somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেলা যে যায়... : ০১

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছেলেবেলা থেকে এরকম একটা স্বপ্নই দেখে এসেছি সবসময়। অনেকগুলো বই থাকবে আর থাকবো আমি। আমাদের মাঝে সংসার, বাজার-সদাই, নিত্যকার হাজারো সমস্যার কিছুই থাকবে না। চাইলেই বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে পারবো ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ ‘ভাত খাও, মুড়ি খাও, এটা খাও সেটা খাও, এদিক যাও ওদিক যাও’ বলে ঘ্যান ঘ্যান করবে না। আরামসে বইয়ের সাথে কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনেকটা সময়। অথবা ইচ্ছে হলেই একমনে ভাবা যাবে, ধ্যানের জগতে ডুব মারা যাবে। কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না।

আমি এখন চাইলেই বইয়ের সাথে ঘুমাতে পারি, খেতে পারি, ভাবতে পারি। মাস-সাতেক ধরে গ্রামের বাড়িতে আছি। বিশাল একটা বইয়ের জগৎ গড়ে তুলেছি। খাওয়া নিয়ে কখনোই খুব বেশী ভাবনা ছিল না। ভ্রাতুষ্পুত্র আরিফ থাকায় সে ভাবনার প্রয়োজনও আর হয়নি এখানে। আরিফের বাবা ছিল আমার চাচাত ভাই, আবার ওর দাদা আর আমার বাবাও ছিল চাচাত ভাই। আমার দাদা আর ওর পরদাদাও নাকি তা-ই। প্রায় চার-পাঁচ পুরুষ পেছন গিয়ে হয়তো রক্তের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। শেকড়ের এই একগুণ। ছেড়ে না গেলে আপন-পর বিভেদের প্রশ্নই উঠে না। আরিফ আর আমার মধ্যে কত দূরের সম্পর্ক, অথচ শেকড়ের গুণে ওকে কত আপনই না মনে হয়!
আরিফের আড়াই বছরের ছেলেটা ‘দাদ্দাভাই’ বলে ছুটে ছুটে আসে। বড় ভালো লাগে। ওর বউটাও বড় মায়াবতী। খুব খেয়াল রাখে আমার। এই পড়ন্ত বেলায় বইয়ের সাথে ওদেরও পাওয়াতেই বোধহয় এখনও একঘেঁয়েমিতে পেয়ে বসেনি। অবশ্য ‘পড়ন্ত’ বেলা বলছি কেন? ষাট হতেও তো প্রায় পাঁচ বছর বাকী আমার! আমাদের দেশে যেখানে সত্তোরোর্ধ্ব, আশির্ধ্বোরা সংসদ সদস্য হন, মন্ত্রী হন। ওই বয়সেও নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখেন, কত রঙিন স্বপ্ন দেখান! সেখানে আমি তো এখনও নাদান বালক।

আমি এই নিরিবিলিতে খুব ভেবেছি। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। ওই বয়সে তাঁরা অত প্রাণশক্তি কোত্থেকে পান? আমার তো পঞ্চাশের কোটাতেই নিজেকে কেমন অথর্ব মনে হচ্ছিল, আর চাইছিলাম- যে ক’টা দিন বাঁচি যেন নিজের মতো করে বাঁচতে পারি। তাই স্বেচ্ছা-অবসরে যেতে একটুও খারাপ লাগেনি। ছেলেটা যখন শুনল, চাকরি ছেড়ে ওদের ছেড়ে গ্রামে চলে আসবো, ধুম করে পা চেপে ধরে বলে উঠেছিল, “আমি কি অন্যায় করছি বলেন আব্বা! কেন আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন?” অনেক কান্নাকাটি করেছিল। শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পেরেছে আর আটকানো যাবে না তখন বলেছিল, “ঠিক আছে আমিও চাকরি ছেড়ে দেবো। ক্ষেত-খামার করবো। মাছের চাষ করবো, পোল্ট্রি করবো। সবাই মিলেমিশে খুব আরামসে থাকবো।” কি করুণ মুখ করে বলছিল, তারপরও অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম আমি। মাথায় হাত বুলিয়ে, কোনোমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে ঠেকিয়েছিলাম তখন। তবে শুনেছি, সেও সময়ের অপেক্ষা করছে। হাল ছেড়ে দেয়নি এখনো। আদর্শ কৃষক হওয়ার ভাবনাটা নাকি তাকে ভালোই পেয়ে বসেছে। পাওয়ারই কথা। আম গাছে তো আর আমলকি হবে না। আমি এক আধ-পাগল বুড়ো, আমার ছেলে কি আর সুস্থ মানুষ হবে? শুধু ছেলে বঊটার জন্য মায়া হচ্ছে। বেচারী, কোন পাগলের খপ্পড়ে যে পড়ল! মনে হচ্ছে ছেলের পাগলামি আমার চেয়েও এক ডিগ্রী বেশী।

তবে ওর মনটা বড় ভালো। বোধহয় মায়ের কারণে হয়েছে। ছোট চাচী প্রায়ই বলতেন, “তুই জীবনে কি পূণ্য করেছিলি বাপ! এমন সোনার টুকরো বউ কীভাবে পেয়েছিস বলতো!” ছোট চাচী ছেলে বউদের কাছ থেকে খুব একটা সমাদর পাননি। শেষের বছর-দুই তো আমাদের কাছেই কাটিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ছেলেরা এসে খুব রাগারাগি করতো। ওদের মা নাকি ওদের ইজ্জত শেষ করে দিচ্ছে, মানুষের বাসায় থাকছে! শেষবার যখন এলো, বড় ছেলেটার গালে ঠাশ করে বসিয়ে দিয়েছিলাম থাপ্পড়। বোধহয় দাঁত দুটো নড়ে উঠেছিল। সর্বশক্তি দিয়ে মেরেছিলাম তো! সে আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোটো ছিল। এরপর থেকে বড়, মেঝো, ছোটো আর কেউ আসার সাহস পায়নি।

এই সাত মাসে মোবাইল, টিভি, কম্পিউটার সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন থেকেছি। কখনোই মনে হয়নি, ইশ যদি মোবাইলটা থাকত! আরিফের মোবাইলে ফোন করে ছেলের সাথে কথা বলি। ছেলের বউয়ের সাথে মাঝে মধ্যে গল্প করি খুব। মেয়েরাও ফোন করে। তবে ওদের সাথে কথা বলি না। মেয়েরা হচ্ছে মায়ার ডিপো একেকটা। ওদের সাথে কথা বললে ওদের এড়ানো মুশকিল হয়ে পড়বে! এই সময়টাতে আমি শুধু কবরের সাথেই নিবিড় সম্পর্কে যেতে চাই, ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনির সাথে আর নয়।

শুনেছি সপ্তাহ খানেক ধরে নাকি বড় মেয়ের বাসায় আছে ওদের মা। নিশ্চয় আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো ফন্দী আঁটছে ওরা। ওদের মা-কে তো আমি চিনি। ভয়ানক মহিলা। আমার সবকিছুতেই হ্যাঁ বলে এসেছে, কিন্তু খুব সুকৌশলে নিজের ইচ্ছেটা আমার দিয়ে করিয়ে নিয়েছে বরাবর। আমার বহু নারীতে আসক্তি ছিল। এদিক-সেদিক কত ঢুঁ মারতাম। ও বুঝত সব, কিন্তু কিচ্ছু বলত না। হঠাৎ আচমকা একদিন বলে বসে, “তোমার জন্য মেয়ে দেখেছি। মেয়ে ভালোই। তোমার পছন্দ হবে।” তাজ্জব হয়েছিলাম বলবো না, মনে হলো যেনো ইলেক্ট্রিক শক খেলাম। “মানে কী?”
আস্তে করে বলেছিল, “কি দরকার যেখানে-সেখানে যাওয়ার! বিয়ে করে নাও। দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার। আমি অনুমতি দিলাম। শর্ত শুধু সতীন সব আমিই পছন্দ করে দেবো।” আমতা আমতা করে সেই যে চুপ হলাম, ঢুঁ মারাও বন্ধ হয়ে গেল একদম।

এই যে গ্রামে চলে আসলাম। একগাদা বই নিয়ে আছি। ওর যেনো কিছু বলবার নেই। “যে যেভাবে ভালো থাকে সেভাবেই থাক।” খুব সহজ সাধারণ দর্শন যেনো তৈরী করে নিয়েছে। আমি নিশ্চিত জানি নিশ্চয় কিছু একটা করছে। নইলে এতদিনে সে এখানেই চলে আসত। ও ভালো করেই জানে, বই ছাড়া যদি আর কিছুর দরকার হয় তবে সেটা আমার ওকেই দরকার। ছেলের সাথে যদিও মাঝে মাঝে এসেছে। যেনো বেড়াতে এসেছে এমন ভাব করেই চলে গেছে। আমিও কোনো সাধাসাধিতে যাইনি। “যে যেভাবে ভালো থাকে সেভাবেই থাক।” আমিও এই সাধারণ দর্শন মেনে নিয়েছি। খারাপ কি, ভালোই তো চলে যাচ্ছে। নামাযের সময় হলে মসজিদে যাচ্ছি, খাওয়ার সময় হলে আরিফ ডেকে নিচ্ছে, আর বাকীটা সময় আমার মতো করেই কেটে যাচ্ছে। কখনো বই পড়ছি, কখনো ভাবছি আবার কখনো ডায়রী উলটে পাতা-দু’পাতা লিখছি, এই তো চলে যাচ্ছে।

আমি ভাবছি, খুব ভাবছি। এই জীবন নিয়ে নয়, পরবর্তী জীবন নিয়ে। এই জীবনের সব লেনাদেনা আমি চুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। এখন পরের যে জীবন আছে সেটার লেনাদেনা চুকানো নিয়েই আমি বেশী আগ্রহী। আব্বা-আম্মার কবরের কাছে গিয়ে মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়াই, কি অবস্থায় আছেন তাঁরা?
গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো হাঁটা থামিয়ে দিই, ঠিক এই পথ দিয়েই কি আমার দাদা-পরদাদারা এভাবে হেঁটে গেছেন? কোনো কোনো বিশাল বটবৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করি, গাছটা কোন আমলের? দাদার নাকি পরদাদার? নাকি তারও আগের?
হাঁটি, ভাবি, পড়ি যা-ই করি, আমার মতো করেই সময়গুলো কাটাতে পারছি। এটাই যেনো কত তৃপ্তির! কোনো উপদ্রব নেই, অশান্তি নেই। বলে দিলে আড়াই বছর বয়সী বাচ্চাটার কান্নাও কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।

জীবন কেমন নিস্তরঙ্গ নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। খারাপ না, ভালোই লাগছে এই জীবন। এখন দেখার ক’দিন আর ভালো লাগে?






সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×