অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে মাহি। ওদের মহল্লার একপ্রান্তে এই মাঠটা। ছেলে-পিলেরা খেলাধুলা করে এখানে। একধারে একটা ঝিল, আর তার মাঝখানে একটা দ্বীপের মতন। বড় বড় কাশফুলের সারি দ্বীপে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেই কখন। হই-হল্লা, ছুটাছুটি, দাপাদাপি করে ক্লান্ত সব পিচ্চি-পাচ্চি মাঠ ছেড়েছে মাগরিবের আজান হতেই। ভীষণ বাতাস হচ্ছে আজকে, কেমন কোমল, ঠান্ডা ঠান্ডা। কাশফুলগুলো বাতাসে একবার এদিক নুয়ে পড়ছে, আবার ওদিক। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। মেঘ হয়ে আছে আকাশটা, কালো কালো ধূসর ধূসর মেঘ। আর একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্ধকার আকাশটা হঠাৎ হঠাৎ আলো হয়ে উঠছে। দুপা ছড়িয়ে হাতের ওপর ভর দিয়ে বসে একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মাহি। একবার বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই উজ্জ্বল দুটো চোখ হেসে উঠল ওর দিকে তাকিয়ে। থতমত খেয়ে মাথা ঝাড়া দিল মাহি। কি যে হয়েছে দুইদিন ধরে! কিছুতেই ভুলতে পারছে না। যেদিকে তাকায় সেদিকেই ওই চোখ, ওই হাসি দেখতে পায়। চোখ খুলে, চোখ বন্ধ করে, জেগে থেকে, ঘুমিয়ে কোনভাবেই শান্তি নেই।
পিউ...নামটাই কি মিষ্টি, কি সুরেলা! আর মানুষটারতো কথাই নেই। আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় মাহির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মেয়েটা, আর ওর দল। বিতর্কে শেষ পর্যন্ত মাহির দল জিতে গেলেও ওই সুন্দর চোখদুটোর কাছে একেবারে গরুহারা হেরে বসে আছে ছেলেটা। প্রায় দুই সপ্তাহ, সাথে সাথে থাকা, গল্প, কথা, হাসি, তর্ক, ঝগড়া, মান-অভিমান......কত কিই যে হয়ে গেল! মাহি সারাদিন বসে বসে প্রতিটা মূহুর্তকে গভীরভাবে ভাবে, নিজের মনেই ওলট-পালট করে। পিউ যখন প্রথমদিন এসে ঢুকল হলরুমে তখনই মাহি একটা হোঁচট খেয়েছে। ছোট-খাট পাতলা ছিপছিপে দেহ, গোলাপের মত গায়ের রঙ, অন্তত: মাহির তাই মনে হয়েছে; টানা টানা বিশাল দুই চোখ, হালকা ধূসর; ছোট্ট একটা নাক আর টুকটুকে পাতলা দুটো ঠোঁট। আর কি যেন কি, রুমে ঢুকেই ওই বিশাল চোখ মেলে দিয়েছিল পিউ মাহির চোখে। এক মূহুর্ত, তারপরই পাশে দাঁড়ানো বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি। সব ভুলে ওর লাইন ছেড়ে বেরুনো গজ দাঁতটার দিকে তাকিয়ে রইল মাহি। নিজের হৃদপিন্ডটাকে কখনো এত জোরে বাজতে শোনেনি মাহি। একদম ধুপ ধুপ করতে শুরু হল। আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো শিহাব আর পার্থকে দেখে নিল, ওরা টের পেয়েছে কি না। না, ওরা নিজেদের মতই গল্প করছে। সবার নাম এন্ট্রির জন্য এগিয়ে গেল তারপর। পিউদের পরেই মাহিদের দলটা। পাশে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনল মাহি। তখনই জানতে পারল ওর নাম পিউ। আর প্রথম রাউন্ডে ওদের সাথেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এত বিচলিত হয়ে উঠল মাহি, ওর মনে হল কথাই বলতে পারবে না।
পিউ অনেক শান্ত, চুপচাপ একটা মেয়ে। সবার সাথেই খুব মিষ্টি করে কথা বলে, একদম রাগে না, ছটফট করে না। মাহির ঠিক উল্টো। আর সবচেয়ে সুন্দর হল ওর হাসিটা। সারাক্ষন মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে। এই হাসিটাই মাহির মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ও কিছুতে, কিছুতেই ভুলতে পারছে না। সেমিফাইনালে শেষ পর্যন্ত যখন পিউদের দলটা হেরে গেল, ওর বান্ধবীদের ভীষণ মন খারাপ ছিল। এমনকি মাহিরও খারাপ লাগছিল ওদের জন্য। কিন্তু পিউ’র মুখে সেই হাসিটা লেগেই ছিল। সবাইকে হেসে হেসে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সাদা কামিজ আর সাদা ওড়নায় মেয়েটাকে একদম পরীর মত মনে হচ্ছিল। দেখতে দেখতে কি এক গভীর মায়ায় ভরে গেছে মাহির মন। সেই মায়াটা বাড়তে বাড়তে যেন ওকে গ্রাসই করে নিল। আজ তিনদিন হয়ে গেছে ওদের শেষ দেখা হয়েছে, কিন্তু মাহি একমূহুর্তের জন্যও পিউকে ভুলতে পারছে না।
কৌশলে পিউ’র ফোন নাম্বারটা নিয়েছিল মাহি। কিন্তু ফোন করার মত সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। এসব ব্যাপারে বন্ধ রফিক বেশ অভিজ্ঞ। বলবে না বলবে না করেও শেষ পর্যন্ত রফিককে জানিয়েছে মাহি। বিজ্ঞের মত রফিক পরামর্শ দিয়েছে, ‘আগেই ফোন-টোন করিস না। এক কাজ কর, মেসেজ পাঠা মোবাইলে। দেখ, কি রেসপন্স করে।’ সেই পরামর্শ মত মাহি কাল রাতে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে পিউকে।
রাতের আকাশে হাজার তারার ঝিকিমিকি
তার ভিড়ে আমি শুধু একটা মুখই দেখি
সে মুখ তোমার............
মেসেজ পাঠিয়ে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারেনি সারারাত। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। কিছুটা হতাশ হলেও সাহস পেয়েছে। তাই সকালে আবার আরেকটা মেসেজ। আর ঠিক একঘন্টা পরে মিসড কল। এত চুপচাপ মিষ্টি একটা মেয়ে যে এইভাবে ঝাড়ি দিতে পারে মাহির কল্পনাতেও ছিল না। ‘আপনি কি চান? আপনার সমস্যা কি? কেন বিরক্ত করছেন?’ রফিকের ‘চুপচাপ ঝাড়ি খেয়ে যাবি, কোন কথা বলবি না’-এই পরামর্শ ভুলে গিয়ে মাহি বলে উঠল, ‘একটা মেসেজই তো পাঠাইছি। এত বিরক্ত হওয়ার কি আছে?’ ওরে বাবা, জবাবে যেন একটা টর্নেডো বয়ে গেল। তারপরও মাহি ভীষণ খুশি। যাক, কথাতো হল। সারাদিন তাই নিয়ে মনের ভিতর ডুবডাব। ওই মিনিট পাঁচের কথাকেই কতভাবে যে নাড়াচাড়া করল বসে বসে। কমসে কম চার-পাঁচবার রফিককে করে বলেছে কি কি কথা হল। রফিক শুধু মুচকে হাসে, ‘হ্যাঁ মামু, বুঝি বুঝি। সবই বুঝি।’
বিকেলে আরেকটা মেসেজ পাঠিয়েছে মাহি। উথাল-পাথাল বাতাস দেখে মাহির মনে হচ্ছিল পিউ যদি এখন বারান্দায় যায়, তাহলে বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই লিখে পাঠাল, যেও না দখিন দ্বারে
বাতাস তোমায় উড়িয়ে নিবে......
সাথে সাথে ফোন। একটু ক্লান্ত বিষন্ন গলা, ‘কেন আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন বলেন তো? প্লিজ, আর কোন মেসেজ পাঠাবেন না।’
কি যে ছিল ওই কথায়। মাহির বুকের ভিতর শুধু হাপুস-হুপুস।
সেই থেকে বসে আছে মাহি মাঠে। উদাস চোখে আকাশ দেখছে। বিজলি চমকের মত দুটো চোখ উঁকি দিচ্ছে মেঘের ফাঁকে। বুকে তোলপাড় করে দিচ্ছে মিষ্টি একটা হাসি। আরেকবার ফোন করে ওই গলা শোনার জন্য হাত নিসপিস করছে। কিন্তু সাহসও পাচ্ছে না। ধুর, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।
আমি তো প্রেমে পড়িনি
প্রেম আমার উপরে পড়েছে
গানটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মাহি।
.....................................................................
সদ্য প্রেমে পড়া ছোটভাইটাকে, যাকে DOs & DONTs শেখাতে গিয়ে আমি হিমশিম...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



