এই ট্যুরে আহত বা নিহত হওয়ার ঝুঁকির ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রয়েছি – শুরুতেই এই মর্মে অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর দিতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠল। অন্য সবার মত, আমাকে আরো মেনে নিতে হল যে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকলে রিফান্ড ছাড়াই এই ট্যুর বাতিল করা হবে।
বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হল যে, নির্দিষ্ট অনুমোদিত স্থান ব্যতিত অন্য কোন স্থানে কোন মতেই ছবি তোলা যাবে না। আবার, বিশেষ কিছু স্থানে, শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়ার দিকের ছবি তোলা যাবে। এমনকি সেলফি তুলতে গেলেও ব্যাকগ্রাউন্ডে দক্ষিন কোরিয়া থাকতে পারবে না। সেই সাথে আমাদের সবার গলায় ট্যুর চলাকালীন সময়য় ব্যবহার্য আইডি ব্যাজ ঝুলিয়ে দেয়া হল।
এছাড়া পোশাক-আসাক এবং আচরনের ব্যাপারেও কিছু কিছু ব্যতিক্রমী নির্দেশনা ছিল। যাত্রার শুরুতেই এমন কান্ড কারখানা দেখে যতটা না ভয় তার চেয়ে বেশী উত্তেজনামিশ্রিত কৌতুহল নিয়ে দক্ষিন কোরিয়ার De-Militarized Zone (DMZ) এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
পাঠক কুলের নিশ্চয় জানা আছে যে, অদ্যবধি ১৯৫০ -৫৩ সালের কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধের কোন স্থায়ী সমাপ্তি হয়নি।
১৯৫৩ সালে জাতিসংঘ, চীন এবং উত্তর কোরিয়া এক অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যার ফলশ্রুতিতে, কোরীয় উপদ্বীপে দুই কোরিয়ার মধ্যে ২৫০ কিমি দীর্ঘ আর ৪ কিমি প্রস্থের এক বাফার জোন তৈরি করা হয়, যা বিখ্যাত De-Militarized Zone (DMZ) নামে পরিচিত। তবে দক্ষিন কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে এর নিকটতম দূরত্ব মাত্র ৫৬ কিমি – যা মাত্র আধ ঘন্টায় অতিক্রম করা সম্ভব। আরো ভয়াবহ বিষয় হল এই যে, উত্তর কোরিয়ার এমন এমন কিছু দূর পাল্লার কামান আছে, যেগুলো দিয়ে সিউলে আঘাত হানা সম্ভব।
শর্ত অনুযায়ী, এই বাফার জোনে কোন পক্ষই কোন ধরণের সামরিক প্রস্তুতি বা কর্মকাণ্ড করতে পারবে না।
তবে, এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক শান্তি রক্ষী থাকার কথা থাকলেও, বাস্তবে তার প্রায় দশগুন বেশী সৈন্যের উপস্থিতি বিরাজমান। আর, এখানে সৈনিকদের মেশিনগান বহন করা নিষেধ হলেও তারা ঐ ধরণের অস্ত্রই বহন করে। নামে অসামরিকীকৃত বলা হলেও, বাস্তবে সার্বিক বিবেচনায়, এই এলাকাটিতেই বরং সামরিক উপস্থিতি তাবৎ দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী। সঙ্গতকারণেই দুই কোরিয়ার মাঝের এই এলাকাটিকে পৃথিবীর সবেচেয়ে সুরক্ষিত সীমান্ত এলাকা বলা হয়।
কোরিয়ায় এসে ডিএমজেড না দেখে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তবে আগে ভাগে যোগাযোগ করা হয়নি বলে, পুরোদিনের ট্যুর পেলাম না। অগত্যা হাফ ডে ট্যুরে Dora Observatory এবং 3rd Infiltration Tunnel দেখার সুযোগ গ্রহণে বাধ্য হলাম।
আমাদের এক সহযাত্রীর কারনে প্রায় ৩০ মিনিট দেরীতে শুরু হল আমাদের যাত্রা। বাস এগুতে থাকলে আমি জানালা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে সিউলের বিশাল বিল্ডিঙের উপর সকালের রৌদ্রের উজ্জল আলোকছটার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। গাইডের ইংরেজি উচ্চারণের কারনে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটল। বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাসের ভিতরে তাকিয়ে দেখি মাঝ বয়সী এক লোক কোরিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং আমরা কি কি দেখতে যাচ্ছি – সেগুলো বিস্তারিত বুঝিয়ে বলতে শুরু করেছে। তবে কিছুক্ষণ পরেই তার বিশেষ উচ্চারণ ভঙ্গি বুঝতে কষ্ট হল না।
নদীর উপারে উত্তর কোরিয়ার পাহাড়।
মসৃন রাস্তার উপর দিয়ে চলতে চলতে এক সময় এক নদীর পাশ ঘেঁষে বাস এগুতে লাগল। দূরে আবছা ভাবে গাছপালা আর পাহাড়ের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। নদী ধরে আরো কিছুটা এগুতেই উত্তর কোরিয়ার ভু-প্রকৃতি আরো পরিস্কারভাবে দেখতে পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নদীর দক্ষিন পার্শ্বে কাঁটাতার দিয়ে তৈরি উঁচু বেড়া দেয়া, দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে এটা অত্যন্ত মজবুত এবং কার্যকরী। দেখেই কেন জানি মনে হচ্ছিল যে, এই কাঁটাতারের মধ্যে দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে চাইলে, ইলেক্ট্রিক শক খেতে হবে। কিন্তু গভিরভাবে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেও কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে কোন ইলেক্ট্রিক লাইনের কানেকশন বের করতে পারলাম না।
কিছুক্ষন পরেই আমদের বাস এসে থামল চেক পয়েন্টের সামনে – এখানে পাসপোর্ট চেক করা হয়। ইউনিফর্ম পড়া একজন সৈন্য বাসে উঠে আমাদের সবার চেহারা ভালমত পরখ করতে করতে গুনে নিল। ইতোমধ্যেই গাইড আমাদের পাসপোর্টগুলো একত্র করে সামনে ছোট এক ঘরে দৌড়ে নিয়ে গেল। চেকিং এ বেশিক্ষন লাগলো না।
পাসপোর্টগুলো ফেরত দিয়েই সে আবার ধারা বিবরণী দিতে শুরু করল। এখন বলতে শুরু করেছে Camp Kitty Hawk এর নাম পরিবর্তন করে Camp Bonifas করার ঘটনা। উত্তর কোরীয় সৈন্যদের হাতে নিহত আমেরিকান মেজর বনিফাস এর সম্মানে এই নামকরন করা হয়েছে।
চেক পয়েন্টে কর্তব্যরত সৈনিক।
১৯৭৬ সালের আগস্ট মাস।
নিজেদের এক ডিউটি পোষ্ট থেকে পাশের ডিউটি পোষ্ট ঠিক মত দেখা যাচ্ছিল না বলে ক্যাপ্টেন আরথার বনিফাস এর নেতৃত্বে ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট মার্ক ব্যারেটসহ ছোট একটা দল ডিএমজেড এর ভিতরে গিয়ে একটা পপলার গাছের ডাল ছাটছিল। তা দেখে, উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা এসে গাছটি কাটতে নিষেধ করে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়ার দলনেতা আবার বলে যে, এখানে কিছু করতে হলে উভয় পক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে করার কথা। সুতরাং, তাদের এই কাজ বন্ধ করা উচিৎ।
এতদসত্ত্বেও, গাছ ছাটা পার্টি কাজ না থামালে উত্তর কোরিয়ার দলনেতা একটা কুড়াল দিয়ে ক্যাপ্টেন বনিফাসকে আক্রমণ করে। সাথে সাথে তার দলের বাকীরা তাকে অনুসরণ করে দক্ষিন কোরীয় এই দলের অন্যদের আক্রমণ করে বসে। আক্রমনের শুরুতেই খুব দ্রুততার সাথে কাপ্টেন বনিফাসকে ঘটনাস্থলেই কুড়াল দিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলের কিছুটা দূর থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ব্যারেটকে হাঁসপাতালে নেয়ার সময়, পথিমধ্যেই সে মারা যায়। না বললেই নয় যে, নিকটবর্তী এক ডিউটি পোস্ট থেকে পুরো ঘটনার ভিডিও ধারন করতে সক্ষম হয়েছিল জাতিসঙ্ঘের এক শান্তিরক্ষী।
উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের দাবী ছিল যে, এই গাছটি তাদের প্রথম সুপ্রিম লিডার কিম ইল-সাং নিজে রোপণ করেছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে পরিচর্যাও করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম ইল-সাং ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
অবশ্য, তিনদিন পরেই দক্ষিন কোরিয়া এবং আমেরিকান সৈন্যরা একযোগে এক বিশাল সমর শক্তির প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ঐ গাছটি কেটে ফেলে। উল্লেখ্য যে, মরণোত্তর পদোন্নতি দিয়ে মেজর আরথার বনিফাস এবং লেফটেন্যান্ট মার্ক ব্যারেটকে যথাযোগ্য সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। আরো উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে নির্বাচিত দক্ষিন কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন Operation Paul Bunyan নামের ঐ বিশেষ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।
এ রকম আরো বীরত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ যার সবই দক্ষিন কোরীয়দের বীরত্ব শুনতে শুনতে Dora Observatory তে পৌছাতে বেশিক্ষন লাগলো না। প্রথমেই আমাদেরকে ভিতরে ছোট অডিটোরিয়ামে নিয়ে সুন্দর একটা topigraphical model এর মাধ্যমে দক্ষিন কোরীয় এক সৈনিক ব্রিফিং করতে শুরু করল। ব্রিফিং শুনতে শুনতে মডেলের উপর DMZ এর উল্লেখযোগ্য অনেক কিছুই ভালোভাবে দেখে নিলাম। আর বসে কাঁচের দেয়ালের ওপারে হালকা কুয়াশায় ঢাকা উত্তর কোরিয়ার সবুজ গাছপালা দেখে অডিটরিয়ামের বাইরে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলাম, কখন এই ব্রিফিং শেষ হবে।
Dora Observatory তে ব্রিফিং চলছে।
ছবিঃ সবগুলো ছবি গুগল থেকে নেয়া।
পরের অংশ ডোরা অবজারভেটরি (Dora Observatory)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:১০