজকাল কত কি করে সময় কাটায়!’
রশীদ সাহেব পাশ ফিরে শুয়ে রইলেন, জবাবে দিলেন না। মোরশেদা কিছুক্ষণ একা একা বকবক করে ঘুমিয়ে পড়লেন।
শুয়ে শুয়ে রশীদ সাহেব ‘সময় কাটানোর’ উপায় খুঁজতে লাগলেন। বিকেলে হাঁটা যায় কিন্তু তাতে সময় কাটবে না.........আর, বই পড়া, বাগান করা এসব তাকে দিয়ে হবে না। তাহলে কি করা যায়! অনেকক্ষণ ভাবলেন তিনি। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনে তার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো থেকে কোন একটা বেছে নেবেন। সেটা বের করতে গিয়ে বিবাহিত বা চাকরী জীবন নয়, তিনি চলে গেলেন শৈশবে। তার ঘুড়ি উড়ানোর শখ ছিলো। একবার মা’র নতুন কাপড় কেটে ঘুড়ি বানিয়ে যে দক্ষিণা পেয়েছিলেন, সে শখ তার মিটে গিয়েছিলো। গলা ছেড়ে রফির মতো গানের শখ ছিলো। নরম দু’গালে নামাজী বাবার সজোর আদরে সেটাও উড়ে গিয়েছিলো। অবশ্য এগুলো এখন তাকে মানাবেও না। আর কি ছিলো সেই রঙিন দিনগুলোতে? বায়োস্কোপ, মিঠাইওয়ালা, শন পাপড়িওয়ালা.........তারপর...তারপর হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো সেই জ্যোতিষীর কথা, প্রতি চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় একধারে বসে যে হাত দেখে মানুষের ভূত-ভবিষ্যত বলে দিতো। রশীদ সাহেবের খুব ইচ্ছে ছিলো বড় হয়ে তিনি জ্যোতিষী হবেন। হওয়া তো দূরের কথা, সে কথা কোনদিন কাউকে বলতেও পারেন নি। তিনি তাই স্থির করলেন, হস্তরেখাবিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করবেন – জ্যোতিষী হওয়ার জন্য নয়, কেবল কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য, একটা না-মিটা সাধ পূরণের জন্য।
পরদিনই বাজার ঘুরে তিনি হস্তরেখা বিষয়ক দু’খানা বই কিনে আনলেন। স্বামীর এই করতল-রেখা প্রীতি মোরশেদার খুব একটা পছন্দ হলোনা, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। ‘ক্ষতি কি! কিছু একটা নিয়ে থাকুক না বিজি।’ রশীদ সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে হস্তরেখা অধ্যয়ন করতে লাগলেন। জীবন রেখা, স্বাস্থ্য রেখা, হৃদয় রেখা, ভাগ্য রেখা ইত্যাদি পড়ে তিনি ব্যাপারটায় বেশ উৎসাহ পেলেন। নিজের হাতের সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। বাহ্, সবই তো মিলে যাচ্ছে! এই বিদ্যা আগে না জানার জন্য বিশেষ আফসোস হতে লাগলো তার। মোরশেদা রাতের খাওয়ার জন্য ডাকায় রশীদ সাহেবের নব জ্ঞানার্জনে সাময়িক বিরতি পড়লো।
খাওয়ার পর তিনি আবার হাত এবং বই নিয়ে বসলেন। যেন নিজেকে জানবার, নিশ্চিত হবার নেশা ধরে গেছে। বইয়ের সাথে মিলিয়ে এবার বিবাহ রেখা বিশ্লেষণ করতে লাগলেন। রেখাটা স্পষ্ট এবং ভারী – সন্দেহ নেই উৎপাতহীণ একটা বিবাহিত জীবন তিনি কাটিয়েছেন, যদিও সুখী কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না। একটু ভেবে শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে চেয়ে উপসংহার টানলেন যে, এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারতো! সুতরাং, বইয়ের কথামতো তিনি সুখী এবং এটা ঠিকই আছে। কিন্তু ভয়াবহ গোলটা তারপরেই বাধলো। শুক্র পর্বতের নিচের জায়গাটা বেশ উঁচু এবং পাশে কেবল একটা পাতলা ও হালকা সন্তান রেখা। সে হিসেবে তার একটাই সন্তান হবার কথা এবং সেটা কন্যা সন্তান। তাহলে ছেলে দুটি কোত্থেকে আসলো! রশীদ সাহেব সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না, ছটফট করতে লাগলেন। একবার ভাবলেন মোরশেদাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু কিভাবে বলবেন তার উপায় খুঁজে পেলেননা। নানান কথা মাথায় আসতে লাগলো – ছেলে দুটো তার রঙ পায় নি, মেয়েটা পেয়েছে; ছেলে দুটো তার তেমন খবর নেয় না, মেয়েটা নেয়। তবে কি আসলেই? কে হতে পারে ওদের বাবা! অনেক ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে পারলেন না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মোরশেদা দেখলেন রশীদ সাহেব উঠানে পায়চারী করছেন। একটু আর্শ্চযই হলেন।
‘কি ব্যাপার, রাতে ঘুমাও নি!’ রশীদ সাহেব জবাব দিলেন না। থমথমে মুখে মাথা নিচু করে উঠানের এদিক থেকে ওদিকে আগের মতোই হাঁটতে লাগলেন। নাস্তা তৈরি করে মোরশেদা যখন স্বামীকে ডাকতে এলেন তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রশীদ সাহেব বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলেন। তিনি বাজারে গেলেন না। বাজারের আগেই তার বোন রহমতি বেগমের বাড়ি। এই বোনটি সবার ছোট। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর রশীদ সাহেবই এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, বয়স হলে বিয়ে দিয়েছিলেন। তার মনে হলো মোরশেদার কোন গোপন কথা থাকলে রহমতি অবশ্যই জানবে। ভাবীর সাথেই সে সারাদিন থাকতো। মোরশেদার ছেলেমেয়ে ‘মানুষ’ করার পেছনে রহমতির একটা বড় ভূমিকা আছে।
‘এইটা কি বললেন ভাইজান, এইরকম একটা কথা আপনে ভাবতে পারলেন কিভাবে?’ ভাইয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো রহমতি।
‘হাতের রেখা কি আমারে মিথ্যা কথা বলছে? সব মিইলা গেলো, খালি এটাই মিললোনা। এর ব্যাখ্যা কি?’
‘ব্যাখ্যা আমি জানিনা। কিন্তু আপনি জীবনে দেখছেন ভাবীরে পুরুষ মানুষের সাথে পর্দা ছাড়া কথা বলতে?’
‘আমি কেমনে জানবো! সকাল বেলা অফিস গেছি, সন্ধ্যায় ফিরছি’
‘ভাইজান, আপনের মাথার মধ্যে এইটা ঢুইকা গেছে, বার হইবো না। কিন্তু আমি আপনেরে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, ভাবীরে সন্দেহ করার মতো কিছু করতে কোনদিন দেখি নাই। ’
খেয়ে আসেননি শুনে রহমতি নাস্তার করার জন্য সাধাসাধি করলো। রশীদ সাহেব খেলেন না। তিনি বাজারে গেলেন, হোটেলে নাস্তা করলেন, বাজার ঘুরে দেখলেন, তারপর আর কিছু দেখার না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে তার সন্দেহের কথা বাড়ি পৌঁছলো তার অনেক আগেই। রশীদ সাহেব বের হওয়ার সাথে সাথে রহমতি মাতৃতুল্যা ভাবীকে মোবাইল করে বিস্তারিত জানিয়ে দিলো। মোরশেদা সব শুনে হতবাক হয়ে রইলেন। তার এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব এই দুই হাতে লেখা ছিলো! হাত দুটো মেলে ধরে চেয়ে রইলেন তিনি অনেকক্ষণ।
স্বামী ফিরে এলে মোরশেদা কিছু বললেন না। রশীদ সাহেব কাপড় ছেড়ে খাটের উপর চুপ করে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে মোরশেদাকে ঘরে ঢুকতে দেখেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেননা।
‘কোন্ হাত দেখেছো তুমি ?’
‘বাঁ হাত’ হঠাৎ করা প্রশ্নে থতমত খেয়ে জবাব দিলেন।
‘এমন কি কোন কথা আছে যে বাঁ হাতই দেখতে হবে?’
‘না, সেটা নির্ভর করে......’ তার কথা শেষ করতে দিলেন না মোরশেদা।
‘তাহলে ডান হাত দেখো’ বলে স্বামীর ডান হাতটা ধরে, মুঠটা খুলে কোলের উপর মেলে ধরলেন। তারপর কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেলেন।
রশীদ সাহেব অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ডান হাতের দিকে তাকালেন। রেখাগুলো পড়তে লাগলেন এবং পড়তে পড়তে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। কারণ, রেখা বলছে তার পনেরো বছর বোনাস বাঁচা হয়ে গেছে, একটা বিয়ে করা হয়নি এবং এক হালি সন্তান এখনো পাইপলাইনে আছে।
৪ মার্চ, ২০১৫। ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৩:৩৪