somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাফল্যে মোড়ানো একটি বছর

১৯ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই লেখাটা লেখা হয়েছিল গত বছরের শেষান্তে । বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বছরের সাফল্য যাত্রাকে শব্দবন্দী করার প্রচেষ্টায় । একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছিল তখন ।
বহুদিন বাংলাদেশের খেলা নেই । প্রায় অর্ধ বছর পেরিয়ে গেল, সেই কবে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছিল বাংলাদেশ !
অনেকটা স্মৃতি রোমন্থনের মতো, এই লেখাটাকে আজ এখানে নিয়ে আসা ।




বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালী এক অধ্যায়ের সুবর্ণকাল যেন চলছে । গত এক বছরে বিশ্বের চার-চারটি ক্রিকেট পরাশক্তিকে ভূপাতিত করেছে বাংলাদেশ । নাক উঁচু ব্রিটিশদের বিদায় করে ছেড়েছে বিশ্বমঞ্চ থেকে । দক্ষিন আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানকে দেশের মাটিতে তুলোধূনো করে সিরিজ জয়ও হয়েছে । পাঠক, আসুন না একটু ফিরে দেখি গত এক বছরের পথচলা !


আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা প্রায় তিন দশক কিংবা আড়াই যুগ ধরে । সময়টা অন্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর তুলনায় খুব একটা বেশী না হলেও, একদম কমও নয় । এই তিন দশকে আমাদেরর উন্নতিটা এসেছে ধাপে ধাপে, সংগ্রামের কঠিন-দুঃসহ পথ পাড়ি দিয়ে ।
একটা সময় ছিল, যখন বলা হতো- ‘আমরা পঞ্চাশ ওভার খেলিব’ । যেটা পরবর্তীতে রুপান্তরিত হয়ে ‘আমরা লড়াই করিব’ তে পরিণত হয়েছিল । তারও পরে হয়েছে, ‘আমরা হারার আগে হারব না’ । আর বিবর্তনের ধারা বেয়ে এখন বলা হয়, ‘আমরা জয়ের জন্য খেলব’ । কি অবাক হচ্ছেন ! দম্ভোক্তি মনে হচ্ছে ! অবিশ্বাস্য লাগছে ! না পাঠক, বিশ্বাস রাখতে পারেন । তার চেয়েও বড় কথা, এই বাক্য এখন কেবলমাত্র বলার জন্য বলা তে আটকে নেই । বরং সামর্থ্য ও শক্তিমত্তা বিবেচনায় কঠিন সত্য বলেই মেনে নিতে হয় ।
সাফল্যে মোড়ানো একটি ওভার, একটি ইনিংস, একটি ম্যাচ, একটি সিরিজ কিংবা একটি মাসের সময়গুলো পেরিয়ে, বাংলাদেশ আগাগোড়া সাফল্য দিয়ে মুড়িয়ে ফেলেছে গোটা একটি বছরকেই । এই ২০১৫ টা তাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বাঁধাই করে রাখার মতো একটি বছরে পরিণত হয়েছে ।
তা কেমন ছিল এই ২০১৫, পুরো একটি বছরের পথচলা ! প্রিয় পাঠক, আসুন না সাফল্যের সেই অসাধারণ-অমুছনীয় স্মৃতিগুলো আরেকটু রোমন্থন করি । সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে তো ভাললাগারই কথা ।


বিশ্বমঞ্চে বছর শুরু :

লক্ষ-কোটি আবেগী জনতার বিশাল প্রত্যশাকে সঙ্গী করে মাশরাফিরা গেলেন, তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রলিয়া-নিউজিল্যান্ডে, বিশ্বকাপের একাদশ আসরে অংশ নিতে । প্রাথমিক লক্ষ্য, ভালো খেলা । তারপরের লক্ষ্য ‘সেরা অষ্টক’ এ নিজেদের অবস্থান করে নেয়া ।
বিশ্বকাপ-পূর্ব আন-অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে, ক্লাব পর্যায়ের দলের কাছে বাংলাদেশের পরাজয়, সমর্থকদের আশার ফানুসে বিশাল ফুটো সৃষ্টি করলেও, তাতে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন বিবর্ণ হয়নি একটুও । অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচেও দলের পরাজয়ের ধারা অব্যহত থাকলে, কিছুটা ভড়কে যায় দেশের ক্রিকেট পাগল জনতা । তবে তা ওই ‘ভড়কে’ যাওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল । আশার পালে বড় ধরণের কোন আঘাত দিতে পারেনি ।
সমর্থকদের প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে একটুও দেরী করেননি মাশরাফিরা । প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে ব্যাটে-বলে উড়িয়ে দিয়ে শুভ সূচনা করতে সমর্থ হয়, লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা । দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভালবাসার জবাব দিতে, আফগানিস্তান-বধের পর ক্যানবারের মানুকা ওভাল মাঠে ‘ল্যাপ অব অনার’ দেয়, মুশফিক-সাকিবরা । বিশ্বকাপ-স্বপ্নের রঙ উজ্জলতর হয়ে ধরা দেয়, আমাদের কাছে ।
বাংলাদেশ নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয়, দ্বীপ দেশ শ্রীলংকার । এই ম্যাচে বাংলাদেশের জঘন্য পারফর্ম্যান্স, আহত করে এই অঞ্চলের ক্রিকেট-আসক্ত জনগোষ্ঠীকে । ছন্নছাড়া বোলিং, দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং আর চূড়ান্ত মাত্রার বাজে ফিল্ডিং, ভীষণ আশাহত করে তোলে বাংলাদেশের সমর্থকদের ।

ঘূর্ণিঝড় বাঁধায় পন্ড হয় বাংলাদেশ-অস্ট্রলিয়া ম্যাচ । পরিত্যক্ত ম্যাচের এক পয়েন্ট প্রাপ্তি থেকেও মাশরাফিদের জন্য বেশী আক্ষেপের ছিল, ব্রিসবেনের গ্যাবার সবুজ চত্ত্বরে খেলার আজন্ম-লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু ! তিন ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট অর্জন করে, বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামে । সেই ম্যাচে তিন শতাধিক রান তাড়ার ইতিহাস রচনা করে, কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার লক্ষ্যের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহা গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে, মার্চের নয় তারিখ এডিলেইড ওভালে, বাংলাদেশ খেলতে নামে ‘ক্রিকেটের জনক’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে । প্রথমে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশকে শুরুতেই ভড়কে দেন ইংল্যান্ডের দ্রুতগতির বোলাররা । শুরুর ধাক্কা সামলে, বাংলাদেশকে একটা লড়াকু সংগ্রহে পৌছে দিতে, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ তাঁর ব্যাটটাকে ‘চওড়া’ করে তুলেন, দৃঢ় সংকল্প চোখে এঁকে । প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে, বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহ শতক পেলে, বাংলাদেশ পেয়ে যায় পৌনে তিনশ রানের দারুণ সংগ্রহ ।
পরে দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের সাথে দুরন্ত বোলিংয়ের যুগলবন্দী ঘটলে, এক সময়ের ‘ঔপনিবেশিক’ ইংরেজরা আটকে যায়, বাংলাদেশের রান থেকে ‘পনের’ দৌড় দূরে । শেষ দিকে রুবেলের অবিশ্বাস্য সেই ইয়র্কার, অনবদ্য দুটি বল, হয়তো আজও চোখে ভাসে অনেকের । অনেকের কানেই হয়তো আজও বেজে উঠে, ব্রিটিশ ধারাভাষ্যকারের সেই অভুলনীয় ধারা বিবরণী- “বাংলাদেশ টাইগার্স হ্যাভ নকড দ্যা ইংলিশ লায়ন্স আউট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কাপ” । তারপরই এডিলেইড ওভালের গ্যালারী হয়ে যায় যেন একখন্ড ‘মিরপুর কিংবা সাগরিকা’ । আবেগী বাংলাদেশীরা সুযোগ পায়, আবেগটাকে আরো একবার উর্ধ্বে তুলে ধরার ! বাংলাদেশ দলের ‘ক্যাপ্টেন কিং’ মাশরাফি বিন মর্তুজা সেই আবেগী জনতার মধ্যে, প্রথম সারির একজনই ছিলেন । ইংল্যান্ড-বিজয়ের পর তাঁর মাঠেই শুয়ে পড়া, এবং তাঁর উপর গোটা বাংলাদেশ দলটার ঝাঁপিয়ে পড়া, ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়েছে আবেগের অনন্য-অসাধারণ এক ছবি ।
নাক উঁচু ব্রিটিশদের পরাজিত করার মধ্য দিয়েই, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো উঠে যায় স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে ।



ইংল্যান্ড-বধ এর ধারা অব্যহত রেখে, গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে, নিউজিল্যান্ডের সাথেও বাংলাদেশ উপহার দেয় নান্দনিক ক্রিকেট । শেষ আট আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়, লাগামছাড়া ক্রিকেট-সৌন্দর্য্যে মেতে উঠে মাশরাফির অনুপস্থিতিতে সাকিবের নেতৃত্বে মাঠে নামা বাংলাদেশ । মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ করেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরী । অপ্রতিরোধ্য কিউইদের কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা লাল-সবুজ জার্সিধারীরা । শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হারলেও, বাংলাদেশ জিতে নেয় কোটি ক্রিকেট-রসিকদের মনোজগত ।

কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয়, দেশাত্নবোধের আবেগে কাঁপতে থাকা বাংলাদেশ । সেই ম্যাচে বাংলাদেশ অতটা ভালো না-খেললেও, ক্রিকেট-বিশ্ব চাক্ষুষ করে পক্ষপাতের নির্লজ্জ এক খেলা । খেলাটার চিরন্তন সৌন্দর্য্যকে চূড়ান্ত মাত্রায় অপদস্থ করে, মেলবোর্নে মঞ্চস্থ হয় জঘণ্য প্রতারণা ও প্রবঞ্চণার ঘৃণ্য উদাহারণ । বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটাসক্ত জনতার আবেগের সাথে, কৃত অন্যায় বাংলাদেশ তো মেনে নেয়-ই নি । বিশ্ব ক্রিকেট পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে । বিশ্বের অনেক রথী-মহারথীর সাথে সুর মিলিয়ে ভারতের অনেক ক্রিকেট-বোদ্ধাও মেতে উঠেন, বাংলাদেশের সাথে অন্যায্য আচরণের বলিষ্ঠ প্রতিবাদে ।
বলা হয়, সেই ম্যাচে কমপক্ষে তিন-তিনটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিয়েছে... ।
রুবেলের ফুলটস বলে রোহিত শর্মা আউট হলে ‘নো বল’ কল করা !
মাশরাফির বলে সুরেশ রায়নাকে সরাসরি এলবি না দেয়া !
ইনফর্ম মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ হুক করলে বাউন্ডারিতে ধাওয়ান ক্যাচ ধরে, তখন প্রশ্ন উঠে তাঁর পা সীমানা-দড়িতে লেগেছিল কি না !

আইসিসি, মোড়ল-সর্দার ভারত ও আম্পায়ারদের তুমুল সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে পুরো ক্রিকেটাঙ্গন । বিশ্বকাপ জুড়ে সেই সমালোচনার ঝড় তো ছিলই, এখনো মাঝে মধ্যেই আসর গরম হয়ে উঠে ১৯শে মার্চের সেই ঘৃণ্য আচরণের নিন্দা-আলোচনায় ।

বীরদর্পে স্বদেশে ফিরে আসে মাশরাফি ও তাঁর দল । নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম বিশ্বকাপ শেষ করে, স্বাধীনতার মাসে স্বদেশের মানুষদের এক অন্যরকম ক্রিকেট উন্মাদনায় উদ্বেলিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ।

বিশ্বমঞ্চে অসাধারণ সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শুরু করে স্বর্ণালী অধ্যায়ের প্রথম ধাপ । তখন কে জানতো, সারা বছরই এমন অসাধারণ সাফল্যের মধ্য দিয়েই যাবে এই বাংলাদেশ !

পাকিস্তান এলো, ষোল বছরের ফাঁড়া কাটলো :
নিয়তির এ এক অদ্ভুত খেল ! টেস্ট মর্যাদা-লাভের পর কত দেশকেই তো ভূপাতিত করল, বাংলাদেশ । অথচ টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের ভিত গড়ে দেয়া সেই ঐতিহাসিক পাকিস্তান-বধ এর পর, পাকিস্তানকে কি না আর হারানোই গেল না, দেড় দশক ধরে ! চোখ কপালে উঠার মতোই ব্যাপার ।
অবশেষে সেই পাকিস্তানকেও হারালো বাংলাদেশ । প্রায় ষোল বছর পর । তাও আবার এক-দুই ম্যাচ নয়, টানা চার চারটি ম্যাচ । তিনটি ওডিয়াই ও একটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে স্রেফ উড়ে গেল যেন পাকিস্তান ।
মাহমুদুল্লাহর বিশ্বকাপ-ফর্ম কিভাবে যেন হাত বদল হয়ে তামিমের কাছে চলে আসে । আর সেই উত্তুঙ্গ ফর্ম দিয়ে, তামিম পাকিস্তানি বোলারদের গুড়িয়ে দেন টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফর্মেটেই । ওয়ানডে সিরিজে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরীর সাথে তৃতীয় ম্যাচেও ফিফটি তুলে নেন তামিম ইকবাল । আর টেস্টে তো ইমরুল কায়েসের সাথে গড়েন রেকর্ড ৩১২ । নিজেও ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বি-শতক তুলে নেন ।
ওয়ানডে সিরিজে ধবল ধোলাইয়ের পর এক ম্যাচের টি-টুয়েন্টিতে পাকিস্তানকে গুড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ । দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ১-০ তে হারলেও দারুণ লড়াই করে মুশফিকের দল ।
বিশ্বকাপের চমৎকার সাফল্যের ধারা বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়েও অব্যহত রাখে বাংলাদেশ ।

এবার সময় প্রতিশোধের :
এক টেস্ট ও তিন ওয়ানডের সংক্ষিপ্ত এক সফরে বাংলাদেশে আসে, প্রতিবেশী দেশ ভারত । বিশ্বকাপ-জ্বালা তখনও জ্বলজ্বল করছে, প্রতিটি বাংলাদেশীর বুকে । চারদিক থেকে রব উঠে, ‘প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ’ । জোচ্চুরির প্রতিশোধ, অন্যায়ের প্রতিশোধ, নির্লজ্জ-পক্ষপাতের প্রতিশোধ ।
খেলোয়াড়রাও সেই প্রতিশোধ-অনলে পুড়ছিলেন কি না, কে জানে ! তবে প্রথম ম্যাচে সৌম্য-তামিম যেভাবে ছিঁড়ে-খুড়ে শেষ করে দিতে চাইলেন ভারতীয় বোলারদের, তাতে তাদের জ্বুলুনিটা বেশ বোঝা গেল । আগ্রাসী ক্রিকেটের অনন্য প্রদর্শনে বাংলাদেশ ভারতকে প্রথম ম্যাচেই গুড়িয়ে দেয়, ব্যাটে-বলে সমানতালে । মুস্তাফিজুর রহমান নামের এক বিস্ময় বালকের অফ কাটারে কাটা পড়তে থাকে একের পর এক বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যান ।
টানা দুই ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে সিরিজ নিজেদের গড়ে নেয়, মাশরাফি বিন মর্তুজার বাংলাদেশ । সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে গেলে, ধবল ধোলাই থেকে কোনমতে রক্ষা পায় ধোনীর মহাভারত ।
ফিয়ারলেস ক্রিকেটের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর বলা হতে থাকে, এই অসাধারণ-অপরাজেয় বাংলাদেশকে ।
সিরিজের একমাত্র টেস্টের বেশীর ভাগ সময় বৃষ্টি মাঠে থাকায়, নিস্প্রাণ ড্রতেই পরিসমাপ্তি ঘটে টেস্টটির ।

যে সিরিজ নিল অগ্নি-পরীক্ষা :
বিশ্বকাপ পারফর্ম্যান্স ও এরপর পাকিস্তান-ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত ক্রিকেট উপহার দেয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ উঠে যায় অনন্য উচ্চতায় । তাই দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই অগ্নি পরীক্ষার । শক্তিমত্তায় বহুগুণে এগিয়ে থাকা দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ কেমন করে, সেটা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব ক্রিকেট ।
দুই ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজে দক্ষিন আফ্রিকার কাছে পাত্তাই পেল না, বাংলাদেশ । প্রশ্ন উঠল, বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে । ক্রিকেটাররা নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়লেন, নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে । সমর্থকরাও যেন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন, প্রিয় দলের অসহায় আত্নসমর্পণে ।
ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেও পুনরাবৃত্তি হলো, টি-টুয়েন্টি সিরিজের । কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রবলভাবে ফিরে আসল বাংলাদেশ । দক্ষিন আফ্রিকার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে, নিতান্ত ক্লাব-দলের মতো করে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ । একই ধারায় তৃতীয় ম্যাচেও দাপুটে জয় তুলে নিয়ে ওডিয়াই সিরিজ নিজেদের করে নেয়, ফিয়ারলেস ক্রিকেটের ধারক-বাহকরা । সৌম্যর লাগামহীন আগ্রাসনে উত্তাল হলো মিরপুর থেকে সাগরিকার গ্যালারি ।
পাকিস্তান, ভারতের পর দক্ষিন আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তিও পরাজিত হলো, বাংলাদেশের কাছে । বিশ্ব যেন শুনতে পেল এক নতুন ক্রিকেট-পরাশক্তির আগমনী গান ।
দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের আট দিনই বৃষ্টি নিজের করায়ত্বে রেখে দিলে, আর কি করার থাকে ! অনুমিতভাবেই ড্র জুটে টেস্ট দুটির ভাগ্যে । মুশফিকরা হারায়, আমলা-প্লেসিসদের বিপক্ষে সত্যিকারের ‘টেস্ট’ এ অংশ নেয়ার সুযোগ ।

অপেক্ষা, হতাশা ও আক্ষেপ :
অক্টবরে অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ । স্মিথের ‘নবীন’ অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে মুশফিকের অপেক্ষাকৃত ‘প্রবীণ’ বাংলাদেশের লড়াইটা দেখার জন্য, অপেক্ষায় ছিল এই দেশের ক্রিকেট-বুভুক্ষু জনগোষ্ঠী ।
সব অপেক্ষায় যেন হঠাৎ জল ঢেলে দেয়া হলো । নিরাপত্তাজনিত-কারণ দেখিয়ে সফর স্থগিত করে বসল, ক্রিকেট অস্ট্রলিয়া । চারদিকে যেন হাহাকার ও হতাশার বান ডেকে গেল । দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সর্বোচ্চ-মাত্রার নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হলেও, সেই আশ্বাসকে পায়ে ঠেলে সফরে আসল না অস্ট্রলিয়া ।
আক্ষেপ ও হতাশায় মুষড়ে পড়ল, এই অঞ্চলের খেলা-পাগল জনতা ।
অবশ্য অস্ট্রলিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরবর্তী কোন এক সময়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসবে । এবং নির্ধারিত সিরিজে অংশ নেবে ।

বছরান্তেও বহমান সাফল্যধারা :
অস্ট্রলিয়া সফর পেছানোয়, বিসিবি তড়িঘড়ি করে আমন্ত্রণ জানালো জিম্বাবুয়েকে । তিনটি ওয়ানডে ও দুটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচের সংক্ষিপ্ত এক সফরে আসতে । জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড সেই আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহন করে এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল আসে সপ্তাহ-দেড়েকের এক ছোট্ট সফরে ।
বছরের শুরুতে বিশ্বকাপে যে সাফল্য ধারার সূচনা হয়েছিল, বছরের শেষ দিকেও সেই সাফল্যধারা চলতে থাকে আপনগতিতে ।
তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই বিশাল ব্যবধানে জিম্বাবুয়েকে পরাজিত করে সিরিজ সূচনা করে বাংলাদেশ । দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচেও দাপটের সাথে জয় তুলে নিলে, ধবল ধোলাইয়ের শিকার হয় জিম্বাবুয়ে । একেক সময় একেক জনের হাত ধরে জয়ের কক্ষপথে হেঁটেছে বাংলাদেশ । তামিম, কায়েস, মুশফিক, আল আমিন, সাকিব, মাশরাফি, মুস্তাফিজ... পুরোটাই যেন সম্মিলিত দলগত শক্তির ফসল ।
টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচও জিতে নেয় বাংলাদেশ । তবে দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়ালার-মেদজিবার ব্যাট, বাংলাদেশকে জয়ের ধারায় ভাসার সুযোগ দেয়নি । দ্বিতীয় টি-টুয়েন্ট ম্যাচ হেরে ১-১ এ সিরিজ শেষ করে, মাশরাফির দল ।



শেষটা হয়তো মনমতো হয়নি । তবে বছরজুড়ে যে অসাধারণ সাফল্য উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ, তা কিভাবে ভুলে যাবে সমর্থকরা ! উদ্দাম-আগ্রাসনের সাথে কূশলী ক্রিকেটের যে যুগলবন্দী, তা হয়তো চিরস্থায়ী ছাপ বসিয়ে দিয়েছে অনেকের মনে । বড় বড় ক্রিকেটবোদ্ধারা তো বাংলাদেশকে এমনি এমনি বলেননি, “ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর অব ফিয়ারলেস ক্রিকেট” ! আক্ষরিক অর্থেই ভয়ডরহীন ক্রিকেটের চমৎকার বিজ্ঞাপণ ছিল এই বাংলাদেশ ।
এই বাংলাদেশকে ভুলে যাওয়া কঠিন । ভীষণ কঠিন । বাংলাদেশকে স্বর্ণালী সময় উপহার দেয়া এই ২০১৫ সালটাকেও ভুলে যাওয়া হয়তো কঠিন ! অভুলনীয় কিছু সুখের সময় যে উপহার দিয়েছে এই বছর । সাফল্য আর সুখস্মৃতিতে ভরিয়ে দিয়েছে যে এই ২০১৫ ।


আগামী দিনেও চলতে থাকুক সাফল্যের এই ধারা । অনাগত বছরগুলো ছাড়িয়ে যাক, এই বছরটাকেও ।
দীর্ঘজীবি হোক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যধারা । দীর্ঘজীবি হোক, এই ভয়ডরহীন ক্রিকেট । দীর্ঘজীবি হোক, এই লাগামছাড়া দৃষ্টিনন্দন আগ্রাসন ।


__________
__________
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×