ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায় প্যারাসুট বানাইতাম,একটা পলিথিন স্কোয়ার করে কেটে তার চার কোনায় সুতা বেঁধে নিচে একটা ছোট্ট ইটের ঢিল বেঁধে দিতাম। এরপর গাছের ওপর উঠে বা কোনো উঁচু জায়গা থেকে ছেড়ে দিতাম।বাতাসে উড়ে যেত অনেক দূরে। খুব মনে ধরেছিলো পলিথিনের বানানো প্যারাসুট।
একদিন শুয়ে শুয়ে ভাবছি বড় একটা প্যারাসুট বানালে খারাপ হয় না। নিজেই উড়বো। ছোটবেলার শিশুমন অত কিছু বুঝে না। সরলমনে ভাবলাম কি দিয়ে কি করা যায়। পলিথিনের চিন্তা না করে ভাবলাম বড় কোনো কাপড়ের সাথে দড়ি বেঁধে নিজের কোমরে আটকিয়ে যদি লাফ দেওয়া যায় বা জোরে দৌড় দিয়ে সামনে যাওয়া যায় তাহলেই কাজ হয়ে যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। ঝামেলা বাঁধলো কাপড় জোগাড় করা নিয়ে। চিন্তা করতে থাকলাম কীভাবে কাপড় জোগাড় করা যায়। কেনার সাধ্য নেই , মা অথবা আব্বুকে বললে পিটাবে আচ্ছা তরে, সুতরাং কাজ করতে হবে গোপনে।
বাসার পিছনে মাটির খোলা নিয়ে খেলছিলাম। সেখানে বাহিরের রোদে কাপড় নেড়ে দেওয়া ছিল। মা এর শাড়ি , আব্বুর লুঙ্গি আরো অনেক কাপড়। আব্বুর সাদা নতুন একটা লুঙ্গি আমার পছন্দ হলো প্যারাসুটের প্রধান মালামাল হিসেবে। আর যেই দড়িতে কাপড় নেড়ে দেওয়া ছিল ওই দড়িও গায়েব করে দিলাম। মাঠের এক কোনায় পলিথিনে মুড়ে লুকিয়ে রেখে এলাম লুঙ্গি আর দড়ি। মোটামুটি এই দুটি দিয়েই আজ চেষ্টা চালাবো। দুপুরের পর মা আব্বু দুইজন ঘুম। আমি আস্তে আস্তে বের হলাম বাড়ি থেকে। কোনো দিক না তাকিয়ে চলে গেলাম একদম মাঠে। মাঠ দুপুর বেলা ফাঁকা , আশেপাশে কেউ নেই। আমি লুকানো লুঙ্গি আর দড়ি বের করে লুঙ্গি টা মাঝখান দিয়ে চিরে ফেললাম। হয়ে গেলো একখণ্ড। এরপর দড়ি কেটে চার টুকরা করে লুঙ্গির চার মাথায় বেঁধে নিলাম শক্ত করে। মোটামুটি প্যারাসুটের কাজ শেষ। এবার লুঙ্গি মাথার ওপর দিয়ে দড়ি বাঁধলাম আমার কোমরে। তারপর শুরু করলাম দৌড়। মাঠের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে মারলাম দৌড়। বাতাস আমাকে সামনে এগোতে দেয় না, ভাবি এই বুঝি উঠে গেলাম উপরে। কিন্তু না অনেকক্ষণ লাফঝাঁপ করে কাজ হয়না। মাঠের চারপাশে ছিল কিছু মেহগনি গাছ। ভাবলাম গাছের চূড়ায় উঠে নিচে লাফ দিবো লুঙ্গি মাথায় নিয়ে। যেই ভাবনা সেই কাজ। গাছে উঠলাম, বলে রাখি গাছ খুব বড় ছিল না দুইতলার সমান হবে। দিলাম লাফ , লুঙ্গি গেলো ডালের সাথে আটকে, আর আমি বাদুড় ঝুলা হয়ে লটকে আছি। মাঠ ফাঁকা তাই নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় নিরাপদে নেমে এলাম নিচে। ভয় পেয়ে সেদিন ওগুলো লুকিয়ে রেখে বাসায় চলে এলাম।
সন্ধ্যায় মা চিৎকার করছে আর বলছে , চোর আব্বুর লুঙ্গি চুরি করে নিয়ে গেছে। আব্বুর নতুন লুঙ্গি। আশেপাশের আরো কয়েক বাড়ির খালা চাচীরা সব বের হয়ে আসছেন মা এর সাথে তাল মিলাতে। আমি চুপচাপ দেখছি সব। সবাই পারেন তো এখনো চোর কে পিটায়।
এর মধ্যে পাশের বাসার এক নানি এসে মাকে বললো '' তোর ব্যাটাক দেখনু দুপুর বেলা সাদা একখান লুঙ্গি লিয়ে মাঠের মদদে দৌড়াচ্ছে। "
আমি একদম মায়ের হাতের কাছাকাছি ছিলাম। মা বিন্দু মাত্র দেরি না করে ধরলো আমার গলায়। ছুটতে গিয়েও মায়ের হাতের ভেতর থেকে বের হওয়ার মতো কোনো কায়দা করতে পারলাম না। বাসার ভেতর নিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো লুঙ্গি নিয়ে কি করেছি। আমি চুপ চাপ, কোনো কথা নেই। মা এরপর শুরু করলে পাঙ্খার ডাঁটি দিয়ে সোজা পিঠের ওপর।
মাইর খেয়ে বলতে লাগলাম " প্যারাসুট বানাইছি "।
মা আরো খেপে গিয়ে বললো ''আজ তোর প্যারাসুট আমি বের করিচ্চি। ''
আচ্ছা তরে ঝাড়লো অনেকক্ষণ। তারপর বললো যা গিয়ে এখনি লুঙ্গি বের করে নিয়ে আয়। আমি দৌড় দিয়ে মাঠে গিয়ে লুঙ্গি নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিলাম। মা লুঙ্গি খুলে দেখে মধ্যে দিয়ে চিরা, কয়েক জায়গায় গাছের ডাল দিয়ে চিরে চিরে গেছে। তারপর আরো কিছুক্ষণ আমাকে মায়ের যে-সকল সরঞ্জাম ছিল যেমন হাতপাখা, ঘরের দরজার খিল, রুটি বানানোর বেলুন, পানি খাওয়ার হাতা সেগুলো দিয়ে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছাড়লো। এখনো প্যারাসুট দেখলে আমার সেই ''লুঙ্গিসুটের'' কথাই সবার আগে মনে পরে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫০