somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভূত কিংবা ভবিষ্যতের গল্প

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকক্ষণ ধরে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছি, একজন মানুষের অপেক্ষায় আছি। শুধু দুই পা, দুই হাত বিশিষ্ট, রক্তমাংস দিয়ে গঠিত মানুষ নয়, আমি একজন মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি তার কাছে আমার জীবনের কথা বলতে চাই, আমার রাগ-ক্ষোভ-অভিমানগুলি তার মাঝে ভাগ করে দিতে চাই, আমার স্বপ্নগুলো তার চোখে বুনে দিতে চাই।
ও হ্যাঁ, আমার নাম সফিক, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে নিহত এক যুবকের ভূত। এখন নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা একজন শহীদ বলতে নিজেরই লজ্জা লাগে। কি, অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। যখন দেখি সন্তান বা নাতি-নাতনীদের কোটা সুবিধা পাওয়ানোর জন্য কেউ মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেয় কিংবা নিজের চাকুরীর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কেউ মুক্তিযোদ্ধা সাজে, তখন আমি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা থেকে যুদ্ধে নিহত, রাগে-ক্ষোভে বিপর্যস্ত একজন ভূত হয়ে যাই। যখন দেখি রাজাকারও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক হয়ে যায় কিংবা রাজাকারের গাড়িতে উড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা, তখন শহীদ মুক্তি্যোদ্ধার নামের তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু আজ আমি মৃত, আমার নতুন করে যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই। তাই এক সময় যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চায়নি, তারাই আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তেমনি একজন আমার এলাকার প্রাক্তন সংসদ সদস্য কুতুব আলী, যাকে আমি চাচার মত সম্মান করতাম। যুদ্ধের সময় অবশ্য আমরা তাকে কেতু রাজাকার বলে ডাকতাম। সে ছিল তখন একটা এতীমখানার কেয়ারটেকার। সেই এতীমখানায় আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি। আমি জানতামনা- কে আমার বাবা, কে আমার মা? যখন দেখতাম কোনো স্কুল ফেরত ছেলে তার বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরত, তখন আমি নিজেকে ছেলেটির জায়গায় কল্পনা করে নিজের মনকে প্রবোধ দিতাম। বৈশাখী মেলায় গিয়ে যখন দেখতাম কোনো ভাই তার বোনের জন্য রঙ্গিন চুড়ি কিংবা রক্তলাল আলতা কিনছে, তখন ছোট্ট একটা বোনের জন্য আমার মনটা হাহাকার করে উঠত। আমার উস্কুখুস্কু চুলের জন্য যখন কেউ আমায় ধমক দিত, তখন মায়ের আদরমাখা শাসনের অভাবের কথা ভেবে মনে ঝড় বয়ে যেত। নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন না থাকার কথা চিন্তা করার ফাকে দেশমাতৃকার কথা ক্বদাচিৎ মনে পড়ত। তারপর একদিন শুনলাম দেশ-মাকে স্বাধীন করার জন্য সেই বজ্রকন্ঠের ডাক- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়”। সেই ডাক আমার ঘুমিয়ে থাকা বোধশক্তিতে ধাক্কা দিয়ে গেল, আমার শীতল রক্তকে গরম করে দিল। তাই এই না পাওয়ার জীবনে একটা দেশ, একটা মা পাওয়ার লোভে, সুন্দর একটি জীবন ব্যবস্থা পাওয়ার কথা চিন্তা করে আমিও তখন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আর সেই সময় আমাদের এতীমখানার কেয়ারটেকার কুতুব আলী নিজ দেশের বিরুদ্ধে, নিজ মায়ের বিরুদ্ধে বেঈমানীর খেলায় মেতে উঠেছিল। সে হয়ে গিয়েছিল রক্ত-লালসায় মেতে উঠা পাক-হানাদার বাহিনীর পা-চাটা কুকুর। আমি যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছি তা সে জানত। তবে আমার তার উপর বিশ্বাস ছিল যে সে কখনো আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবেনা, কারণ এতীমখানায় ছোটবেলা থেকে এই কেতু রাজাকারই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। কিন্তু একদিন সেই বিশ্বাসের মূল্য চুকিয়েছিলাম তার বিশ্বাসঘাতকতায় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে মৃত্যুযন্ত্রণার কষ্টের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভেবে। তবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম যেদিন সে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির চোরা গলি দিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল। তবে শুনেছি এখন নাকি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। রাজনীতির মারপ্যাচে একদিন হয়ত মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে সে-ই হয়ে যাবে মুক্তিযোদ্ধা।
মাঝে মাঝে মনে হয় কবি বোধ হয় আমাদের দেশের কথাই চিন্তা করে বলে গেছেন, “স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন”। তাইতো আজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশ সাধারন জনগণের পেটে মারে রুলারের গুতো, স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োগ করা হয় হরতাল নামক গণতান্ত্রিক(!) হাতিয়ার, বাক-স্বাধীনতা রক্ষা(!) করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ৫৭ ধারা। ভাষার জন্য জীবন দেয় যে জাতির সন্তান, সেই জাতি আজ বিশ্বে শীর্ষ দূর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথম পাঁচটির একটি। আর এখন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস হয়ে গেছে গুজবের মত যা একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই সব দেখার পর নিজেকে প্রতারিত মনে হয়, মনে হয় শুধু কি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ পাওয়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম? কোথায় সবার সম অধিকার, কোথায় বেকারত্ব হ্রাস, কোথায় কৃষকের ন্যায্য পাওনা? তাই নতুন প্রজন্মকে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- “আমরা না হয় এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলাম, তাই আমরা এই দেশের, এই মায়ের সূর্যসন্তান, কিন্তু তোমরাওতো এই মায়েরই সন্তান। তাহলে আজো কেন আমাদের দেশের, আমাদের মায়ের এই দৈন্যদশা। দেশ স্বাধীন, তাই তোমরা প্রতি বছর বিজয় দিবস পালন কর। কিন্তু কবে তোমরা এই দেশকে সত্যিকারের বিজয় এনে দিতে পারবে?”
এই মায়ের সত্যিকারের বিজয় দেখার জন্য, এই দেশের সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ দেখার আশায় আজো আমি ভূত হয়ে অপেক্ষা করে আছি। আমি অপেক্ষা করে আছি কয়েকজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য, যারা আমাদের শহীদদের এই অপূর্ণ ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে চেষ্টা করবে, যারা দেশকে উন্নত ও সভ্য দেশের কাতারে নিয়ে গিয়ে সত্যিকার অর্থে বিজয় দিবস পালন করতে পারবে।

৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×