নীরার সাথে দেখা হবার পর প্রথম পনের দিন আকাশের খুব স্বাভাবিক কেটে যায়। ব্যাপারটা খুব একটা ভাবায়নি তাকে। কিন্তু বিপত্তিটা ঠিক বাঁধে আবার বাসেই; যখন সে কর্মস্থলে ফিরছিল।
ঈদের টানা নয় দিনের ছুটি, প্লাস বসের সাথে সু-সম্পর্ক জনিত কারণে সে আরও এক সপ্তাহের ছুটি নেয়। ভালোই কাটল ছুটিগুলো। অনেক জুরুরি পারিবারিক কাজ সারা হল। তার মধ্যে একটি হল, মেয়ে দেখাদেখি পর্ব।
আকাশ দেখতে বাড়াবাড়ি রকমের সুপুরুষ নয়। শিক্ষিত, ভালো চাকুরে – এমন ছেলে হাজারে হাজারে। তাই তাকে কেবল ঠিকঠাকই বলা যায়। কিন্তু কোন এক আশীর্বাদ পুষ্ট কারণে, মেয়েরা তাকে এবং মেয়ের পরিবার রা তাকে অনেক পছন্দ করে ফেলে। কি জানি কেন, এটুকু বলা যায়, সে কখনো কারও খারাপ কিছু করেনি, এমন কোন অন্যায় করেনি, যার জন্য তীব্র পরিতাপ হয়। এ সব গুলো পারিবারিক শিক্ষার ই অংশ। তাই আকাশ পরিবারের ‘’আদর্শ ছেলে!’’ হয়তো বিয়ের বাজারেও তাই। ফলে খোঁচাখুঁচি অংশে আকাশ হল তার বন্ধুদের প্রথম পছন্দ। ‘’কি মামা, তোমার তো চাঁদ কপাল। কত জনের পছন্দ তুমি!’’ কিংবা ‘’ তুই তো হেবি মাঠ কাঁপাইতেছিস বিয়ের বাজারে!’’ ইত্যাদি ইতাদি!
আকাশ কখনো কোন মেয়েকে বলতে পারিনি, ‘’ভালোলাগে’’ কিংবা ‘’ভালোবাসি!’’ এমনকি কোন মেয়ের পছন্দে সে সাড়াও দিতে পারেনি কখনো। এমন কত মেয়ে আছে, কত সরল, কত সততা নিয়ে আকাশ কে তাদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্য। কিন্তু আকাশ কিছুই করতে পারেনি কখনো। কারণ সে আদর্শ ছেলে, বিয়ের মাঠ কাঁপানো সু পাত্র এখন। এ জাতীয় আদর্শ ছেলেদের হাত পা বাঁধা থাকে। এদের সাহস খুব কম। নিজেদের পছন্দ, ভালো লাগা, চাওয়া কখনই প্রকাশ করতে নেই। কিংবা প্রকাশিত হলেও তার পূর্ণতা দিতে যে পরিমান মানসিক সাহস, বুদ্ধি, স্বদিচ্ছা থাকা লাগে, তা তাদের নেই। বাধ্যগত ভাবে এদের পরিবার, স্বজন, বন্ধু রা যেটা- যেরকম টা নির্দিষ্ট করে দেবে, আদর্শ ছেলে সেটি পূর্ণ করবে তাদের জন্য। এরা ভাগ্যে বিশ্বাসী, কর্মে নয়। যন্ত্রমানবের মতন, এক্কেবারে পারফেক্ট!
ঈদের ছুটিতে তিনটা প্রপোজাল দেখা হয়েছে। তিনটাতেই আকাশ বাজিমাত করেছে। পরিবারে যাচাই বাছাই চলছে। মায়ের পছন্দ ডাক্তার, বাবার ইঞ্জিনিয়ার, বোনের পছন্দ হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো সুন্দরী। কারও প্রয়োজন নেই আকাশ কে জিজ্ঞেস করে তার কি পছন্দ।
বাসে আকাশের এবারের সহযাত্রী একজন মদ্ধবয়স্ক। মনে হয় বিলেত ফেরত। কিছুক্ষণ পর পরই লোকটা বলে উঠছে, ‘’ ওহ নো, শিট! কি হবে এই দেশের!’’ কয়েকশ বার শুনে ফেলেছে আকাশ তার এই ডায়ালগ। লোকটা বেশ কয়েকবার আকাশের সাথে খেজুরে আলাপ করতে চেয়েছিল, আকাশ জি জি বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এই লোক রাজহাঁস গোত্রের। সুযোগ দিলেই প্যাঁক প্যাঁক শুরু করবে।
আকাশের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে পাতিহাঁস টা! জি জঘন্য! কয়েকবার ঠেলে দিল। এরপর ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাল।
আপনি মাথা সোজা করে ঘুমান দয়াকরে!’’
“‘’ ওহ নো, শিট! কি হবে এই দেশের!’’
“আজব তো, আপনি আমার কাঁধে ঘুমাচ্ছেন, আমার বিরক্ত লাগছে। এর মধ্যে দেশ আসল কোত্থেকে??” বলতে গিয়েও বলল না আকাশ। তার চেয়ে নীরবতা ভালো। আকাশ একটা কাজ খুব সুনিপুণ ভাবে করে। How to avoid people!!
জার্নিতে কোনদিন তার ঘুম হয় না। অথচ সেদিন কত প্রসন্ন হয়েই সে ঘুমিয়েছিল নীরার কাঁধে মাথা রেখে! আচ্ছা, নীরার ও কি সেদিন এমন বিরক্ত লেগেছিল? মেয়েটার কিছুই তো জানে না। তবুও মেয়েটার সাথেই সে তার জীবনের সবচেয়ে সাহসী কাজ টা করেছে। তার ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছে, বড় নাটকীয় ভাবে! কেন করেছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। মেয়েটা আহামরি টাইপেরও না। মনে একটা অস্বস্তি চেপে বসে!! আজ এতদিন হয়ে গেল, নীরা একটা ফোন করল না! নীরার ফোনের অপেক্ষা করে আকাশ। চাতকের মতো! কেন জানে না। চোখ বন্ধ করে আকাশ। কোথা থেকে যেন বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসছে! চমকে উঠে আকাশ। চুল টানতে থাকে সে, পুরো জার্নি জুড়ে! হেডফোনে বাজতে থাকেঃ
“জাগরণে তারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশে
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়, বাঁধিব স্বপন পাশে,
এত ভালোবাসি, এত যারে চাই
মনে হয় নাতো সে যে পাশে নাই
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে তাহারে আনিতে ডাকি
দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।।“
অফিসের লাঞ্চ টাইমে, বন্ধুদের সাথে টঙের আড্ডায় আকাশ ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে। সাধারণত আননোন নাম্বার রিসিভ করে না। গত একমাসে সে সবগুলো ফোন রিসিভ করেছে। এমনকি নীরার করা টিকিট টিও তার কাছে আছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাজার বার ওটাকে দেখেছে আকাশ, কোন ধরনের তথ্য বের করা যায় কিনা!! ওখানে কেবল লেখাঃ
নামঃ নীরা
যাত্রাঃ ঢাকা
গন্তব্যঃ চট্টগ্রাম
মেয়েটা কেন ফোন করছে না, এর কিছু কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে আকাশ।
১) নীরা ব্যাপার টা ভুলে গেছে। ফোন করাটাকে এত জরুরী কিছু মনে করছে না নীরা।
২) ওত নাটকীয় ভাবে নাম্বার দিয়ে আসাটাকে নীরা হেংলামো মনে করছে।
৩) নীরা আমার উপর বিরক্ত। আমাকে সে তার যোগ্য মনে করছে না।
৩) ফেলে আসা বইটা নীরা আদৌতে দেখেই নি।
৪) নীরা বইটা পরবর্তীতে হারিয়ে ফেলেছে।
৫) নীরার কি প্রেমিক আছে?
৬) নীরা কি বিবাহিত? সন্তান আছে?
৭) নীরা কি ডিভোর্সি? আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়?
৮) নীরা কি পুরুষ বিদ্বেষী? কোন ছেলেকেই বিশ্বাস করে না?
৯) নীরা কি অন্য ধর্মের, অন্য গোষ্ঠী?
সব শেষ যে কারণ টা মাথায় আসছে, তা দেশের সাম্প্রতিক কারণে,
১০) হতে পারে নীরা কে ছেড়ে আসার পরই বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে। আর ওখানে নীরা.........
না, না......... আকাশ কুঁকড়ে যায়।
“ আরে বাবা, একটাতো ফোন করা যায়। মেয়েদের মন বোঝে সে কোন মহাপুরুষের সাধ্য! স্বয়ং বিধাতাই নাকি বোঝেন না! আর কেনই বা আমি বারবার নীরার কথা ভাবছি! অনেক অনেক সহযাত্রী মতোই সেও কেবল একজন সহযাত্রী। ওটা কি প্রেম?? কি সব টিনেজ মার্কা চিন্তা! ধ্যাত! প্রথম দর্শনে প্রেম, এসব নাটক, সিনেমায় ভালো লাগে। আমিতো আদর্শ ছেলে, এসব আমার হতে নেই। যাই হোক একটা ফোনতো করতে পারতো মেয়েটা! কিছুই না হোক, একটা নিখাদ বন্ধুত্ব তো হতে পারতো! সাধারণ একটা মেয়েকে নিয়ে এতসব নাটকীয় চিন্তা করারই দরকার কি? Who the hell is she? ভাললাগা, অস্থিরতা, অপেক্ষা......... বড় নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে! Common Akash, don’t be emotional.. Be a man! Act like a perfect man!“ নিজের সাথে ক্রমাগত কথা বলতে থাকে।
তাছাড়া এখন যদি নীরা ফোন ও করে বসে, যদি তারা একে অপরের জন্য ভালোবাসা অনুভব করেও ফেলে, তাও তো আকাশ হিরোয়িক কিছু করে ফেলতে পারবেনা। আদর্শ ছেলেরা পরিবারের বিপক্ষে কিছু করতে পারে না। প্রেমের জন্য যুদ্ধ করা আদর্শ ছেলেদের জন্য বড় লজ্জার।
এতসব টানাপোড়নের মধ্যে একটা সুসংবাদ আসে আকাশের জীবনে। তার বিয়ে ঠিক হয়। মা পছন্দ করেছে। মেয়েটাকে আকাশও দেখেছে। নেক্সট উুয়ীক এ তার আংটি বদল অনুষ্ঠান। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘নীরা পর্ব’ ভুলে যাওয়া উচিত। Thad memory of Neera is just an accident! A past! আদর্শ ছেলেদের ভুলতে হয় খুব তাড়াতাড়ি।
অসহ্য এক মাথা ব্যথা নিয়ে আকাশ ওয়েটিং রুমে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। দুদিন পর তার আংটি বদল অনুষ্ঠান। চট্টগ্রাম যাবে। সেই একই ওয়েটিং রুম, যেখানে সে নীরা কে পেয়েছিল! মাথা ব্যথার কারণ টা হল, আকাশ খালি বেলি ফুলের গন্ধ পায়। সর্বক্ষণ, সর্বত্র সে নীরার গায়ের সেই বেলি ফুলের ঘ্রাণ পায়!! উফ!! কি অসহ্য যন্ত্রণা!! এখানটায় আসার পর সেটা যেন আরও চেপে বসেছে!
ফোন বাজছে। “ বাবা, তুই কই?’’
“ মা, এইতো বাসে উঠবো। বাস চলে এসেছে। পরে কথা বলব।“
আবার ফোন বাজছে। মাথা ব্যথা চরমে পৌছে গেছে। উফ!! এই ঘ্রাণ!!
চোখ বন্ধ করে ফোন ধরল আকাশ।
“ হ্যালো!”
“ হ্যালো, আকাশ বলছেন?’’
“জি বলছি। কে?”
“ আমি নীরা।“
“নীরা.........!!!”
“জি চিনেছেন? না চেনারই কথা। সরি আমি মনে হয় অনেক দেরী করে ফোন করেছি। আসলে হয়েছে কি...............”
ফোনের অপর প্রান্তে আকাশের হবু স্ত্রী ফোন করে চলেছে। কল ওয়েটিং.........
উপরের আকাশে কালো মেঘ গুলো খুব দুরন্ত গতিতে ছুটছে। আকাশ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, এ পৃথিবীর কিছুই যেন সে শুনতে পায়না।।
বাসের সুপারভাইজার ডাকতে থাকে। স্যার, সব যাত্রী উঠে গেছে। বাস এখুনি ছাড়বে। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। যাবেন না???
....................................................................................................।
** এবারের গল্পটাকে যদি কেও "হঠাৎ দেখা আকাশ" এর পরবর্তী অংশ মনে করে পড়ে থাকেন, তবে কোন ক্ষতি নেই। বরং আমিও তাদের দলেই। আর যদি কেও একেবারেই আরেকটি নতুন কাহিনী, মনে করে পড়েন, তবে তাদেও সাধুবাদ জানাই। তাদের জন্যই বরং নতুন একটি নাম দিয়েছি।
আমার লেখা পড়ে যে ভালোবাসা আপনারা দেখিয়েছেন, তা আশীর্বাদ স্বরূপ আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ভালো রাখুন--ভালো থাকুন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



