আজকে সে বিয়ে করবেই। মেয়েকে নিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয়ে আছে সকাল থেকেই। আমাদের কয়েকজনকে হতে হবে সাক্ষী। খুব কাছের বন্ধু বলে আজ এই শাস্তি পেতে হচ্ছে। সকাল থেকে সেজেগুজে মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে সত্যি খুব সুন্দর লাগছিল। এর আগেও তাকে দেখেছিলাম পহেলা বৈশাখে। তবে এখন যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তাকে। ওদের দুজনকে দেখে যেকেউই বলবে সদ্য বিবাহিত কাপল। তাদের চোখেমুখেও সেরকম বর-কণে ভাব। বোঝাই যাচ্ছিল তারা এই সিন্ধান্ত নিয়ে বহু ভেবে চিন্তে। যাই হোক এক পরিচিত কাজীর অফিসে গেলাম সবাই। কাজী বলল বিয়া হবে না। ছেলের বয়স ২১ এর কম। বলদে সার্টিফিকেটে জন্ম সন দিয়ে রাখসে ১৯৯১। অর্থাৎ বর্তমান বয়স ২০। ওরে দেখলে মনে হবে ২৮ বছরের বুইড়া, শরীলটাও তেমন বড়সড়। মেয়েরা সাধারণত বয়স লুকায়। কিন্তু সার্টিফিকেটে বয়স লুকানোতে ছেলেরাই চ্যাম্পিয়ান। কিন্তু তাই বলে ৫-৭ বছর কেউ লুকায় না। বিয়ে আর হবে না। না, বিয়া হইবোই, আর আজকেই করুম বিয়া। একদিন পরে কালকে কর। আরেকটু প্লানিং করে, গুছিয়ে কালকে কর। একটা দিনই তো। না, বিয়া করলে আজকেই করুম, কালকে আজকে একই কথা। কালকে আবার পাঞ্জাবি শাড়ি পইরা আসতে পারুম না, ওর মায় সন্দেহ করবো। আজকেই ব্যবস্থা কর। মনে মনে ভাবলাম শালার ভেরা উঠসে, ওরে আজকেই বিয়া করাইতে হবে। মেয়ের চোখে মুখেও একই ভাব। বের হইসি বিয়া কইরাই ঘরে যামু। পরিচিত কাজী হাত ছাড়া হইলো। শালায় কোথায় একটু সাহার্য্য করবে... উল্টা আইন আদালতের ভয় দেখাইলো।
যাই হোক দুপুরের খাবার দাওয়ার শেষ করে আবার কাজী অফিস খোঁজা শুরু করলাম। একজায়গায় রাস্তার পাশে দেয়ালে বড় করে লেখা কাজী অফিস সাথে মাবাইল নম্বর। ফোন দিয়ে অফিসের ঠিকানা জানতে চাইলাম। বলল- ঐখানেই দাড়ান আমি আসতেছি ওয়ান মিনিট। ভাবলাম- সে জানলো কি করে আমরা কই আছি। ৩০ সেকেন্টের মাথায় হাজির হইলো। বিয়া কার কার? এই দুইজনের। পালায়া বিয়া? হ, আপনার অফিস কোথায়। অফিস এখানেই। ডানে বামে তাকিয়ে বল্লাম এখানে...রাস্তায়? হ, রাস্তায়। ফাইল পত্র- দলিলতো আমার ব্যাগেই আছে। এক কোনায় বসে সাইন করে দিলেই তো হইয়া গেল বিয়া। বিয়ের কোন আয়োজনই আমরা করছিনা। নূন্যতম আনুষ্ঠানিকতটা নূন্যতম ভাবে হলেই হলো। কিন্তু তাই বলে এতটা শর্টকাট। আর রাস্তার কোনায় বসে বিয়া পড়ানো- এমনতো জিন্দিগিতেও শুনি নাই। কাজীদের কিছু থাকুক আর না থাকুক- একটা অফিসতো থাকা দরকার। তাইতো নাম দেয় কাজী অফিস। কাজী সাহেব বুঝতে পারছে আমরা রাস্তার কোনায় বসে বিয়া পরাতে রাজি না। ওক্কে ঠিকাছে- একটা রুম আর চেয়ার টেবিল দরকার তো? তারও ব্যাবস্থা করতেছি, আসেন আমার সাথে। দুই মাইল হাঁটিয়ে একটা পুরানা বিল্ডিয়ের সামনে সবাইকে দাঁড় করালো। শালারে রাস্তায় কয়েকবার জিজ্ঞেস করছিলাম আর কতদূর। বলে এইতো সামনেই। এইতো সামনে করতে করতে দুই মাইল হাঁটাইলো। একজন আমার সাথে আসেন। বাকিরা দুইজন দুইজন করে পাঁচ মিনিট পরপর তিন তলায়া হাতের ডান দিকের রুমে আসবেন। কাজী সাহেব চলে গেল বিল্ডিয়ের ভেতর। ওদিকে মেয়ের অবস্থা খারপ। সারাদিনের সেই গ্লেমার আর নেই তার চেহারায়। আর কত, সেই ভোর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাচ্ছি বিয়া করাবো বলে। কখন যে সন্ধা ঘনিয়ে রাত আটটা বেজে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর এতসব কাহিনী করে এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম আমরা? রাত বাড়ছে, মেয়ের বাসায় যেতে হবে। এতগুলো ছেলের মাঝখানে সে একা দাঁড়িয়ে আছে। অন্যরমক ভাবে দেখলে, একটা সুন্দর যুবতি মেয়ে কায়েকটা ইয়াং ছেলের সাথে দাড়িয়ে আছে রাতের অন্ধকারে একটা পুরানো বিল্ডিয়ের সামনে। আশেপাশের লোকজন কি ভাবছে আল্লায় জানে। বিষয়টা আমাকেও সস্থি দিচ্ছেনা। আর এখানে কেন শব্দ করা যাবে না, কেনই বা দুজন দুজন করে বিল্ডিয়ে ডুকতে হবে- বেপারটা বুঝলাম না। ভেতরে ভেতরে কিন্তু ভালোই খাবড়ে গেছি আমি। বিয়ে করাইতে আসলাম নাকি মেয়ে পাচার কারাইতে। গতবছর হিজবুত তাহরিরের মামলায় ১০-১২ দিন জেলে ছিলাম, তার উপর এখন যদি নারী পাচার মামলায় ফাসায়া দেয়!! আমিতো শেষ। বর্তমানে দেশে সুশিলসমাজ ভগতি-প্রগতিরা যেভাবে নারিমুক্তি নিয়ে বগল বাজাইতেছে তাতে নিশ্চিত আমার যাবৎজীবন কেউ ঠেকাইতে পারবে না। আমার তো ক্যারিয়ার এখানেই শেষ। মনে মনে ঠিক করলাম, ওরে আরেকটু বোঝাই। এত রিক্স নেওয়ার কাম না, বিয়া কালকে করিস। এই লোডশেড়িং এ বিয়া করলে জীবনে আর আলোর দেখা পাবিনা। কথাগুলো মুখফুটিয়ে বলার আগেই সে মেয়েকে নিয়ে বিল্ডিয়ের ভেতর রওনা দিল। আমিও গেলাম। বিল্ডিয়ের এমন এক অবস্থা বোঝার উপায় নেই- এটা কি তৈরি করা হচ্ছে না ভাঙা হচ্ছে। আজকে মনে হয় শহীদ হয়ে যাব।
যাই হোক, কাজী সাহেবের রুমে আল্লার রহমতনে সবাই পৌঁছালাম। বুঝতে পারলাম, বাড়ির মালিক এখানে অফিস করার অনুমতি দেয় নাই। লুকিয়ে অফিস চালান তিনি। তাই দুজন দুজন করে বিল্ডিয়ে ডুকতে বল্লেন। মেক্সিমাম বিয়ে নাকি তিনি রাস্তায় পড়ান। বিশেষ অনুরোধে নাকি তিনি আমাদের অফিসে নিয়ে এলেন। আমাদের তাড়া ছিল, কারণ রাত বাড়ছে মেয়েকে বাসায় পৌঁছে দিত হবে তাড়াতাড়ি। কিন্তু কাজী সাহেবকে দেখে মনে হলো তার তাড়া আমাদের চেয়েও বেশি। দু সেকেন্ড অপচয় করতে রাজি নন তিনি। একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বল্লেন- এখানে সাক্ষিদের নাম ঠিকানা সহ স্বাক্ষর করতে হবে। আল্লায় জানে কোন পাপ করতে যাচ্ছি। একে একে সবাই স্বাক্ষর করলাম। তিন চার পাতা একসাথে পিন মারা ছিল। পাতা উল্টায়ে দেখলাম এই বিয়ের কারণগুলো। পয়েন্ট আকারে লিখা-- তারা অনেক দিন যাবৎ মেলামেশা করে, একজন আরেকজনকে মুখ না দেখে থাকতে পারে না, রাতে ঘুম হয় না, পরিণত বয়সের জ্বালা তাদের তাড়া করেছে এবং আইন অনুযায়ী পরিণত বয়সেই তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়,......... আরো হাবিজাবি। লেখাগুলা পড়ে আমি নিঃশব্দে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। তারপর শব্দ করেও হাসলাম। আজিব, আমরা তো উনাকে এসব কিছুই বলি নি। তাছাড়া কাগজগুলা অনেক আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছেন উনি। আসলে কাজী সাহেবরা এসব আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখেন। কারণ কোন সাধারণ বা পারিবারিক বিয়ে এভাবে কাজী অফিসে বসে হয় না। মেক্সিমাম পালিয়ে বিয়েগুলো কাজী অফিসে গিয়ে হয়। কাজী সাহেবরা জানে এইসব পালিয়ে বিয়ে করার কারণগুলো। তাই উনারা উনাদের মত করে কিছু লিগ্যাল ডকুমেন্ট আগে থেকেই তৈরি করে রাখেন। যেন পরবর্তীতে আইনগত কোন সমস্যায় পড়তে না হয়।
যাই হোক, এসে গেল সেই অন্তিম মূহুর্ত। এখনই তারা কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। বিবাহ, জনম জনমের বন্ধন, সেই মুহর্তটার স্বপ্ন দেখে যুবক যুবতিরা তাদের কৌশোরের অধিকংশ সময় কাটায়। কাজী সাহেব তাদের শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছেন- বেগম অমুক, পিতা অমুক মাতা অমুক কে এত টাকা কাবিন বাবদ স্বইচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি। হ.. হ.. রাজি রাজি রাজি... কাজী সাহেবের শেষ না করতেই আমার বন্ধু বলে উঠলো। ওর কান্ড দেখে আমরা সবাই হাসলাম। সে জীবনের একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, ওর মধ্যে এই অনুভূতির লেশ মাত্র নাই। এবার মেয়ের পালা। জনাব অমুক, পিতা অমুক, মাতা অমুক কে এত টাকা কাবিন বাবদ স্বইচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি। মেয়ে চুপ। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কোন কথা নাই। হঠাৎ বঝতে পরলাম সে কাঁদছে। কাজী সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শপথ বাক্যটি আবার পাঠ করলেন। মেয়ে নিঃশব্দে অঝরে কাদতে থাকলো। কোথাও কোন টুশব্দ নেই। বাহিরে রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, রিক্সার ক্রিংক্রিং ও যেন বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে স্তব্দতা নেমে এলো। আমরা অপলকে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছি। শতহো্উক সে একজন নারী। একটা ভুল সিন্ধান্ত তার জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আবেগে টিকতে না পেরে হয়তো সে বিয়েতে রাজি হয়েছে, সারাদিন হেসে খেলেই কাটিছে আজ। কিন্তু বিয়ে বলে কথা, তাও আবার পরিবারকে না জানিয়ে। জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্তটি এখন সে নিতে যাচ্ছে। অসহায়ের মত কাদছে সে। নিস্তেজ হয়ে আসছে তার শরীর, ভেঙে পড়ছে সে। হবু জামাই তাকে পাশের চেয়ার থেকে দুহাত দিয়ে ধরে রাখলো। মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছিল আমার। কাজী সাহেব বললো কান্না কাটির কিছু নাই, সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লার উপর ভরশা রাখ। গলা শুকিয়ে কাঠ কয়ে গেছে তার। সে পানি খাবে। কাজী সাহেব ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির জগ এনে দিল। যদিও সাথে একটা গ্লাস দিলে মেয়েটা ভদ্রভাবে পানিটা খেতে পারতো। যাই হোক জগে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার ফুফিয়ে ফুফিয়ে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে সে রাজি বলার জন্য মুখ খুললো। সাথে সাথে আমরা সবাই বলে উঠলা- রাজি রাজি রাজি......। আমরা বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম। বিয়ের ষোলকলা পূর্ণ হলো। নে শালারা তোদের বিয়ে হইলো শেষমেষ, আজকেই। আবার সব স্বাভাবিক হতে লাগলো। মেয়ের কান্না থামলো। বাহিরে গাড়ির হর্ণ, রিক্সার ক্রিংক্রিং শব্দ শোনা গেল। আসলে অতিউৎসাহ সহকারে কোন কিছুতে মনোনিবেশ ঘটালে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো সাময়িকভাবে অচল হয়ে পড়ে।