somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প...

২৯ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তাঁর উপর রোদের তাপও বেড়েছে অনেক। কারণটা হচ্ছে, সূর্য মামা ঠিক মাথার উপর। বাসেও অনেক ভিড়, উঠতে পারছিনা। দাড়িয়ে আছি ধানমণ্ডি সাতের মোড়ে। রিক্সায় যাবো। গন্তব্য শ্যামলী। কয়েকটা রিক্সাওয়ালা না করে দেয়ার পর, একজন রাজি হল। তবে যিনি রাজি হলেন তাঁর বয়সটা একটু বেশি। সাধারণত সবাইকে মামা ডাকলেও, এনাকে দেখে বললাম, “চাচা, শ্যামলী যাবেন?”
একটা ময়লা গামছায় ঘামটা মুছে বললেন, “যাব, তয় ৫০ টাকা দিতে অইব।”
-আচ্ছা। ঠিক আছে।
-দাঁড়ান বাবাজি। একগ্লাস পানি খাইয়া লই।
পানি খেয়ে রিক্সা চালানো শুরু করলেন। রিক্সাওয়ালা চাচা আমার দিকে ফিরে বললেন, “বাবাজি, যদি কিছু মনে না করেন তাইলে একটা সিগারেট ধরাই?”
-ধরান।
রিক্সাটা লেকের পাশ দিয়ে ছোট ছোট গাড়ির ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা চাচা, আপনার বাড়ি কোথায়?
রিক্সার প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “আরিচার ওই পাশে, রাজবাড়ী।”
-আপনার পরিবার কি ওইখানে থাকে?
-নাহ। এইহানে।
-পরিবারে কয়জন আছেন?
-তা বাবাজি- আমার বউ, দুইডা ছেলে,একটা মাইয়া। মাইয়াডা বড়। এবার আমার দিকে তাকিয়ে এক্তু হেসে বললেন, “আমি একটু বেশি বয়সে বিয়া করছি।”
আমিও মৃদু হেসে আচ্ছা বললাম।
-জানেন বাবাজি, আপনের চাচী কিন্তু খুব সুন্দর মুড়িঘণ্ট রান্না করবার পারে।- চাচাজি গল্পের খোরাক পেয়ে গেছেন।
-আপনাকে দেখে তো আনেক বয়স মনে হচ্ছে।
-তা হইছে। ৬০-৬৫ তো হবই।
-আপনি তো তাহলে যুদ্ধ দেখেছেন?
রিক্সাটা তখন ছোট একটা জ্যামে পড়েছে। আমার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, “শুধু দেখি নাই,যুদ্ধও করছি।”
-কোথায়?
-আমাদের অইহানেই।
-গল্পটা আমাকে বলবেন?
জ্যামটা ছাড়ল। রিক্সা গাড়ি চলছে। গরমে অনেক কষ্ট হচ্ছে। দু-মিনিট না যেতেই আরেকটা জটলা।
-গোয়ালন্দের নাম শুনছেন?
-হুম।
-আমার বাড়ি অইহানে।
-আচ্ছা।
-তখন আমার বয়স ২০-২১ হইব। আমি কিন্তু ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ছি।
-তাই নাকি?
-হ, বাবা। পইড়া আর কি হইল? জাউকগা, বাদ দেন এইসব আজাইরা কথা।
একটু যেন বিরক্ত হলেন।
-বাদ দেবেন কেন? ভালোই তো লাগছিল।
-আচ্ছা, শোনেন তাইলে...
-চাচা, বামহাতের ওই চায়ের দোকানটায় বসে কথা বলি।
-ঠিক আছে।
রিক্সাটা চায়ের দোকানে থামালেন।
আমি দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
-চাচা, আপনার নামটাই তো জানা হল না।
-বকুল সরদার।
আমি দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন। শোনেন তাইলে,
“বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধের দাক দিছেন, মানে হইল গিয়া আপনের ৭ মার্চ। অই ডাকের পর থিকাই আমাগো গ্রামে, রাজবাড়ির সবখানে প্রস্তুতি শুরু হইয়া গেল। এই কাজ দেখাশুনা করতেন আমাগো অইহানের বড় বড় সব নেতারা। হেদায়েত ভাই, আমজাদ ভাই, অমলদা। আর একজন ছিল, কি যেন নাম, মনে পড়তেছে না।”
এর মধ্যে চা চলে এসেছে।
-মনে পড়ছে। বাচ্চু মাষ্টার। বকুল চাচা আবার শুরু করলেন, “আমাগো অইহানে একটা বড় মাঠ আছে,রেইলওয়ে মাঠ। অইহানে আমাগো প্রশিক্ষণ দেওয়া হইত।
আমি যুদ্ধে যাব, এই কথা শুইনা আমার মায়ে তো বোম হইয়া রইছে। রাজি হয় না। তারপর দিলাম খাওন-দাওন ছাইড়া। দুইদিন পর মায়ে রাজি হইল। মায়ের পায়ে হাত দিয়া যখন সালাম করলাম, মা কইল, “দ্যাস যদি স্বাধীন করবার না পারস তাইলে আর ঘরে ফিরবি না।”
আমি যুদ্ধে গেলাম। একাত্তর সাল, এপ্রিল মাসের স্যাসের দিক। খাঁ খাঁ রোদ্দুর। একদিন ভোরবেলা মিলিটারিরা গানবোটে কইরা নদী পার হইয়া,নারার টেক,মমিন খাঁর হাট দিয়া শহরে ঢুইকা পইরল। আমাগো অইহানে অনেক বিহারিরাও ছিল। শূয়রের বাচ্চাগুলোও বন্দুক লইয়া শহরে নাইমা পড়ল। আর্মিগো লগে মিইল্লা বাড়ি ঘরে আগুন দিতে লাগল। হেদায়েত ভাইয়ের বাড়িতেও আগুন দিতে লাগল। অল্পবয়সী মাইয়াগো ধইরা নিয়া যাইতে লাগল।
আর আমরা কিছুদিন পর চইলা গেলাম ভারতে। তারপর আমরা ফিরা আসলাম রাজবাড়িতে। ক্যাম্প করলাম শহর থেইক্কা ৩-৪ মাইল ভেতরে, রসোড়া গ্রামে। আমাগো কমান্ডার ছিলেন হাসেম ভাই। আরও ৮-১০তা ক্যাম্প হইল। আশপাশ থেইক্কা আরো অনেকে আমাগো লগে যুদ্ধে যোগ দিল। অনেক যুদ্ধ করছি,বাবাজি। অনেক। আমাগো কয়েকজনরে মিলিটারিরা ধইরা নিয়া গেছিল। ক্যাম্নে যে মারছে বাবা, বিশ্বাস করতে পারবেন না। কতগুলারে তো ধইরা জবাইও দিছে। মুরগির মতন ছটফট কইরা মানুষ মরতে দেখছি।
আমরা কিন্তু ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত যুদ্ধ করছি।’
চা,বিস্কুট শেষ। আমি বিল মিতিয়ে আবার রিক্সায় উঠলাম। আবার রিক্সা চলছে।
-আপনি রাজাকারদের বিচার চান না?
-চাই তো বাবা। এক কুত্তার বাচ্চা- সামসু রাজাকার- আমার ফুফুরে ধইরা নিয়া গেছিল। আমার ফুফু লজ্জায়,ঘেন্নায় গলায় দড়ি দিছিল। পরে সামসুরে অনেক খুঁজছি। পাই নাই। কিন্তু জহন পাইলাম, তখন পঁচাত্তর পার হইয়া গেছে গা। আর খাঙ্কির পুতের চেহারা বানাইচে কি। যেন কিচ্চু জানে না। বুঝে না। যুদ্ধের সময় নাকি সে দ্যাসেই ছিল না। মাঝে মাঝে মনে কয় টুটিডা চাইপ্পা ধরি।
-আচ্ছা আমি যা বলছিলাম।
আমার কথায় তিনি বর্তমানে ফিরে আসলেন। বললেন, “বাবাজি, আপনি লেখাপড়া করেন,বুঝবেন। এইগুলারে ফাঁসি দিয়া কি হইব? কয়ডা আরশোলাই তো মরব। কিন্তু এরা যে বংশ বারাইচে এইগুলা কি করবেন? এইগুলারে ফাঁসিত লটকাইলে কি অইব? চাউলের দাম কমব? না,বরং তেলের দাম দুই টাকা বাড়ব।” আমার দিকে তাকিয়ে ডানহাতটা দেখিয়ে বললেন, “এই হাত দিয়া মেশিনগান চালাইয়া দেশ স্বাধীন করছি। আর এহন এই হাত দিয়া রিক্সা চালাই, দুইডা দাইল ভাতের জন্য।”- বলতে বলতে চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে এল তাঁর।
-কি না করছি দেশের জন্য। আর হারামির বাচ্চা গুলো- যারা দ্যাশরে বলাৎকার কইরচে, তারা হইছে দ্যাশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী। দ্যাসের পতাকা টাঙাইয়া গাড়ি লইয়া ঘুইরা বেড়ায়। আর আমারে দেহেন চিল্লায় কইতে পারি না,আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমরা না যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করছি। কিন্তু যারা পরে দেশটারে এই চল্লিশ বছর চালাইল, তাগো দেহেন, সবগুলান হাভাতে। বাপের জন্মে কিসসু খায় নায়, ত্যাম্নে এইগুলা চুরি করে,টাকা মারে। আর আমরা কিছু পাই না। থাকি বস্তিতে,একঘরে ৫-৬ জন ঠাসাঠাসি কইরা। খাই নুন-ডাইল, ভাত। আরে, আমাগো জন্য কিছু না করিস, দ্যাসের মাইনসের জন্য কিছু করলেও তো বুঝতাম তরা কামের মানুষ। কয় দিন পর পর বিদেশ যাস, ফকিরনির মত টাকা ধার করিস। আর সেই টাকা হাওয়া। খাওন-দাওনের পর পায়খানা প্রসাব কইরা টয়লেট নষ্ট করস। কত টাকার গুহা যে এইভাবে অরা মারে,তাঁর কোন ইয়াদ নাই।”

কথা আরও চলত। কিন্তু আমার গন্তব্য শ্যামলী চলে এসছে। আমিও তাঁর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হলাম।
ভাবতে লাগলাম কেন রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের চিন্তা করে না। কেন এত হানাহানি? কেন এত খুন? ক্ষমতার লোভে কত খেলাই না তারা খেলে। কিন্তু তারা কি জানে না তাদের শক্তি কতটুকু আর জনগণের শক্তি কত বড়?

আর রাজাকারদের কি বিচার হবে না? হতেই হবে। কিন্তু এই পোড়ার দেশে তারা পীর-আউলিয়া হয়ে গেছে। বিচার হলে যে, আল্লাহও সহ্য করবে না !!!

যাক গে। যার যা খুশি তাই কর। তবে আমাদের একটাই প্রার্থনা, একটু শান্তি দে। আমরা একটু শান্তি চাই।
শুধু এক টুকরো শান্তি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×