somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আংকারা টু ইস্পারটা – এ জার্নি বাই বাস (শেষ পর্ব)

২২ শে মে, ২০১৮ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্ব আংকারা টু ইস্পারটা – এ জার্নি বাই বাস (পর্ব – ২ )

যতটা না মুগ্ধতা, তার চেয়ে ঢের শ্রদ্ধা নিয়ে সিবেলদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, ক্যাফে থেকে সোজা বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাসের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করব, আবার লেট লতিফ হতে চাই না।
এম্নিতেই ড্রাইভার আর তার ছোকড়া কিছিমের গাইড আমাকে কেমন যেন একটু অবহেলা করছিল।

স্ন্যাক্স দেয়ার পরে হাত থেকে চকলেট মোছার জন্যে টিস্যু পেপার যখন চাইতে গেলাম, বুঝাতেই পারলাম না কি চাইছি; নাকি সে বুঝতেই চায়নি। কফির সাথে আরেকটু গরম পানি চাইলাম, ছোকরা বলল সবাইকে দেয়ার পরে আবার আসবে। কিন্তু পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল কিনা জানি না, সে আর গরম পানি নিয়ে আসেনি। আমিও আর লজ্জায় চাইতে পারিনি।
যাই হোক, অবহেলা নাও হতে পারে, হয়ত নিজেই কিছুটা ইন্সিকিউরড ফিল করছি, বিনা কারণেই।

কানে হেডফোন, এক হাতে স্মার্ট ফোন আর আরেক হাতে বড় সুটকেস টানতে টানতে জিন্স টি-শার্ট পড়া দুই কিশোরী বাসের কাছে এসে হাঁপাচ্ছে। পিংক কালারের যে এ রকম বড় সুটকেস পাওয়া যায়, আমার ধারনা ছিল না - আসলে কখনো চোখে পড়েনি।
এরা আগে এই বাসে ছিল না, এখান থেকে উঠছে।
মনে হচ্ছে কাজিন হতে পারে, লাগেজ বুঝিয়ে দিয়েই আবার স্মার্ট ফোনে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ড্রাইভারকে বাসের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বুঝলাম, এবার সময় হয়েছে গাড়িতে উঠে বসার।
বাসে উঠতে গিয়ে চোখ পড়ল ঐ দুই কিশোরীর উপরে, তারা এখন সামনের দুই সিট দখল করেছে।
স্মার্ট ফোনে এখনো মগ্ন হয়ে আছে। সেলফি তোলা হয়েছে এরই মধ্যে কয়েকবার, ফোনে কার সাথে যেন কথাও বলল। কথা বলার স্টাইলে মনে হল, মুরুব্বী গোছের কারো সাথে কথা বলেছে – হয়ত বাবা-মাকে জানালো যে তারা বাসে উঠে পড়েছে।

বাসের অন্য প্যাসেঞ্জারও উঠতে শুরু করেছে।
উঠতে গিয়ে, একজন নিগ্রোকে বাসের ভিতরে বসা দেখে (নিগ্রো না হলেও, আমার গায়ের রঙ প্রায় কাছাকাছি) কয়েকজনের কৌতূহলী চোখের হতচকিত হয়ে যাওয়া বুঝতে পারছিলাম। হয়তো তারা এখানে এই মুহূর্তে এমনটি আশা করেনি।
তবে, আমাকে দেখে লোকজনের এই অভিব্যক্তিতে আমি বরং আমোদিত হচ্ছিলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলতে শুরু করেছে।

বিশাল খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে, আবার কখনো উচু পাহাড়ের কাছে দিয়ে বাস ছুটে চলছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেশি নয়, বড় বড় বাস চোখে পড়ল কয়েকটা আর বাকি সব প্রাইভেট কার। এটা টুরিস্ট সিজন না, অন্যথায় এই রাস্তায় আরো অনেক গাড়ী থাকতো। কারণ, এই মহাসড়ক ধরেই আনতালিয়ায় যাওয়া যায় – যেখানে রয়েছে তুরস্কের অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত। মুরতেজার বাসা থেকে থেকে প্রায় দুই ঘন্টার ড্রাইভ।

মুরতেজা অবশ্য একবার পরামর্শ দিয়েছিল – বাই এয়ার আংকারা থেকে আনতালিয়ায় নামতে।
ভেলি আর মুরতেজা আগেই চলে যাবে ওখানে, এরপরে তিনজনে একত্রে ইস্পারটায় ফিরব তার গাড়িতে করে।
তবে আমি রাজি হয়নি। কারণ, ফ্লাইট ধরতে হলে আমাকে অনেকটা সময় আংকারায় বসে থাকার পরে যে সময়ে আনতালিয়ায় নামবো এবং তারও পরে গাড়িতে ইস্পারটাতে পৌছাবো - বাসে গেলে প্রায় কাছাকাছি সময়েই পৌছাতে পারব।
আর বাস জার্নির একটা আলাদা আবেদন আমি সব সময়ই উপভোগ করেছি তুরস্কে।
তাই, এবাবের এই সুযোগটাও হারাতে চাইনি।


এক জায়গায় অনেকগুলো উইন্ডমিল দেখে ঝটপট মোবাইলে ছবি তুলে ফেললাম। পরে দেখি, দৃশ্যটা তেমন ভাল আসেনি ছবিতে। বাস্তবেই বরং বেশি সুন্দর লাগছিল; ছায়ায় ঢাকা উঁচু পাহাড়ের প্রায় কালো আবহের ব্যাকগ্রাউন্ডে সারিবদ্ধ সাদা সাদা উইন্ডমিল। প্রায় পোস্টকার্ডের মত দেখাচ্ছিল।

এরই মধ্যে বাস দু –এক জায়গায় থামল, কিছু যাত্রী নেমে গেলেন।
আমি কয়েকবার ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।
ঘুম ভাংগার পরে দেখি বাস এক বাসস্ট্যান্ডে বাস দাঁড়িয়ে আছে।
সাইনবোর্ডের লেখা দেখে বুঝলাম, এটা আমার গন্তব্যের আগের স্টপেজ।
এর পরেরটাই শেষ স্টপেজে, যেখানে নামতে হবে।
ততক্ষণে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।

বাস চলছে, অন্ধকারের ভিতর দিয়ে।
বাসে মাত্র তিন জন যাত্রী এখন। আমি, আর গোলাপী সুটকেস ওয়ালী সেই কিশোরী দুইজন।
বাসের গাইড, যে কিনা বয়সে কিশোরী দুইজনের থেকে কিছুটা বড়, ড্রাইভারের হাতে একটা কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে তাদের দুজনের পিছনের সীটে বসল। সে চেষ্টা করছে একটু বন্ধুত্ব গড়ে তোলার, আর কিশোরী দুইজন তাদের স্বাভাবিক বালখিল্যতায় তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সে দেখি মেয়ে দুইজনকে চকোলেটও দিল – হয়ত যাত্রীদের স্ন্যাক্স এর এক্সট্রা হিসেবে তার কাছে ছিল।

তাদের হাঁসির শব্দের পাশাপাশি, কথা-বার্তাও কানে আসছে।
তারা দুজনেই ইস্পারটাতে পড়াশোনা করে, থাকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে আরো কয়েকজন ছাত্রীর সাথে। তবে, এখন তাদেরকে নতুন এক ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে, কারণ মেয়েদের কয়েকজন হোস্টেলে জায়গা পেয়েছে বলে, ফ্ল্যাট থেকে চলে যাবে। নতুন ফ্ল্যাট খুঁজবে বলে ছুটি শেষের কয়েকদিন আগেই তারা দুজন চলে এসেছে।

এলাকায় তার পরিচিত লোক আছে এবং মানুষকে সাহায্য করতে তার ভালই লাগে, এরকম একটা ভাব দেখিয়ে ছেলেটি তাদেরকে বাসা খোঁজায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল। একটু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তারা মোবাইল নম্বরও আদান-প্রদান করে ফেলল। ছেলেটার দক্ষতা আছে বটে, তারিফ না করে পারছি না।

তাদের তিনজনের কথার মাখামাখি আর হাঁসি জমে উঠতে শুরু করেছে।
সম্মিলিত হাঁসির আওয়াজ অনেকটাই উঁচুতে এখন।
ড্রাইভারের মনে হয়, গাইডের এই প্রগলভতা পছন্দ হল না। বেরসিকের মত ঊচু গলায় সে গাইড ছেলেটাকে পিছনে গিয়ে আরেক কাপ কফি আনতে বলল। সারা রাস্তায় যাকে আমি এক কাপ কফি খেতে দেখিনি, এখন স্বল্প ব্যবধানে সে দুই কাপ কফি খাচ্ছে! গাইডকে মেয়ে দুইজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে কিনা কে জানে?

ইস্পারটা শহরে বাস ঢুকে পড়েছে।
ঝলমলে দোকান, রাস্তায় গাড়ীর ভিড় আর আলোকিত রাস্তা দিয়ে এগুতে এগুতে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল।
গাইড কিছু বলার আগেই বুঝে ফেলেছি, এখানেই নামতে হবে।

বাস থামতে না থামতেই দুই কিশোরী উঠে দাড়িয়েছে, দরজার কাছে চলে গেল।
তাদের পিছনে পিছনে আমি ও নেমে গেলাম, এরপর ধীরে সুস্থে বাসের আরেকদিকে লাগেজ বক্সের পাশে দাড়ালাম।
ততক্ষণে মেয়ে দুইজনের সাথে যোগ হয়েছে আরো তিনজন সমবয়সী কিশোরী – লাগেজ বক্স থেকে তাদের গোলাপী সুটকেস দুটো নেয়া শেষের পথে।

তাদের কলকাকলির মধ্যেই আমার লাগেজ নিয়ে বাস থেকে ঘুরতেই দেখি ভেলি দেনিজ আমার সামনে!
এত বছর পরেও চিনতে এক মুহূর্ত দেরী হল না কারণ ফেসবুকে তার চেহারার সর্বশেষ সংস্করণ দেখা হয়ে গেছে আগেই।
জড়িয়ে ধরে একটা লম্বা সময় পার করতে করতেই চোখে পড়ল মুরতেযা চামকে।
সে এগিয়ে এসেই আমার হাত থেকে লাগেজগুলো নিয়ে নিল, গাড়িতে তোলার জন্যে।
আমি তখনো ভেলির আলিঙ্গনে বন্দী।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৮ সকাল ১০:৩৫
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×