গ্রাম থেকে শহরে এসে মেসে থাকি।দারিদ্র্য মানুষকে স্বপ্ন দেখায়।আমি এক বুক স্বপ্ন বুক পকেটে ভরে এসেছিলাম এই জাদুর শহরে।লেখা-লেখি ছাড়া তেমন অন্য কিছু পারিনা।শহরের বড় বড় পত্রিকায় গল্প,কবিতা দিয়ে যা পাই তা দিয়ে সিগারেট, চা আর মেস ভাড়া মিটে যায় কোনরকম। জাদুর শহরে জাদুর সব কারবার! কেউ স্বপ্ন দেখে ইট-সিমেন্টে গড়া বিশতলা অট্টালিকায় বসে আবার কেউ রাস্তার ফুটপাতের ময়লা ঘেষা কোন এক জায়গায় বসে।দারিদ্র্যের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। মাঝে মাঝে বুক পকেট থেকে উঁকি দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখায়।এক বুক স্বপ্ন।নতুন করে ভাবায় ।কিন্তু দিনশেষে ওই বুকপকেটেই পড়ে থাকে বুক পকেটের স্বপ্ন।
মাঝেমাঝে মুঠোফোনে খবর নেই আম্মার। সে তিন মাসের শয্যাশায়ী। ছোট বোন সংসারের যাবতীয় কাজ করে।মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয়।এক অকর্মক পেটে ধরে শেষ বয়সে এসে কতনা কষ্ট করতে হচ্ছে তাকে।বুকে চাপা কষ্ট নিয়েও বড় লেখক হবার আশায় বেচে আছি।খুব ঘুরে টুরে একটা সংবাদপত্রে চাকরি নিয়েছিলাম।তিন মাস বেতন না দেওয়ায় রাগ করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় নিজের উপর, লেখার উপর।রাগ করে লেখালেখি ছেড়ে দিতে মন চায়।কিন্তু এভাবে নিজের আত্মাকে মেরে ফেলা কি ঠিক হবে!দু-মুঠো ডাল ভাতের জোগাড় ছাড়া যেন কেউ যেন সাহিত্যচর্চা করতে না আসে ।
শীতের মধ্যে ছোটবোন চাদর চেয়েছিল। দিতে পারিনি।সিকান্দার চাচা সিগারেট চাবার সাথে সাথে মুখের উপর না করে দেয়।সে নাকি আমার কাছে আর বাকিতে সিগারেট বেচবেনা।আমি বিষন্ন মুখে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার অন্যদিকে চাই।সেও মন্দ বলেন নি।বাকি পড়েছে চার হাজার ৪২ টাকা।এই ছোট পান সিগারেটের দোকানে এই টাকা নেহাত কম নয়।
মাস তিনেক সংবাদপত্রে কাজ করার সময় পরিচয় হয়েছিল অপ্সরার সাথে।এক সন্ধ্যায় আমার শ্যামলা রঙের হাতের উপর হাত রেখে কথা দিয়েছিল,"তোমাকে ছেড়ে যাবো না কোনদিন। বিয়ে করলে তোমাকেই করবো।না হলে আর কাউকে নয়।"দিন পনেরো আগে সে মুঠোফোনে আমাকে জানালো,"আগামীকাল আমার বিয়ে।দাওয়াত রইল।ভুলেও আসবে না।আই হেটু।"চোখ থেকে দু'ফোটা জল বের হবার আগেই বুঝতে পারলাম আর যাই হোক হাজার দুয়েক টাকায় সংসার চলে না।দারিদ্রদের কান্না করে চোখের জল শেষ করতে নেই। চোখের জলের দাম তো অট্টালিকায় থাকা দুলালদের আছে। আমাদের ওসব নিয়ে ভাবতে নেই।
আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে বন্ধু কাইকর পাশে এসে বসলো ।এক মেসে থাকি ।দারিদ্র দারিদ্র্যের মন বুঝে।কাইকর নাট্যকার ।দারিদ্রদের সবার সামনে কাঁদতে নেই।কান্না করার জন্য খোলা মাঠ আছে ,নদীর পাড়ের ঘাট আছে ,পুকুরপাড়ের গাছ আছে।
কাইকর আর আমি দুজন মিলে খোলা আকাশের নিচে বসে ভেতরে জমে থাকা বুকের চাপা কষ্ট গুলো বের করে দেই ।একজন গল্পকার আরেকজন নাট্যকার ।আমরা দুজনেই পথ হারা পথিক।বিষয় মন্দ নয়।
তবুও বেলাশেষে যেন দুজনের চোখের তারা আজও নিভে যায়নি।ভয় নেই,নতুন করে হারানোর কিছু নেই ।খোলা আকাশের নিচে বসে মানুষের মঙ্গল কামনা করি।শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে।রাতের আধারে চাঁদমামা গায়ে আলো ঢেলে দেয়।মাঝে মাঝে মানুষ এসে ভালবাসার গান শুনিয়ে যায়।মাঝে মাঝে পাগল নামের ভালো মানুষগুলো সিগারেটে দম দেবার যোগান দিয়ে যায়।কম দামি সিগারেট খেয়েও হাসি।জাদুর শহরে এখনো কিছু মানুষ আছে যারা স্বার্থ ছাড়াই গাছের মতো উপকার করে।তবে তারাও নীরিহ ।এখনো আদাপেটে শুয়ে বসে মাজায় গামছা কষে বেঁধে গল্প,কবিতা বুনি।নতুন কোন স্বপ্নের আশায়।জাদুর শহরে বুকপকেটে স্বপ্ন পুষে রাখা, পাগল নামের ভালো মানুষগুলো একসাথে মিলে ভালোই আছে ।সুন্দর আছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:৫২