somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(গল্প) জীবন ও জলুস্তির চক্র

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৩:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
নতুন ঘর লেপার জন্য সারা সকাল মাটির ঢেলা ভেঙে আর দুপুরে খড়ের গাদা তৈরি করে অবসন্ন হয়ে উঠল ছমিরণের শরীর। কুটকুট করা শরীর নিয়ে গা ধুতে গেল সে।

চৈত্রের কাঠফাঁটা দুপর শেষে ক্লান্ত, বিষণ্ণ অপরাহ্ন, তপ্ত হাওয়ার হলকা বইছে মৃদু। এখনও উষ্ণ ছোট্ট নদীটির গা, অবশ্য ডুব দিয়ে একটু গভীরে গেলেই শীতল। আহ্‌, জলের কী স্নিগ্ধতা! ছমিরণ বিবি শিশুর মতো মেতে উঠল ডুব খেলায়।

নীল আকাশে চক্কর দিচ্ছে লালরঙা চিলের দল, তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটোছুটি করছে সাদা মেঘ। মাঝেমাঝে সূর্যের একেবারে সামনে এসে পড়ে মেঘেরা, রৌদ্র সরে গিয়ে তখন বেরিয়ে আসে তাদের ছায়া, সরসর করে বোরো ধানের ক্ষেতের উপর দিয়ে, সাদা কাশফুল পেরিয়ে, নদীর আরো গভীরে চলে যায়; এক সময় হারিয়েও যায়। বেশ চলছে এই মেঘ, রৌদ্র-ছায়ার খেলা।

ডুব-সাঁতার দিতে দিতে আর রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে মাঠের মধ্যে বিশাল বটগাছটির উপর হঠাৎ চোখ পড়ে ছমিরণের, তার পাশ ঘেঁষে দৃষ্টি সরে যায় আরো দূরে, ঈষাণ কোণে। আকাশের গায়ে ঝুলছে এক টুকরো সিঁদুরে মেঘ, বছরের প্রথম জলুস্তি কোনো সন্দেহ নেই।

"নাপিত বাড়ির বৈশাখি মেলার আগে, চোখ রাখবা বট গাছের ফাঁকে," মুরুব্বিদের কথা মনে পড়ে যায় ছমিরণের; আশঙ্কায় কেঁপে উঠে তার বুক। বড় খারাপ জিনিস এই জলুস্তি, লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় সব, মানুষও মারা পড়ে। জলুস্তির পরেও সময় খুব খারাপ। শিলাবৃষ্টি নষ্ট করে যায় ফসল; কফাত লাগে দেশে। কয়েক বছর আগে কফাতে কত মানুষই না মরল না খেয়ে!

সিঁদুরে মেঘটি কালচে বর্ণ ধারণ করে ধেয়ে আসে দ্রুত, অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় জল থেকে উঠে পড়ে ছমিরণ। টিনের চালে লাল মরিচ আর উঠোনভর্তি ধান রেখে এসেছে সে, এক ফোঁটা বৃষ্টি লাগলে নষ্ট হয়ে যাবে সব, না খেয়েই থাকতে হবে নতুন বছর। অসহায় ভয়ে পাগলের মতো বাড়ির দিকে ছুটে ছমিরণ, বেশ অনেকটা দূরেই তার বাড়ি।

বাতাস পড়ে যায় হঠাৎ, ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে উঠতে থাকে চারপাশ। ভয়ঙ্কর এক লালিমা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাকাশে। ছোট ছোট বানকুড়ালি সৃষ্টি হয় গাঁয়ের সড়কে, ধুলোবালি, খড়কুটো, গাছের পাতা পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠতে থাকে। দৌড়ে এসে বানকুড়ালির ভেতর ঢুকে পড়ে এক দল বালক, পরস্পরকে খোঁচাতে খোঁচাতে হেসে উঠে তারা।

"অই হার্মাদের পুতেরা, বাড়িত যা তাড়াতাড়ি। জলুস্তি আইতাছে মিসমার কইরা!" পাশ দিয়ে যাবার সময় চিৎকার করে তাদের সাবধান করে ছমিরণ। হার্মাদের পুত্রদের অবশ্য জলুস্তির আগমন সংবাদে চিন্তিত হতে দেখা যায় না। বানকুড়ালিটা সড়ক থেকে নেমে পড়ে জমিতে, বানকুড়ালির পেছন পেছন ছুটে যায় তারা।

ছমিরণ যখন বাড়ি ফিরল, অদ্ভুত, ঘোর-লাগা ঘোলাটে আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। বাঁশঝাড়ের মাথায় সাদা বক উড়তে থাকে। নিরাক-পড়া চারপাশের ভেতর থেকে একেবারে হঠাৎই শুরু হয়ে গেল লাগামহীন বাতাসের শোঁ শোঁ গর্জন। অনেক বড় জলুস্তি হবে এবার!

"কৈ গো বউ, কৈ গেলা? তাড়াতাড়ি ধান মরিচ তোল, জলুস্তি আইতাছে।" এলোমেলো চুলে লুটিয়ে পড়া আঁচলে ঘরের ভেতর লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ে ছমিরণ।

ঘর লেপা শেষ করে তখন কেবল খেতে বসেছে নতুন বউটি, শাশুড়ির ডাকে ত্রস্ত হয়ে উঠল সে। ভাতের থালায় চোখ পড়ে ছমিরণের, দপ করে জ্বলে উঠে তার চোখ, "নবাবের বেটি, দ্যাহস না, জলুস্তি আইছে?" হিংস্রতর হয়ে উঠে ছমিরণের চোখ, উঁচু হয় তার গলা, "সব ভিজ্যা গেলে কী খাবি, কোন বাপ খাওয়াবে তোর, ছিনাল বেটি?"

আরো জড়োসড়ো হয়ে উঠে নতুন বউ, বুঝে উঠতে পারে না কী করবে সে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল মনে হয়। ছোঁ মেরে ভাতের থালাটা কেড়ে নেয় ছমিরণ, ছিটকে মাটিতে পড়ে বেশ কিছু ভাত। বউয়ের চুল ধরে উঠানের দিকে হিড়হিড় করে তাকে টানে ছমিরণ, ঘরের চৌকাঠে লেগে কেটে যায় তার কপাল। ছড়িয়ে পড়া ভাতগুলোতে একপাল মুরগি এসে জুটে।

আঁচলে এঁটো হাত মুছে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে বউটি। কাজ করতে পারে সে অমানুষিক, কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণাও তীব্র তার। প্রথম বার যখন সে এ বাড়িতে আসে, মা বারবার বলে দিয়েছিলেন কম কথা বলতে আর কম খেতে—একজন ভালো বউয়ের এগুলোই হচ্ছে আসল গুণ। ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা অবশ্য করেই যাচ্ছে সে, কথা বলে খুব কম। কিন্তু ক্ষিধেটা তেমন সামাল দিতে পারে না, মাঝেমাঝে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সেটি। ব্যাপারটি তাকে খুব লজ্জিতও করে, বিশেষ করে শাশুড়ি যখন পড়শিদের কাছে তা বলে বেড়ায়।

উঠোন থেকে ধান আর মরিচ তুলে ঘরের কোণে ছুঁড়ে দিতে দিতে দ্রুতই ক্ষুধার কষ্টটি ভুলে যেতে পারে নতুন বউ, কারণ চৌকাটে লেগে কেটে যাওয়া কপালের ব্যথাটি তার তীব্রতর হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। কোনোমতে জিনিসগুলো ঘরের কোণে রাখা শেষ হতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, চমকায় বিদ্যুত, আর ভয়ঙ্কর শব্দে বাজ পড়ে। দমকা হাওয়া প্রবল আক্রোশে গাছপালা উপড়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা ভেঙে ভেঙে সাদা ফেনার মতো ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। অঝোর সেই বৃষ্টির ধারায় কপালের ব্যাথাটিও দ্রুত ভুলে যায় নতুন বউ, কারণ দু'চোখ বেয়ে তার নেমে এসেছে লোনা জলের ধারা; ধীরে ধীরে কাদামাটিতে মিশে হারিয়ে যায় সে ধারা।

২.
১৯ বছর পর।

নতুন বউ পুরাতন হয়েছে বেশ। জলুস্তির পরের বছরই পুত্র সন্তানের মা হয়েছিল সে, তার পরের বছর, তারও পরের বছর। বাড়িটিতে ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠে বউটির গলা, আর সেসাথে ম্রিয়মাণ হচ্ছিল ছমিরণের গলা। হাঁপানিতে ভুগে ভুগে ক্ষীণতর গলায় তিন বছর আগে মারা যায় ছমিরণ, মরার আগে জবান একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। বেশ ক'বছর ধরেই বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী এখন পুরাতন বউ।

উনিশ বছর পর বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে পড়ন্ত এক বিকেলে কাজ শেষে গা ধুতে যায় পুরাতন বউ, রৌদ্র-ছায়ার খেলা নদীতীরে। ঈষাণ কোণে চোখ পড়তেই সিঁদুরে মেঘটি দেখতে পায় সে। জলুস্তি, কোনো সন্দেহ নেই! নদী থেকে দ্রুত উঠে পড়ে পাগলের মতো বাড়ির দিকে ছুটে পুরাতন বউ, মরিচ আর মসুর পড়ে আছে উঠানে।

"জলুস্তি আইতাছে, জলুস্তি, মিসমার কইরা।" চিৎকার করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করে পুরাতন বউ, নতুন বউটা তার সদ্য খেতে বসেছে তখন। শাশুড়ির চিৎকারে ভয়ে ভয়ে তাকায় সে, আঁচলে দ্রুত হাত মুছে উঠে পড়ে সে।

আলোর ঝলকানিতে ভরে যায় চারপাশ, প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ে। বাজের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যায় পুরাতন বউয়ের ক্রুদ্ধ গলা, "উঠবা না বউ, উঠবা না। ভিজ্জা গেলে যাউক সব। আইজকা মানুষ খাইতে না পারলে, কাইলকার জন্য কষ্ট কইরা কী লাভ? আমি একাই পারমু উঠাইতে, তুমি খাওয়া শেষ কর।" প্রবল আক্রোশে উঠানের মরিচ আর মসুর ঘরের কোণে ছুড়ে দিতে থাকে পুরাতন বউ। কীসের উপর আক্রোশ তার কে জানে!

উৎসর্গ:
ব্লগার ভাঙ্গন (http://www.somewhereinblog.net/blog/msd86)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:৫৯
৫২টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×