somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আংকারা টু ইস্পারটা – এ জার্নি বাই বাস

২০ শে মে, ২০১৮ রাত ১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



- এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে এসেছো!
ড্রাইভার অনেকটা তাজ্জব হয়েই এই মন্তব্য করলেন।

মধ্য বয়স্ক লোকটির বড় টাকের দিকে শুধু এক নজর তাকিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম হাতের সুটকেস সামলাতে। উত্তর দেয়ার সময় পেলাম না, কোন মতে বড় সুটকেসটা লাগেজ বক্সে তুলেই বাসে উঠে পড়লাম।

উঠার মুহূর্তে চোখে পড়ল একটা ফরসা মুখ, স্কার্ফ এবং সানগ্লাস যা পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি – সবচেয়ে সামনে ডানের দুটো সিটের এক একটাতে বসে আছে।
অন্য পাসেঞ্জারদের দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম না, কারণ বাস ততক্ষণে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে।
আর আমার সিট সামনে হওয়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকানো রীতিমত লজ্জাস্কর মনে হচ্ছিল, কারণ প্রায় ছেড়ে দেয়ার মুহূর্তে দৌড়ে বাসে উঠেছি বলে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যেই ছিলাম।

আমার সিট কোনটা জানাই ছিল, কারণ কয়েকদিন আগে নিজেই অনলাইনে এই টিকেট্ বুক করেছিলাম।
চলন্ত গাড়ীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমার সিটে বসতে।
হ্যান্ডব্যাগটা পায়ের কাছে নামিয়ে সীট বেল্টটা বাঁধার সময় হঠাৎ সিটের সামনের টিভির স্ক্রিনে স্কার্ফে আধো ঢাকা সুন্দর একটা মুখ ভেসে উঠল।

লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি বসেছি বাসের বামে সিংগেল সীটের সারির সবচেয়ে সামনের সীটে, যা কিনা ঠিক ড্রাইভারের পিছনে। প্রত্যেক সীটের সামনে একটা করে ছোট টিভি স্ক্রিন দেয়া আছে। আর, বন্ধ থাকায়, আমার স্ক্রিন অনেকটা আয়নার কাজ করছে – ফলে একটা নির্দিষ্ট এংগেলে আমার ডানে বসা তরুণীর চেহারা প্রায় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ফরসা কিছুটা লম্বাটে মুখ, বয়স বিশের কোঠায় হতে পারে, কোন মেক আপ নেই কিন্তু ঠোটের লিপস্টিক দেয়া আছে মনে হচ্ছিল; অনেকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিবিম্ব হলেও পিকচার কোয়ালিটি ভালো বলতেই হবে – তাই একটু সময় নিয়েই খেয়াল করলাম।

হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় কি কুলক্ষণে যে মাথায় আইডিয়াটা এসেছিল যে, মুরতেজার ছেলে-মেয়ের জন্যে কিছু চকলেট কিনে নেই, রাস্তায় পছন্দ মত কিছু পাবো কিনা তার ঠিক নেই।
সেই চকলেট কিনতে গিয়েই বিপত্তিটা বেঁধেছিল।
অর্ডার প্লেস করে অপেক্ষা করছি, আর আমার সামনের কাস্টমার তার সিদ্ধান্তহীনতায় আমার ধৈর্য পরিক্ষা নিচ্ছিলেন।
বাস মিস করার উৎকন্ঠায়, অভদ্রের মতো একবার বলেও ফেললাম যে আমার একটু তাড়া আছে।

এরপরেও কোন লাভ হল না।
তারপর দোকানের তরুণী এক সুন্দরী তার পেশাদারিত্ব দেখিয়ে ধীরে ধীরে যত্নের সাথে আমার চকলেট প্যাক করতে লাগলো। মনে মনে চাইছিলাম কোন মতে একটা ব্যাগে ভরে দিলেই হয় – কিন্তু সে সুন্দর করে গিফট প্যাকটা শেষ করল।
প্যাকেটটা দেখে অবশ্য আমার মনটা ভালো হয়ে গেল।

প্রায় ছোঁ মেরে প্যাকেটটা নিয়ে হোটেলের বাইরে অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম আমি আর ফিক্রি।
ফিক্রি চেকিজ হল আমার লোকাল গাইড টাইপের। আসলে, আমাকে বাসে তুলে দেয়ার জন্যে এসেছে, অফিস থেকেই তাকে এই দায়িত্বটা দেয়া হয়েছে।
মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে ভাবছিলাম টারকিশ বাসগুলো যেন আমাদের দেশের মতই একটু দেরী করে ছাড়ে। তাহলে বাস মিস হবে না, না হলে আজ বাস মিস হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
মিস করলে আর যাওয়া হবে কিনা সন্দেহ, কারণ সরাসরি যে বাস যায়, তার শেষেরটাতেই টিকেট কেটেছি। এখন এটা মিস করলে, অন্য শহরে নেমে তারপরে লোকাল বাসে করে আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে – এক্সট্রা টাকাতো যাবেই, সময়ও যাবে।

অটোগার মানে বাসস্ট্যান্ডে এসে সব চেয়ে কাছের কাউন্টারে গিয়ে ফিক্রি খোঁজ করল আমার বাসের।
কপাল খারাপ হলে যা হয়, জানা গেল আমার বাস টার্মিনালের শেষ মাথায়।
শুরু হল আমাদের দুজনের দৌড় – আমি বড় সুটকেস নিয়ে দৌড়াচ্ছি আর সে আরেকটা ছোট ব্যাগ নিয়ে আমার আগে আগে ছুটছে। আমার বয়স আর সুটকেসের ওজনের কারণে তার সাথে তাল মিলাতে পারছিলাম না।
ভীরের মধ্যে হারিয়ে ফেলার ভয়ে প্রাণান্তকর চেস্টা করছিলাম, তাকে অন্তত দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতে।

প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে সে একটা বাসের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করল, বাসটা ততক্ষণে ব্যাক গিয়ারে ধীরে ধীরে পিছিয়ে টারমিনালের ওয়েটিং জোন থেকে বের হতে শুরু করেছে।
আমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাসের কাছে গিয়ে দেখলাম ছোট একটা বোর্ডে লেখা ‘স্পারটা’।
বুঝলাম, এটাই আমার বাস।

মুরতেজা চাম আমার অনেক আগের বন্ধু।
তার সাথে প্রায় ১৯ বছর আগে শেষ দেখা হয়, আমি তখন ইস্তাম্বুলে পড়াশোনার জন্যে এসেছিলাম। এরপর দেশে ফিরে গেলেও মাঝে মাঝে তার সাথে যোগাযোগ হত। কয়েকদিন আগে যখন অফিসের কাজে তুরস্ক আসার সুযোগ হল, তখন মনে হল তার সাথে একবার দেখা করা যায়।সে এখন সপরিবারে ‘স্পারটা’ থাকে, আর তার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে গভীর। তাই, আংকারা থেকে বাসে ‘স্পারটা’ যাচ্ছি। প্রায় ৭ ঘন্টার রাস্তা, কিন্তু তুরস্কের বাস আর রাস্তা উভয় সম্পর্কেই আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল – তাই একটা অসাধারণ জার্নির আশায় এই বাসে চেপে বসা। তার সাথে এখানে আসার আগেই সমস্ত যোগাযোগ করা করা শেষ, আমি ‘স্পারটা’ যাচ্ছি শুনে আমাদের আরেক বন্ধু ভেলি দেনিজও আজ আসবে। সে থাকে ইজমিরে, আজই রওয়ানা দিবে; কিন্তু আমার আগেই ‘স্পারটা’ পৌঁছে যাবে। তারা দুজন এসে আমাকে স্পারটা বাসস্ট্যান্ডে রিসিভ করবে – এমনি এক প্ল্যান করা হয়েছে।


বাইরের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে সানগ্লাসের কথা মনে পড়ল, কিন্ত্ পায়ের কাছে রাখা হ্যান্ডব্যাগটা তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না। খুব সম্ভবত তাড়াহুড়ার মধ্যে হোটেলে ফেলে এসেছি।
একবার ভাবলাম ফিক্রিকে জানাই, সে যেন হোটেল থেকে আমার সানগ্লাসটা কালেক্ট করে নিজের কাছে রাখে, আমি পরে তার কাছ থেকে নেয়ার একটা উপায় বের করে ফেলব।

হোয়াটসঅ্যাপ এ কল দিতে হবে, তাই বাসের ওয়াই ফাইয়ের পাসওয়ার্ড চাইতে গিয়ে বুঝলাম আমার ল্যাঙ্গুয়েজ স্কিল ১৯ বছর আগের মত নেই। যাই হোক, ইংরেজি আরে টার্কিশ মিশিয়ে বাসের গাইড ছেলেটাকে বুঝাতে পারলাম। তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে দেখি সব জায়গায় নেট থাকে না। তাই ফিক্রির সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমার আবার লোকাল সিমকার্ড নেই, কারণ ইন্টারনেট থাকলে হোয়াটসঅ্যাপ দিয়েই সমস্ত যোগাযোগ চলছিল এই কয়েকদিন।

কয়েক ঘণ্টা পরে এক পেট্রল পাম্পে থামল।
বাস থেকে নামার সময় ড্রাইভার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল যে, চাইলে ওয়াস রুম ব্যবহার করতে পারেন।
আমি নেমে পুরুষ লেখা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
ওয়াস রুম থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম দরজার কাছে একটা প্লেটে কিছু কয়েন রাখা। বুঝতে অসুবিধা হল না, এগুলো ওয়াস রুম ব্যবহার করে যাত্রীগণ পেমেন্ট করে গেছে। আমি পড়লাম মুশকিলে, কারণ আমার কাছে কোন টার্কিশ কয়েন বা ছোট মুদ্রা নেই। কারণ ডলার ভাঙ্গানোর সময় স্বাভাবিক ভাবেই কোন ছোট নোট পাইনি। তদুপরি, গত কয়েকদিন কার্ড দিয়েই কেনা কাটা করেছি বেশীরভাগ সময়, তাই কোন কয়েনও হাতে আসেনি।

টাকা নেয়ার জন্যেও কাউকে দেখছি না।
তাই, আমার অসহায়ত্ব বুঝানোর জন্যে এগিয়ে গেলাম মহিলা লেখা দরজার দিকে – হয়ত ঐখানে কেউ থাকবে যারা এই ওয়াশ রুম গুলো পরিচালনা করে। কারণ আমাদের দেশে তো সব সময় কেউ কেউ টাকা নেয়ার জন্যে দরজার কাছে থাকেই।

আমাকে মহিলাদের দরজার দিকে এগুতে দেখে বাসের ড্রাইভার চিৎকার করে উঠল
– মেয়েদের ওয়াশ রুমে কেন ঢুকতে যাচ্ছ ? পুরুষদেরটা তোমার পিছনে।

লজ্জায়, মাথা নিচু করে বাসে উঠে পড়লাম।
বোঝানোর চেষ্টা করলাম না।
কারণ পাস ওয়ার্ড চাইতে গিয়ে টের পেয়েছি – সে এক বর্ণ ইংরেজি জানে না আর আমি টার্কিশ ভাষায় অত দক্ষ নই।
বসেই আড়চোখে ডান পাশের তরুণীর দিকে তাকালাম। তাকে নামতে দেখিনি, বসেই ছিল।
দেখি, কেমন একটা দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। পরের পুরোটা সময় আর তার দিকে তাকানোর মতো সাহস করে উঠতে পারিনি।

পরের পর্ব আংকারা টু ইস্পারটা – এ জার্নি বাই বাস (পর্ব – ২ )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৮ রাত ১:৩৩
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×