বাবার বদলির সুবাদে এই স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছি।
এখনো কারো সাথে তেমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। অবশ্য বন্ধুত্ব না হওয়ার পিছনে আমি নিজেই অনেকাংশে দায়ী।
একেতো অন্তর্মুখী আর স্বল্পভাষী, তার উপর পড়ালেখা বা খেলাধুলা কোন কিছুতেই তেমন ভালো নই। তাই, অন্যরা যখন ক্লাশের শুরুতে বা টিফিন পিরিয়ডে ছুটোছুটিতে মগ্ন থাকে, তখন স্কুলের বারান্দায় একা একা দাড়িয়ে দাড়িয়ে অন্যদের আনন্দ দেখে আরো বিষণ্ণ হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
মাঝে মাঝে অবশ্য গল্পের বই নিয়ে ক্লাশ রুমের ভিতরেই বসে থাকি।
একই সরকারী কলোনিতে থাকার সুবাদে আর প্রতিদিন সকালে স্কুলবাসের জন্যে বাসস্টান্ডে অপেক্ষার মুহূর্তে কয়েকজন ক্লাসমেটের সাথে দু’একবার কথা হয়েছে। কিন্তু নিজেকে মধ্যমণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তো দুরের কথা বরং তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে এখনো আগন্তকই রয়ে গেছি।
কলোনির পাশেই থাকেন হরিপদ স্যার, অংকের শিক্ষক।
কলিগদের পরামর্শে, বাবা আমাকে হরিপদ স্যারের কাছে ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে দিলেন।
ছেলে মেয়ে মিলিয়ে ৬ জন পড়ি।
বার্ষিক পরীক্ষার কয়েক মাস বাকী থাকতে একদিন আমাদের ব্যাচে জয়ীতা যোগ দিল।
আমার ক্লাশে অনেকগুলো মেয়ে আছে।
তাদের মধ্যে জয়ীতার আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই।
বরং হালকা মোটা গড়নের বলে, ক্লাসমেটরা আড়ালে আবডালে বলে বেড়ায় যে, তার বাবা যে বড়লোক আর বাসায় যে খাবারের অভাব নেই, এটা তার স্বাস্থ্য দেখেই বোঝা যায়। তবে চোখের চপলতা আর সারল্যমাখা কথাবার্তার জন্যে ফর্সা গোলগাল চেহারার জয়ীতাকে আমার কাছে আকর্ষণীয়া মনে হয়। যদিও কোনদিন কথা হয়নি।
হরিপদ স্যারের ব্যাচে শুধুমাত্র আমি আর জয়িতা আমাদের স্কুলের। আর সবাই কলোনির স্কুলের, তাই তাদের মধ্যে একটা আলাদা সম্পর্ক শুরু থেকেই আছে। অন্যদিকে, আমাদের দুজনকে তারা খুব একটা আপন করে নিতে পারেনি। সে কারণেই হোক বা সৌজন্যবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই হোক দু’জনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা শুরু হল। যার বেশিরভাগই লেখাপড়া সংক্রান্ত এবং নিতান্তই প্রয়োজনীয় বলা যেতে পারে। পড়ালেখার বাইরে বলার মত আমি নিজে কিছু খুঁজে বের করতে পারি না, আর সে বললেও আমি তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্যে গল্প করতে পারি না।
বিকেলে জানালা দিয়ে অন্য ছেলেদের খেলতে দেখি, কিন্তু আমি বাসা থেকে বের হই না। বরং গল্পের বই পড়ি।
প্রায়ই জয়ীতাকে বান্ধবীদের সাথে কলোনির রাস্তায় হাটতে দেখি। মাঝে মাঝে অন্য মেয়েদের সাথে মেয়েলী খেলা খেলে। তবে বেশিরভাগই দিনেই অন্য মেয়েদের মতই ছোট ছোট দলে হাটাহাটি করে, না হয় গল্পগুজব করে।
এক শনিবার, ছুটির দিন, প্রচন্ড গরমের মধ্যে বাসার কলিং বেল বেজে উঠে।
মা দরজা খুলে, কিছু ফটোকপি করা কাগজ হাতে জয়িতাকে দেখে অবাক হয়।
নিজের পরিচয় দিয়ে জয়িতা জানায় যে, সামনে পরীক্ষা তাই সে আমার জন্যে অংকের সাজেশন নিয়ে এসেছে।
রুমের ভিতর থেকেই মায়ের অবাক হওয়া গলা শুনতে পাই,
- সাজিদ, তোমার ফ্রেন্ড জয়িতা এসেছে।
কোন বন্ধু নেই বলে বাসায় কখনই কেউ আসেনি, আমার সাথে দেখা করতে।
আজ একজন এসেছে, তার উপর মেয়ে বন্ধু। মায়ের গলায় স্বরে আশ্চর্য হওয়ার পুরো আলামত স্পষ্ট।
আমি নিজেও কম অবাক হইনি।
স্বাভাবিকভাবেই ড্রইংরুমে গিয়ে জয়িতার কাছ থেকে পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে আর কথা বাড়াতে পারি না।
জয়িতাও চলে যায়, শুধু বলে যায় যে,
- ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট অংকগুলোতে তিন স্টার দিয়ে মার্ক করা আছে। আর, প্রতিটা পৃষ্ঠা যেন আমি এখনই মনযোগ দিয়ে দেখে নেই।
জয়িতা চলে গেলে, নিজের রুমে গিয়ে কাগজগুলো উল্টাতে থাকি।
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, অংকের সাজেশনের মধ্যেই ভিতরে দুই পৃষ্ঠার এক প্রেমপত্র। বুকের ভিতরে কাপন ধরে যায়, তাড়াতাড়ি দরজার দিকে তাকাই, কেউ দেখে ফেলল কিনা! ভালোবাসা আর আবেগ মাখানো লাইনগুলোর কিছু কিছু অস্টম শ্রেণীর কোন ছাত্রীর লেখার মত মনে না হলেও আমার হৃদয় ছুয়ে যায়। পেটের ভিতরে এক অজানা অনুভূতি আর মনের মধ্যে অনেক ছন্দ চলে আসে।
চিঠির শেষের দিকে লেখা, আমি যদি তাকে ভালোবাসি তাহলে যেন আজ বিকেলে কলোনির পানির পাম্পের পাশে তার সাথে দেখা করতে যাই।
দুপুরে পেট ভরে ভাত খেয়ে গরম লাগছিল বলে ফ্যানের নিচে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম বিকেল হতে এত দেরী হচ্ছে কেন!
বিকেলে কি বলব তার সাথে দেখা হলে? ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই।
পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাসস্টান্ডে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো, জয়ীতা।
সবার সামনে কিছু বলতেও পারছিলাম না। ক্লাশেও এমন ভাব করল, যেন আমাকে সে চিনেই না।
সারাদিন সুযোগ খুঁজলাম, তার সাথে একলা কথা বলার জন্যে, কিন্তু সে কোন সুযোগ দিল না।
বুঝতে বাকী রইল না – আমার জীবনের প্রথম প্রেম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কৈশোরের এক দুপুরের ঘুমের কারণে পরবর্তীতে জীবনে অনেকগুলো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৮ রাত ১:৫১