সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্প জানেন না, এমন লোক খুব একটা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই, এই অতি কথিত পুরনো গল্প বলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর ঝুঁকি নেয়ার দুঃসাহস দেখাতে চাই না।
আমি সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে মেরে না ফেললে কি হতে পারত, সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। কিন্তু, এত ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে পারিনি যে, কি হতে পারত।
তবে পার্বত্য চট্রগ্রামের অপহরনের ঘটনাবলীর দিকে খেয়াল করলে মনে হয়, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এই যুগেও সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মালিক বনে গেছে । শুধু তাই নয়, হাঁসটির কর্তৃত্ব যাতে হাতছাড়া না হয়, সে ব্যাপারে শুধু সচেতন বললে কম বলা হবে, বরং সর্বদাই সর্ব শক্তি নিয়োগের মাধ্যমে সচেষ্ট। তাই, বিনিময়ে, তাদের সোনার ডিমের অভাব হচ্ছে না। প্রতিটা অপহরণ থেকে যে পরিমাণ টাকা আসে, কে জানে হয়ত সোনার ডিম বিক্রি করেও এত উপার্জন করা যেত না।
যেমন ধরুন, পার্বত্য চট্রগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অপহরনের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। শেল তেল কোম্পানীর বিদেশী কর্মকর্তাদের অপহরণ করে, ১৯৮৪ সালেই শান্তি বাহিনী পেয়েছিলঃ
২২ কেজি সোনা।
প্রায় এক কোটি নগদ অর্থ (ডলার, পাউন্ড আর টাকায়)
১ টি রঙ্গিন টেলিভিশন।
১ টি ব্যাটারি চার্জার।
১ টি অত্যাধুনিক তাবু (সব আবহাওয়ার উপযোগী)।
১ টি ১৬ মিঃমিঃ মুভি ক্যামেরা।
১টি ডুপ্লিকেটিং মেশিন।
আমি অবশ্য জানার চেষ্টা করিনি, ঐ আমলে সোনার কেজি কত করে ছিল !
যদিও এর পরের এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, তবে এত বড় সোনার ডিম পার্বত্য চট্রগ্রামে আর কেউ কখনো পায়নি।
যেমন, ২০০১ সালে এক ব্রিটিশ আর দুই ডেনিশ নাগরিক কে অপহরণ করে ৯ কোটি টাকা মুক্তিপন দাবী করেছিল। এই তিনজন অবশ্য তেল অনুসন্ধানে নয় বরং ডেনমার্কের অর্থায়নে নির্মিত এক রাস্তার কাজ দেখতে এসেছিলেন। কত টাকা দেয়া হয়েছিল, সেটা অবশ্য জানা যায়নি, কখনো।
উদাহরণ টেনে, লেবু কচলে তেঁতো বানানোর চেষ্টায় ক্ষান্ত হচ্ছি। কারণ, প্রায় প্রতিদিনই পাহাড়ে অপহরণ হচ্ছে, এর কিছু কিছু সংবাদে হয়ত কারো চোখে পড়ে থাকতে পারে। তাই, সাম্প্রতিক এক উদাহরণে চলে যাচ্ছি।
গত মার্চ মাসে এক মোবাইল ফোন কোম্পানীর চার টেকনিশিয়ানকে অপহরণ করা হয়। জনশ্রুতি আছে যে, চার কোটি টাকার বিনিময়ে তাদের কে মুক্তি দেয়া হয়েছে। যদিও, এখানেও টাকার অংক নিশ্চিত করার কোন উপায় নেই।
রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য বা শাস্তি স্বরূপ ধর্ষণ ও হত্যা ইত্যাদির উদ্দেশ্যেও অপহরণ করা হয়ে থাকে। এ যেন অনেকটা সোনার ডিমের সাথে বাড়তি হিসেবে বোনাস প্রাপ্তির মত।
কে নেই এই অপহরনের নাগালের বাইরে? মোসুমী ফল ব্যবসায়ী, ছাত্রী, শিক্ষক, মটর সাইকেল চালক, সাধারণ গ্রামবাসী, সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পের কনট্রাক্টর, এন জিও কর্মী, মোবাইল রিচার্জ ব্যাবসায়ী, জন প্রতিনিধি, এমনকি পর্যটকও এই অপহরনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই সকল অপহরনের পরে, মুক্তিপন ছাড়া তেমন কেউই মুক্তি পাননি – যদিও ভুক্তভোগীদের বেশীরভাগই এ নিয়ে কথা বলতে চান না। আর, অনেক সময়ই সব অপহরনের সংবাদ জাতীয় দৈনিকগুলোতে দেখা যায় না।
অপহরনের কারণ হিসেবে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কথা বলা হলেও, মুলত চাদাবাজির কারণেই অপহরণ করা হয় বলে জানা গেছে। আরো জানা গেছে যে, তিন পার্বত্য জেলায় প্রতি বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এই টাকা তারা সংগঠনের নেতা – কর্মীদের ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন ধরণের সমাজসেবা মুলক কাজ, বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের ঘুষ, দেশ-বিদেশে বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারণা এবং অস্ত্র কেনায় ব্যয় করে।
এক অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরে পাহাড়ী বাঙ্গালী মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যাই বেশি আর আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতেই সবচেয়ে বেশি অপহরণ হয়েছে। প্রতিনিয়তই অপহরণ, হত্যা বা ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার হচ্ছে নিরীহ পাহাড়িরা। কিন্তু ভয়ে তারা মুখ খুলতে সাহস পায় না কখনই। তাই এই সব ঘটনার বেশির ভাগই রয়ে যায় সকলের অজ্ঞাতে। এসব অপহরণের কথা, অপহরণের পর হত্যার কথা মিডিয়াতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব একটা আলোচিতও হয় না।
গল্পে বর্ণিত কৃষকের হাঁসটি প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়ত। আর, যে হারে অপহরণ হচ্ছে, যার বেশির ভাগই মুক্তিপনের সাথে সম্পর্কিত; তা দেখে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরও যেন ‘অপহরণ’ নামক এক সোনার ডিম পাড়া হাঁস আছে। যে হাঁসও নিয়মিতভাবেই সোনার ডিম উপহার দিয়ে যাচ্ছে। কৃষকের সাথে পার্থক্য একটাই, অতি লোভে কেউ হাঁসটাকে মেরে ফেলছে না। বরং, একজনের স্থলে এখন চারজনে সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে দেখভাল করছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:৪৫