ভাদ্র মাসের কোন একদিন।
তাল পাকার জন্যে কত গরম দরকার ? জানি না। তাল এই মাসে পাকে বলেই নাকি অন্য কোন কারণ আছে ? তাও জানি না। তবে অত্যধিক গরম ছিল সেদিন। এই গরমেই কোষা নৌকা নিয়ে আমি আর আলতু ( চাচাত ভাই আলতাফের ডাক নাম) বেরিয়ে পরলাম, বিলে যাওয়ার জন্যে।
বাড়ি থেকে একটু দূরে বিলের ধান খেতে আমন ধান বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে, পানির উপরে গোছা ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘন ধানের গোছার মধ্যে দিয়ে কোষা নৌকায় লগি মেরে এগুনোর চেষ্টা করছি। বৈঠা ধান গাছের জন্যে বৈঠা বাওয়া যাচ্ছে না, লগি ছাড়া উপায় নাই।
ক্ষেতের ভিতরে ধানের গোছার মধ্যেই শালুকের পাতা দেখা যায়। এই পাতা দেখেই আগে বুঝতে হবে, কোন শালুকটা বাত্তি হয়েছে। এর পরে শালুকের ডগা ধরে আস্তে আস্তে ডুব দিয়ে ডগার গোড়ায় যেতে হবে। গোড়ায় মাটির নিচ থেকে শেকড়সহ শালুক তুলে পানির উপরে এক দমে আসতে হবে। ডগা ছিড়ে গেলে, গোড়া পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে না, আর দম না থাকলে শালুক মাটির নিচ থেকে না তুলেই পানির উপরে চলে আসতে হবে।
গামছা কাছা মেরে আগে আমি কিছু শালুক তুললাম। প্রায় অর্ধেক পাতিল হওয়ার পরে, আলতু নেমে পড়ল। আমি লগি মাটিতে গেঁথে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করছি। পাতিল ভরতে বেশিক্ষন লাগল না। ফিরতে শুরু করলাম। ধান ক্ষেতের বাইরে এসে লগি রেখে এবার বৈঠা ধরলাম।
বড় জেঠি শালুক খুব পছন্দ করে। এতগুলো শালুক পেয়ে কেমন খুশী হবে, সেটা ভাবতে ভাবতে বাড়ির উঠোনে পাতিল নামিয়ে যখন বিজয়ীর বেশে মাকে দেখাচ্ছিলাম, তখনো চোখে পড়েনি যে মায়ের মুখটা কালো হয়ে আছে। জেঠির মুখে অন্য দিনের মত হাঁসি যে ছিল না, সেটা খেয়াল করলেও, তেমন কিছু মাথায় আসেনি, কারণ তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে।
পাতিল বাড়িতে রেখে দৌড় দিলাম মেচেরদের বাড়ির দিকে, মার্বেল খেলতে। মাস খানেক আগে তিনটা কাঁচের মার্বেল পেয়েছিলাম, ছোট কাকার কাছ থেকে। এরপর থেকে মার্বেল খেলার নেশায় পেয়ে গেছে। অন্ধকারে যখন আর মার্বেল দেখা যায় না, তখন মার্বেল খেলা শেষ হয়। কাঁচের মার্বেল কয়টা পাওয়ার আগে অবশ্য মাটির মার্বেল দিয়ে খেলতে হত, আর নাহয় দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের খেলা দেখতে হত।
মেচের মাছ বিক্রি করে এখনো হাট থেকে ফিরেনি। অন্যদিন মেচেররা দুই ভাই মিলে সাজাহান কাকার সাথে হাটে যায়। ছোট বলে, মেচের কেনা সদাই গুলো নিয়ে আগেই বাড়ি চলে আসে। বাকী দুইজন, মাছ বেচা শেষ করে, সচরাচর সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরে। ততক্ষনে কাকির রাতের রান্না প্রায় শেষ হয়ে যায়। আজকে সাজাহান কাকা মাছ ধরতে যেতে পারেনি বলে মেচের তার ভাইয়ের সাথে গেছে। এই জন্যে এখনো সদাই নিয়ে ফিরতে পারেনি।
আমার প্রশ্নের উত্তরে এক দমে এই তথ্যগুলো দিয়েই, পারুল আমাকে প্রশ্ন করল, তোমরা নাকি রাঙামাটি চইল্যা যাইবা ?
মেচেরের ছোট হলেও পারুলের গড়ন দেখে তাকে বড় মনে হয়। আর কিভাবে জানি, তার বুদ্ধিও বেশী। মেচেরের দোস্ত হিসেবে তাদের বাড়ীতে প্রতিদিনই যাই বলে, পারুলের সাথে নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয়; যার সবই স্বাভাবিক, নিতান্তই
দৈনন্দিন আর দরকারি কথা।
তবে, আজকের প্রশ্নটা ব্যতিক্রম। অন্যদিন, দরকারি কথার বাইরে কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেও, আজ যেতে পারলাম না। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে সে সব বলে দিল, আমাকে - আমরা নাকি দেশান্তরী হবো !
কিছুক্ষন আগে সে তার মাসহ আমাদের বাড়িতেই ছিল। ঐখানে আমার মায়ের কাছ থেকেই শুনেছে যে, আমরা ভিটেমাটি ছেড়ে রাঙামাটি চলে যাচ্ছি। সেখানে নাকি সরকার আমাদেরকে বাড়ি, জমি, গরু সব দিবে। তাই, শুকনো মৌসুমে এই গ্রামে বর্গা চাষ আর বর্ষার দিনে মাছ ধরে দিন পার করতে চায় না, আমার বাবা। সে মাকে বলে দিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যেই যা আছে, সব কিছু নিয়ে একেবারে চলে যাবে এখান থেকে।
সন্ধ্যায় কুপির আলোতে ভাত খাওয়ার সময় শালুক কেমন যেন বিস্বাদ লাগল, অথচ আগে এটাই ছিল স্বাদে অদ্বিতীয়। সবার চোখে-মুখে থম্থমে ভাব। নিঃশব্দতাই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট যে, অব্যক্ত হলেও ব্যাপারটা অজ্ঞাত নয়। সবাই জানে ব্যাপারটা, কিন্তু কেউ মুখে আনতে পারছে না। কয়েকবারই মনে হল, মা চোখ মুছলেন, তবে কুপির দিকে উল্টে ফিরে। অদ্ভুত এক নিঃশব্দতায় গ্রাস করে ফেলেছে সকলকে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, প্লেটের দিকে তাকিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছে। এমন মনোযোগ দিয়ে বাড়ির কাউকেই কোন কাজ করতে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। সব কিছু মিলিয়ে, রাঙ্গামাটির প্রসঙ্গ তোলার মত সাহস পেলাম না।
রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবলাম- যার সবই ছিল এলোমেলো চিন্তা ভাবনা। রাঙামাটি জায়গাটা কোথায়, কত দূরে? কিভাবে যেতে হয়? না গেলে হয় না?।
সাজাহান কাকারা যাবে?
ছবিঃ আব্দুর রাজ্জাক শিপন ভাইয়ের ব্লগ থেকে নেয়া।
পরের পর্ব- ছেলেবেলা (২য় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১৯