আসুন আজ একটা জিনিস ভেবে দেখি । আরবের লোকগুলো প্রকৃতিগত কারণেই রুক্ষ-খটখটে, মায়া-দয়াহীন ছিল । সেই তাঁরা হঠাৎ অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্য এত দরদ অনুভব শুরু করেছিল কেন ? অসভ্য, বর্বর জাতিটা হঠাৎ এত সভ্যতা-ভব্যতা কোন জাদুবলে শিখে নিয়েছিল ? বলতে পারেন ?
প্রাক-ইসলাম যুগে, হযরত উমর (রাঃ) ও আবু জেহেলের মধ্যে কোন পার্থক্যই ছিল না । অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন, ইসলাম গ্রহনের পর একজন সোনার মানুষ হয়ে গেলেন আর অন্যজন সেই অসভ্য-বর্বরই রয়ে গেলেন । কিন্তু কেন ?
একবার কি হলো, পারস্যের মহা শক্তিধর সম্রাট খসরুর কাছে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একজন দূত পাঠালেন । সাথে একটা পত্র । সেই দূত যখন, সম্রাটকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন । তা সম্রাটের ‘ইগো’ তে লাগল । বুঝতেই পারছেন, অতবড় সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতির দেমাগ, ভাব-সাব ঠাঁট-বাঁট তো অন্য লেভেলের হবেই । তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমাদের এত্ত বড় স্পর্ধা ! তোমরা সম্রাট খসরুর দরবারে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে এসেছো ? তোমরা তো অত্যন্ত নীচু, মূর্খ, নির্বোধ প্রজাতির লোক ।’
আল্লাহর রাসূলের দূত কি এই কথায় রেগে গেলেন ? মোটেই না । বরং সহাস্য বলে উঠেন, ‘হ্যাঁ, আমরা অত্যন্ত নীচ ছিলাম, নির্বোধ-অজ্ঞ ছিলাম । অতঃপর আমাদের মাঝে একজন মহামানব, একজন মহানবী এলেন । তিনি আমাদের সত্যের সন্ধান দিলেন । আমরা উন্নত হয়ে উঠলাম ।’
লক্ষ্য করেন, কি বিনয় ! অকপটে সত্যকে কিভাবেই না মেনে নিলেন ! অন্ধকার অতীত কে অস্বীকারের কোন চেষ্টাই নেই, আবার উন্নত চিত্তের কি নিঃসংকোচ প্রকাশ ! ভাবা যায় !
পরশ পাথরের স্পর্শে যেমন সব সোনা হয়ে যেত । ঠিক তেমনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যেন ছিলেন ‘পরশ মানব’ । যার স্পর্শে অসভ্য, বর্বর, নীচ, বদ, পাষন্ড, অমানুষ, যুদ্ধবাজ, জুয়াড়ী, ফূর্তিবাজ, নারীবাজ, মাতাল, ভোগী... সব মানুষেরা হয়ে উঠলেন এক-একজন সোনার মানুষ । দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষ ।
তাই খলিফা আবু বকর (রাঃ) দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে পারেন, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সাঃ) হুকুমের সকল অবাধ্য লোককে অবনত করতে, আমি একা হলেও যুদ্ধ করে যাব ।” আহা, কি আনুগত্য !
সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হযরত উমর (রাঃ) খলীফা অবস্থায়, একজন রাজা আর ভৃত্যের মধ্যে বিচার করতে গিয়ে অনায়াসে বলে উঠেন, ‘তোমরা দু’জনেই মুসলমান এবং আল্লাহর চোখে দুজনেই সমান ।’ অর্ধ-বিশ্বের শাসনভার যার হাতে তিনি ছেলেকে একটা কাপড় কিনে দিতে পারেন না । বরং ছেলেকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় বলে উঠেন, ‘যাও বাবা, যা আছে তা পরেই বিদ্যালয়ে যাও । আমাদের তো আর অনেক টাকা-পয়সা নাই । আমি খলীফা হলেও ধন-সম্পদ তো সব জনসাধারণের !’ আহা, রাষ্ট্রনায়ক ! আহা, শাসক !
এই জন্যেই বুঝি, সেই ইন্টারনেট-মোবাইল, স্যাটেলাইট বিহীন যুগেও মরুর আরব থেকে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ জুড়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে । এইসব সোনার মানুষরা ছিলেন বলেই হয়তো, অর্ধ-বিশ্ব অধীনস্ত হতে তেমন সময়-ই লাগেনি ।
আহা, কি সব সোনার মানুষ ছিলেন তাঁরা ! যুদ্ধের ময়দানে ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়েও পানির পেয়ালা এগিয়ে দেন, আরেক ভাইয়ের দিকে । অবলীলায় মেনে নেন, সেনাপ্রধান থেকে সিপাহীর কাতারে নিজের অবনমন । রাজপ্রাসাদের জাঁকজমক, সুন্দরী ললনা, হাজার হাজার দিনার নিমিষেই পায়ে ঠেলেন । রাতের আঁধারে আল্লাহর ভয়ে যেন চোখে বসিয়ে দেন অবিরাম ঝর্ণাধারা !
আহা, কি সব মানুষ ! যেন সোনায় মোড়ানো এক-একটি চরিত্র, এক-একজনের জীবন !
উম্মাহর নক্ষত্ররাজি
Know Your Heroes