ব্রঙ্কিয়াল এজমা অর্থাৎ হাঁপানি শ্বাসযন্ত্র অর্থাৎ লাংস বা ফুসফুসের বিশেষ ধরনের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ জনিত একটি রোগ। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ইনফেক্সন জনিত সমস্যায় ভুগলে কিংবা কোন কারনে শ্বসনালীর আবরণী কোষগুলোর সংবেদনশীলতা বেড়ে গেলে এ রোগের উপসর্গগুলো (যেমন হাঁচি, কফ-কাশি সহ বুক চেপে ধরার অনুভুতি ও শ্বাসকষ্ট) প্রকাশ পায়।
বংশগতভাবে অর্থাৎ জিনগত ত্রুটির কারনে মূলত মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে বাবা-মা কিংবা বংশে অন্য কারো না থাকলে যে রোগটি করো হবেই না তা ঠিক নয়। এলার্জেন ঘটিত সমস্যা অর্থাৎ বিশেষ কিছু পদার্থ কারো কারো ক্ষেত্রে এলার্জি জনিত শ্বাসকষ্টের কারন হতে পারে। এছাড়া পরিবেশ বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনেও অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকেন।
রাস্তা-ঘাটে যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, ধুলো-বালি বিশেষ করে পুরানো কাপড়, কার্পেট ও আসবাবপত্র ঝাড়া ধুলো, ফুলের রেণু, বিশেষ কিছু খাদ্য গ্রহণ করলে, পশু-পাখির শুকনো বিষ্ঠা, পশমের তৈরি বালিশ, লেপ ও কম্বল ইত্যাদিতে বিদ্যমান পলেন শ্বসনালীতে প্রবেশ করলে অনেকেই এতে আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণতা, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম ও নির্দিষ্ট কিছু পেশার কারনেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে-
*ব্রঙ্কিয়াল এজমা সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রে “Prevention is better than cure অর্থাৎ নিরাময় অপেক্ষা প্রতিরোধই শ্রেয়”- এই পন্থা অবলম্বন করতে হয়। এ রোগটির প্রাদুর্ভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে অন্য দশজনের মত স্বভাবিক জীবন জাপন করা যায়। তাই রোগটি সম্পর্কে মোটামুটি কিছু ধারনা নেয়া, নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
*এজমার ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা মোটেই ঠিক নয়। এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শমত নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। অনেকেই ইনহেলার নিতে ভয় পান। কিন্তু মনে রাখবেন, মুখে খাওয়া ওষুধের পাশাপাশি প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে নিয়মিত ইনহেলার নিয়াই উত্তম। দেখা গেছে এতে করে একজন ক্রনিক এজমা রোগীও উপসর্গ মুক্ত থেকে ভালভাবে জীবন কাটাতে পারেন। কারো এলার্জিক রাইনাইটিস থাকলে নাসিকা ঝিল্লির প্রদাহ হয়। ফলশ্রুতিতে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে নাকে ব্যবহৃত বিশেষ স্প্রে নিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
*এজমা রোগীদের মধ্যে যাদের কোল্ড এলার্জি আছে তাদের জন্য খুব ঠান্ডা খাবার না খেয়ে তা নরমাল করে খাওয়াই ভাল। তাছাড়া যেসব জিনিসে এলার্জি হয় সেগুলো এভয়েট করাই শ্রেয়। বেগুন, চিংড়িমাছ, গরুর মাংস এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক, ছিম ইত্যাদি খেলে রোগটির প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। তাই কোন্ কোন্ এলার্জেন এর কারনে কার রোগ বৃদ্ধি ঘটে তা নির্ণয়ের জন্য সেনসিটিভিটি টেস্ট করে নিলে আগে থেকেই সাবধান হওয়া যায়।
*আমাদের চারপাশের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এলার্জি জনিত শ্বাসকষ্ট অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়। তবে ধুলো-বালি ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ফিল্টার মাস্ক ব্যবহার করে এ অবস্থা থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ধুমপান অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
*শীতের শুরুতে পশমী কম্বল ইত্যাদি ওয়াশ করে নিতে হবে এবং লেপ, কম্বল ও বালিশে মোটা সুতির কাভার ব্যবহার করতে হবে। সকালে ও রাতে বিছানা ছেড়ে লেপ/ কম্বল থেকে বের হবার সময় গায়ে গরম কাপড় দিতে হবে। গরমের সময় ঘামে ভেজা কাপড় গায়ে শুকানোর আগেই বদলে নিতে হবে।
*ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে ও ঘরের আসবাবপত্র ধুলামুক্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে। শোবার ঘর থেকে পশমী কার্পেট সরিয়ে রাখতে হবে। বসার ঘরের কার্পেট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাক্স-পেটরা ও পুরানো কাপড়-চোপড় রাখার স্থান পাতলা প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
*ঘর তেলাপোকা মুক্ত রাখার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। পোষা প্রাণীকে বেডরুম বা ড্রইংরুম থেকে দূরে অর্থাৎ ঘরের বাইরে নির্নিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। রান্না শেষে গ্যাসের চুলার চাবি বন্ধ আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
*এজমা রোগীদের জন্য বিশেষ কিছু ওষুধ যেমন উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিটা-ব্লকার গ্রুপের প্রপানোলল, এটেনোলল ইত্যাদি বর্জন করা চাই। জ্বর বা ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল, ডিসপ্রিন ইত্যাদি খেলেও এ ধরনের রোগীদের কারো কারো ক্ষেত্রে উপসর্গ বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এগুলো খাবার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করাই ভাল।
*এজমা রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে রোগী খুবই কষ্ট পান। বৃদ্ধ ও শিশুদের বেলায় এটি হঠাৎ করেই মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে। তাই কোন পরিবারে এ ধরনের রোগী থাকলে জরুরী অবস্থা সামলে সেবার জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা হিসেবে বাসায় স্পেসার, নেবুলাইজার এবং প্রয়োজনে পোর্টেবেল অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে হবে। শ্বাসকষ্ট কিছুতেই না কমলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৮:১৬