নদীর পাড়ের কড়ই গাছের উপরে বইয়া আছি। হালকা পাইনসা বাতাসের লগে সন্ধ্যা নামুনের আগের সূর্যের আলো গায়ে মাইখা হুন্দরী কুলসুমের রুপের জলে ডুব দেওয়ানের কথা ভাবতাছি। গলার গামছা মুহে লইয়া। মাইয়াডারে দেহুন যাই করিম চাচার ক্ষেতের জাতি লাউ গাছের ডোগার লাহান। এক্কেবারে ধলা -ফক-ফকা চাঁদের লাহান।
ইশ.....কুলসুম যদি আমার বউ হইতো তাইলে ঘর থাইকা বাইর হইতাম না টানা তিনমাস। নাহে-মুহে তাজা সরিষার তেল লাগাইয়া কুলসুমের বুকের উপুর মাথা রাইখা ঘুম দিতাম তিনমাসের মনে।
হঠাৎ কইরা আমার তিমাসের হংসারে আগুন লাগাইয়া খেয়াঘাট থাইক্যা ডাহুন শুরু কইরা দিল মন্ডল চাচায়। আমি ধপাস কইরা মাঠিতে পইরা গেলাম। ইট্টুহানি মাজায় ব্যাথা পাইছি মাগার মন্ডল চাচারে বুঝবার দেইনাই। মন্ডল চাচায় গ্রামের হকল মুরুব্বী গো চাইতে মজবুত। এহোনো তারে বিয়া করাই দিলে একদমে হংসার চালাই যাইবো বিষ বছর। যৌবনকালে যে মন্ডল চাচাই কত মাইয়ারে ঠিক রাখছে হেইডা তার চাহুনি দেইহাই টের পাই। আর আমার হালার পোড়া কপাল! কুলসুম আমার মনডারে এহনো ইট্টূ বুইঝলো না।
মাজায় গামছা কইষা বাইধা মন্ডল চাচারে নিয়া টান মারলাম নৌকা। বইটার শব্দের লগে বেসুরা গলায় ভাটিয়ালি গানে টান মারলাম। এই নদীর লগে আমার খুউব ভালা সম্পর্ক। মন খারাপ হইলে নদীর টাকি মাছগো লগে কথা কই। নদীর কিছু মাছ আমার খেকুরা গলা হুইনা জাইগা উঠলো। টাকি মাছে কইয়া উইঠলো, "ওই বোকা হালা হুন - নদীর মইধ্যে এইহব চ্যাকা খাওয়া গান চুলে না। টুই তো হালা বোকারাম। আমি টাকি মাছ হইয়া ইলিশের লগে প্রেম-ট্রেম করি আর তুই শালা কুলসুমরে ভালবাসুনের কথা কইতে পারুস না। তোর নদীর মইধ্যে গান গাওয়া বন্ধ। তাছাড়া তোর গলার কন্ঠে গন্ধ! আমি মনকষ্টেও হুইনা দাত বাইর কইরা হাসি।
খেয়াঘাটের জীবন আমার। মাঝি আমি। হারাদিনে যা পয়সা-কুড়ি পাই তা দিয়াই কোনরহম চুলি। দুপুর বেলায় কুলসুম নদীর পাড়ে পানির লাইগা আইলে মনডায় টান দেয়। কত না কইবার মনডা চাই, কুলসুম আমি তরে ভালাবাসি। হত্যি কইতাছিরে কুলসুম তরে আমি মেলা ভালাবাসি। কইবার পারিনা!
ধানক্ষেতের আইলপথ দিয়া চোখ বুইজা হাটতাছি। কিছু সাদা কইতরের দল হুন্দর গলায় বাকুম বাকুম করতাছে আর পাকা ধানের সোনালী শিষে ঠুক মারতাছে। মাঝে-মইধ্যে দূর থাইক্যা বাতাস আইয়া আমার ময়লা চুল উড়াই দিতাছে। আমি পায়ের লুংগি রান হাটুতে তুইলা কাচা ঘাসের উপর দিয়া দৌড়াইতাছি। আহ.....কি হুন্দর বাংলাদেশ। মাঝে-মইধ্যে পাশের গ্রামের কালাচান পাগলের লাহান উবুত হইয়া শুইয়া হামাগুড়ি দিতাছি কুলসুমরে ভাইবা।
আইজ শনিবার। কাচা ছনের বেড়ার লগে একখান মেলা বড় চাঁদের লাহান আয়না ঘরের মইধ্যে লাগাইছি। কুলসুমরে আজ কমুই কমু..... আমার ভালাবাসার কথা। তাই ঘর থাইক্যা বাইর হবার আগে মাথায় আচ্ছামতো তেল মাখছি। সাদা চিকুন চিড়ুনি দিয়া মাথার মইধ্যে দিয়া যমুনা নদীর লাহান হিতি করছি। মাজার লুংগি ইট্টু নিচে নামাই পড়ছি লগে গামছা গলাই ঝুলাইছি। গ্রামের হগলে আমারে দেইখা কইতাছে নায়ক।
আমি ভাব ধইরা সালবাগানের পথ ধইরা খেয়াঘাটে যাইতাছি। কুলসুমরে আইজ কমুই..... কমু। সাহস বাড়াবার লাইগা সাল বাগানের মোটা গাছরে ধইরা কইলাম, কুলসুম আমি তরে ভালাবাসি। তরে আমি শেষ রাইতে মইধ্যে নদীর মাঝে লইয়া গান শুনামু। তর লগে ভালবাসাবাসির দুইটা কথা কমু। তরে লইয়া সংসার সাজামু। আমাগো ছোট্ট সংসারে আইবো লাল টকটকে একখানা মাইয়া। তরে কইবো মা আর আমারে আব্বা। তুই ভাত রাইন্দা বইয়া থাকবি আমার লাইগা। আমি আইয়া তরে বুকের মইধ্যে জড়াই নিয়া কমু ছরি। তারপর, দুইজনে মিলা মাঠিতে বইয়া চাকুম-চুকুম কইরা খামু।
হঠাৎ কইরা চোহের কোণাই নদীর জল। আইজ থাইক্যা দুই বছর আগেই কুলসুম নদীর পানিতে পইড়া মারা গেছে। মাইয়াডা সাতার পারে নাই। আমার খুউব কাছের নদী আমার কুলসুমরে মাইরা ফালাইছে। আমার ভালাবাসারে নদীর জলে ভাসাই দিছে। আমি কুলসুমরে কইতে পারিনাই। কইতে পারি নাই, কুলসুম আমি তরে খুউব ভালাবাসি, মেলা ভালাবাসি তরে কুলসুম। এহন আমার বুক ফাইটা কান্দুন আহে। জোরে কইরা চিক্কুর দিবার মনডা চাই। দিবার পারিনা......
আমার এহন জোরে কইরা চিক্কুর দিয়া কইতে মন চাই, ভালাবাসি তরে কুলসুম...........মেলা ভালাবাসি। আই ফিরা আই, নদীর বুকে মাথা রাইখা এহন কুলসুমরে খুজি। আমার কুলসুমরে। যারে আমি মেলা ভালাবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:০৬