বাসায় ছিলাম না সকাল থেকেই। সারা বিকেল আর সন্ধ্যেটা কাটিয়েছি কিছু বন্ধুর সাথে। অনেক অনেক সুন্দর কেটেছে পুরো সময়টা। আমার বন্ধুরা ছিল, ছিল গুরুজন, এবং ছোটরাও। কিন্তু আমাদের গল্প হয়েছে বন্ধুর মত। আড্ডার একটা বড় অংশ ছিল একজন মেয়ের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে, তার অধিকার নিয়ে, একজন মেয়ে পিতা-মাতার সন্তান, কারো ঘরনী, কারো মা হয়ে যাওয়ার পরেও যে তার একটা আলাদা অস্তিত্ব থাকে, সে যে একজন স্বতন্ত্র মানুষ সেই বিষয়টি বেশিরভাগ সময় আমরা ভুলে যাই। কি করা যায়, আপনজনের কি করণীয়, নিজের সত্ত্বাকে স্বতন্ত্র রাখতে মেয়েটি নিজে কি করতে পারে তাই নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। গল্পের ফাঁকে একবারও মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি আমাকে শুধু একজন মেয়ে হিসেবে দেখা হচ্ছে। বরং মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্বটুকুই অনেক অনেক গুরুত্ব পেয়েছে। ভাল লাগছিল এত সুন্দর একটা দিনের পরে যখন ফিরে আসছিলাম।
আমি আর আরেক ছোটভাই সিএনজি নিলাম। ফিরছি মিরপুর থেকে উত্তরা। স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক বেশি ভাড়ায় রাজি হতে হল শুধু সিএনজিওয়ালাদের দাপটে টেকা দায় বলে। শুরু থেকেই লোকটা এমন বেপরোয়া চালাতে লাগল যে প্রতি মুহূর্তে কোন দুর্ঘটনার ভয় পেতে হচ্ছিল। বারবার বলেও তার ওই বেপরোয়া চালানো বন্ধ করা গেল না। ভাগ্যক্রমে কয়েকবার কোন দুর্ঘটনা হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম। খিলখেতে বাসা বলে ছোটভাইটি নেমে গেল। উত্তরা পর্যন্ত পনর-বিশ মিনিটের রাস্তায় আমি একা। হঠাত করে সিএনজিওয়ালার হাব-ভাব বদলে গেল। সে একটু ঘুরে বসে বারবার আড়চোখে পিছন ফিরে দেখছে। খেয়াল করলাম বাতাসে আমার ওড়নাটা একটুখানি সরে গেছে, যেটা খুব স্বাভাবিক। অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে বসে ওড়নাটা ঠিক করে নিলাম। যাকে বলে গায়ের সাথে পেচিয়ে নেয়া, তাই করলাম। কিন্তু তারপরও তার সেই তাকানো বন্ধ হল না। সে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল বারবার। ভয় হচ্ছিল ওই হাইওয়েতে এইভাবে চলতে গিয়ে কোন এক্সিডেন্ট না করে। কিন্তু এয়ারপোর্টের পরের একটুখানি রাস্তায়, জায়গাটুকু একটু নীরব আর অন্ধকার, আমাকে এক্সিডেন্টের চেয়ে বড় একটা ভয় চেপে ধরল। সিএনজিওয়ালার সেই লোভী, লোলুপ, ঘিনঘিনে নোংরা, সাপের মত দৃষ্টির সামনে আমি যেন কুকড়ে গেলাম। ভয়ে অস্থির হয়ে ভাবছিলাম কখন এই পথটুকু শেষ হবে।
কিছুদূর যেতেই এক মোটরসাইকেলের পিছনে বসা এক মেয়ের দিকে সে তাকাতে লাগল ঘুরে ঘুরে। ভয় পেলাম পেছনে তাকিয়ে চালাচ্ছে, না জানি কি হয়...মোটরসাইকেল পার হয়ে যেতেই সে আবার আমার দিকে মনযোগ দিল। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বাকি রাস্তা আসলাম। নামার পরে যখন ভাড়া দিচ্ছি, সিএনিজিওয়ালা আমার কাছে ভাড়ার অতিরিক্ত কিছু বখশিশ চাইল। আমার এমন রাগ হল, কড়া গলায় বললাম, 'আপনি এমনিতেই অতিরিক্ত ভাড়ায় আসছেন আবার বখশিশ কেন দিবো আপনাকে?'
সে উদ্ধত গলায় বলল, 'চাইছি, তাই দিবেন।'
আমি ভাড়ার টাকাটা দিয়ে নেমে আসলাম। শুনলাম পিছন থেকে লোকটা বলছে, 'আপনারা যদি ভালবাসা না দেন, আমরা কই যাবো?' এত নোংরা, এত অশ্লীল সেই কন্ঠস্বর...
খাচার ভিতর নোংরা লোকটা নিরাপদে বসেছিল। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল কষে একটা চড় লাগাই। কিন্তু আমি চলে আসলাম। সারাদিনের স্নিগ্ধতা একটা নোংরা লোকের নোংরামিতে চাপা পড়ে গেল।
আমার শিক্ষা-দীক্ষা, আমার মানসিক উতকর্ষ , আমার মেধা-মনন, সবকিছু ছাপিয়ে আমি শুধুই একটি মেয়েতে পরিণত হলাম। শুধুই একটি শরীরে পরিণত হলাম। আর কিছুই কি নেই আমার? এইসব নোংরা, লোলুপ দৃষ্টি, চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া...
শুধুতো এই অশিক্ষিত সিএনজিওয়ালাই নয়, খুব ভদ্রবেশী মুখোশপরা শিক্ষিত ভদ্রলোকও সুযোগ পেলে একি কাজ করছে। সুযোগ পেলে না, বলা যায় সুযোগ করে নিচ্ছে। কি তার চোখের দৃষ্টিতে, কি কথায়, সামনাসামনি অথবা ফোনে...
আমার অন্যায় একটাই, সবকিছু ছাপিয়ে আমি শেষ পর্যন্ত একজন মেয়েই, একটি শরীর...যাকে গিলে খেতে হয়, চেটে-পুটে খেতে হয়, লুটে নিতে হয়।
ছিঃ............
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



