(১)
এই শহরে এমন একটি বাড়ি এখন সত্যিই দুষ্প্রাপ্য। ভদ্রলোক কি করে এখনও এটি ডেভলপারের হাত থেকে অক্ষত অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন ভেবে অবাক লাগছে। প্রধান ফটক থেকে বেশ অনেকখানি খোলা জায়গা পার হয়ে মূল বাড়িতে যাওয়া গেল। সীমানাপ্রাচীরের শেষমাথায় বাড়িটি ছাড়া ফাঁকা অংশের পুরোটাই বিভিন্ন গাছ-গাছালিতে পূর্ণ। বেশ একটা ছায়া ছায়া শান্তি শান্তি ভাব।
চারদিক দেখা শেষ হতে আমি বাড়ির মালিকের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। সবে প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে পৌঁছেছেন ভদ্রলোক, অত্যন্ত বিনয়ী এবং নম্র। তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হল তারঁ দ্বিধাগ্রস্ততা; সারাক্ষণই বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, একটু পর পর চশমার কাঁচ মুচছেন, নাকের ডগায় চশমাটা বসিয়ে পরখ করছেন ঠিকমত বসল কিনা, শার্টটাকে টেনে-টুনে ঠিক করছেন আর খুব বিব্রত ভঙ্গিতে হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছেন।
প্রধান ফটক থেকে মূল বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতেই তাঁর এবং তাঁর বাড়ির প্রায় গোটা ইতিহাস আমার জানা হয়ে গেল। ভদ্রলোক একা; পুরো বাড়িতে এবং পৃথিবীর অপরপ্রান্তে স্থায়ী হওয়া তাঁর পুত্র-কন্যাকে উহ্য করা গেলে পুরো পৃথিবীতেই; তিনি থাকেন দোতলা জুড়ে। নিচতলাটি বহুদিন ধরে শূণ্য। তিনি একজন ভাড়াটের প্রয়োজনীয়তা সেভাবে অনুভব না করলেও কিছু শুভাকাঙ্খীর উপর্যুপরি অনুরোধে বাড়িটি ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে আমার আশ্রয়দাতা চাচা এর খোঁজ পেয়ে যান সবার আগে এবং আমাকে তাঁর কাঁধ থেকে খসানোর এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া তিনি করেননি বলাই বাহুল্য।
কাঁপা হাতে ভদ্রলোক বহুদিন বদ্ধ থাকা নিচতলাটির দরজার তালা খোলেন। দরজার পাল্লা ফাঁক করতেই বন্ধ ঘরের পুরনো, সোঁদা একটা গন্ধ ধাক্কা মারে নাকে। ভিতরের আবছা অন্ধকার সয়ে নিতে কিছুটা সময় চোখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। কিন্তু এরমধ্যেই ভদ্রলোক সামনের ঘর, সেটা পার হয়ে মাঝের খাবার ঘর, দু'পাশের দুটো শোবার ঘর, একপাশে পাকঘর, বারান্দা একে একে সবকিছুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমাকে এমনকি আসবাব নিয়েও চিন্তা করতে হবে না। একটা সময়ে তাঁর ছেলে এখানে বাস করতো, ভিতরের শোবার ঘরে একটা বিছানা, দেয়াল লাগোয়া আলমারি, খাবার ঘরে বেশ বড়সড় একটা টেবিল, আর বাইরের ঘরে এক সেট বেতের সোফা এবং এতবড় ফুল-ফার্নিশড একটা বাড়ির নামমাত্র ভাড়া। এই দুর্মূল্যের বাজারে আমার জন্য এটা আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতই ব্যাপার। আমার উচিত আগামীকালই একবার ফিরে যেয়ে চাচাকে কদমবুচি করে আসা।
হাঁটতে হাঁটতে আমি শোবার ঘরে এসে দাঁড়াই, ঘরের লাগোয়া বেশ বড় একটা বারান্দা। বারান্দা আমাকে খুব কল্পনাপ্রবণ করে দেয়। এমন কত রাত গেছে আমি নিজেকে দেয়ার মত একটু সময় বা জায়গা পাইনি যখন, চাচার বাসার পাকঘর লাগোয়া বারান্দাটাই আমাকে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে দিয়েছে। আমি সেখানে বসে হারিয়ে গেছি কল্পনার রাজ্যে। তাই বারান্দাটা দেখে স্বভাবতই আমি ভদ্রলোককে ভুলে এগিয়ে যাই সেদিকে। বারান্দার পরে প্রায় তিনহাত জায়গা খালি রেখে বাড়ির নড়বড়ে সীমানা-প্রাচীর, তার ওপাশে রাস্তা, একটু চোখ তুলে তাকালেই একটুকরো নীল আকাশ, ঝলমলে আলো আর একপাশে মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিনয়ী, বুড়ো একটা গাছ।
নি:সন্দেহে গাছটা বুড়ো কিন্তু বিনয়ী কেন মনে হল তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। অনেকগুলো শেকড় একসাথে জড়াজড়ি করে বেশ বড় প্রস্থের একটা গুড়ি তৈরি করেছে, অক্টোপাশের পায়ের মত জড়ানো শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে গেছে এদিক-ওদিক, গোল গোল মাঝারি আকারের ফ্যাকাশে সবুজ পাতা। বেশ সজীব আর প্রাণবন্ত। বাড়িটার ভিত অনেকটাই উঁচু বলে বারান্দার গ্রীল ছুঁয়ে গেছে গাছটার ঝাকড়া পাতাগুলো, প্রথম দেখায় মনে হল মাথা নুইয়ে সে আমাকে নতুন নিবাসে অভিবাদন জানাল। কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থেকে আমিও হালকা মাথা নোয়ালাম।
আরো কিছু খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বিদায় নিলেন আপাতত। আর ঘরদোর ঝাড়ামোছা দিয়ে আমি আমার নতুন সংসার শুরু করলাম।
(২)
আমার কর্মস্থল থেকে বাসাটা খুব বেশি দূরে নয়। রাতজাগার দীর্ঘদিনের বদঅভ্যাস থাকার কারণে সকালে ঘুম থেকে ওঠা বরাবর আমার জন্য কঠিন একটি কাজ। এতদিন ঘড়িতে এ্যালার্ম সেট করেও যে কাজটা আমি করতে পারতাম না, আজকাল সেটা আপনাতেই হয়ে যায়। বুড়ো গাছটায় বাসা বেঁধে আছে দুই জোড়া টিয়া, আর ঝাকে ঝাকে চড়ুই। রোজ সন্ধ্যায় আর খুব ভোরে তাদের ত্রাহি চিৎকারে এলাকায় টেকাই দায়। তারপরও আলস্য ভেঙে বিছানা ছাড়তে স্বভাবতই দেরি হয়ে যায়। তাই প্রাত:রাশ, নাস্তা তৈরি, গপাগপ খেয়ে নেয়া, তারপর তৈরি হয়ে ঘর ছেড়ে বেরুনো সবই হয় একটা তাড়ার মধ্যে।
আমার আশ্রিত, ছন্নছাড়া জীবনে কখনো বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না। সন্ধ্যা পার হয়ে কখনো কখনো বেশ রাত হয়ে যাওয়াটাই বেশ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আজকাল কি যেন একটা আকর্ষণে বাড়ি ফিরি কাজ শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই। শূণ্য ঘরটায় ঘুরে বেড়াই, কখনো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যাই নি:সঙ্গ বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করতে, বেশ সময় নিয়ে রান্না করি, খাওয়া সারি, টেলিভিশন নেই বলে নতুন-পুরনো বই-ম্যাগাজিনে মনোযোগ ঢেলে দেই, এমনকি নিজে কিছু লেখালেখির চেষ্টাও করি। তারপরও দীর্ঘ একটা রাত আমার সামনে রয়ে যায়। আমি ঘর অন্ধকার করে বসে রাতের বাতাসের সাথে বুড়ো গাছটার ফিসফিস শুনি।
এক রাতে আমিও তাদের আড্ডায় যোগ দিতে এগিয়ে গেলাম। এতটা আপ্লুত বহুকাল হইনি আমি। বারান্দার গ্রীল ধরে বসে বুড়ো গাছটার খসখসে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে আমি গুনগুন করে আমার জীবন ইতিহাস বলতে শুরু করলাম। আর বুড়োটা একান্ত আপন এক বন্ধুর মত শুনে যেতে লাগল আমার সব কথা। ক্ষণে ক্ষণে সে মাথাও দুলাতে লাগল বেশ বিজ্ঞের মত।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাতের পাগলামি মনে পড়তে বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলাম। হাসিমুখে দেখা করতে গেলাম গাছটার সাথে। মনে হল মাথা দুলিয়ে শুভসকাল জানাল সে আমাকে। এবং খুবই অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাকে আজকে অন্যদিনের তুলনায় আরো সবুজ, প্রাণবন্ত লাগছে। কে জানে! হয়তো চোখের ভুল।
সারাদিনের কাজের ভিড়ে আমি একসময় ভুলেও গেলাম সবকিছু। সেদিন, বহুদিন পরে কাজশেষে আমার মনে হল পুরনো আড্ডাটায় ঢু মারি একবার। বন্ধুদের সাথে দেখা হল, বহুদিনের জমে থাকা কথা উগড়ে দিলাম টং এর বেঞ্চিতে বসে, শুকনো গলাটা ভেজালাম কিছু ঊষ্ণ পানীয়ে আর তারপরে বিস্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলাম গভীর রাতে। ক্লান্ত আমার দেহটাকে বিছানা পরম আদরে কাছে ডাকলেও কিসের আকর্ষণে আমি এগিয়ে গেলাম বারান্দায়। দেখি বুড়ো গাছটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, যেন কত গভীর দু:খে কাতর! মায়া হল ভীষণ। পাতাগুলোয় আলতো হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম, 'মন খারাপ হয়েছে বুড়ো?' বুড়ো গাছটা উত্তরে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। আমি মৃদু হেসে বললাম, 'আর দেরি হবে না।' গাছটা ডাল-পাতায় মৃদু ঝাপটা দিল কথাটা শুনে। আমি তখন ফিসফিস করে বহু কথা বলে যেতে লাগলাম।
পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙেই গাছটার কাছে ছুটে গেলাম আমি। আজ সে আরো সবুজ, আরো ঝলমলে, প্রাণবন্ত। পাতাগুলোয় রোদের ঝিলিক তুলে সেন যখন আমাকে সম্ভাষণ জানাল আমি কেন যেন রাতের ব্যাপারটাকে নিছক কল্পনা ভেবে হেসে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। বরং আমিও হাত ছুঁয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানালাম।
তারপর থেকে আমার রোজকার রুটিন বদলে গেল আশ্চর্যজনকভাবে। ভোরে চোখ মেলেই আমি জানালা দিয়ে তাকাই বুড়ো গাছটার দিকে, আজ পর্যন্ত বুড়োটার নাম জানা হল না। মিষ্টি হাসি দিয়ে শুভসকাল জানাই, সেও আড়মোড়া ভেঙে ধীরে-সুস্থে মাথা দুলিয়ে আমার অভিবাদনের জবাব দেয়। প্রাত:কালীন ব্যস্ততা সেরে ঘর থেকে বেরুনোর আগে বুড়োটাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে ভুলি না কখনো। কাজ শেষে ফিরে আসি যত শীঘ্র সম্ভব।
তারপর আমার গোটা সময় কাটে বুড়ো গাছটাকে ঘিরে। বেশ বন্ধু হয়ে গেছি দু'জন। আমি যত্ন নিয়ে হাতের নাগালের একটা একটা পাতার ধুলা মুছে দেই, বাড়িটা ঘুরে পেছনটায় যেয়ে গাছটার গোড়ার আশপাশের মাটি পরিস্কার করে দিই, পানি দেই। আর বুড়ো গাছটা দিন দিন আরো সবুজ, আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে; কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়।
যেতে আসতে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটির সাথে কদাচিৎ দেখা হওয়া ছাড়া তাঁর অস্তিত্ব তেমন টের পাওয়া যায় না। দেখা হলেই সহৃদয় ভঙ্গিতে তিনি হাসেন, কুশলাদি জানতে চান, গাছটির প্রতি আমার মমতা দেখে খুশি হন। কোথায় যেন বুড়ো গাছটার সাথে তাঁর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই আমি।
(৩)
কিছুদিন ধরে অফিসে কাজের ভীষণ চাপ। একইসাথে পেশাগত এবং ব্যক্তিগত ঝামেলায় মন বিক্ষিপ্ত খুব। অফিস রিসেপসনের সুন্দরী মেয়েটি কোন কারণে শুরু থেকেই আমার প্রতি বেশ পক্ষপাত দেখিয়ে এসেছে। যেতে-আসতে মিষ্টি করে হাসি, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা লাঞ্চের ভাগ, কখনো অফিস শেষে একসাথে পার্কে সময় কাটানো; তার অর্থহীন টুকটাক কথা-বার্তা, এমনকি রাত জেগে নীল কাগজে লেখা চিঠি! অস্বীকার করবো না যে আমার ভাল লেগেছিল। চিরকাল অবহেলা পেয়ে আসা একজন মানুষ যখন সামান্যতম মনোযোগও পায় তার আপ্লুত হওয়ারই কথা। কিন্তু সেই মানুষটিই এখন তার অর্থহীন আবেগকে অর্থের মানদন্ডে পরিমাপ করতে চাইছে। যেখানে অর্থ, সেখানেই আবেগ! তাই নতুন, কমবয়সী ম্যানেজারটি হয়ে উঠেছে আমার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজেকে আরেকটু মূল্যবান করে তুলতে সামর্থের বাইরে শুরু করি খরচ করতে, যার জন্য আমাকে ধার করতে হয় দেদার।
আজকাল বাড়ি ফিরে বুড়ো গাছটাকে সময় দেয়া হয় না। কখনো হয়তো বাড়ি ফিরতেও দেরি হয়ে যায় অনেক। অভ্যাসবশে এখনও গভীর রাতে বারান্দায় বসে থাকি। পোড়া সিগারেটের স্তূপ জমে নোংরা হয়ে ওঠে মেঝে। ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে বুড়ো গাছটা খুক খুক করে কাশে। আমি আমলেই নেই না। গাছটার ঝলমলে সবুজ পাতা একটু একটু করে বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। একবার চোখ তুলে আমি দেখি না। আমার মাথায় তখন এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সব সমস্যারা ঘুরপাক খায়। কি করে আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন এই চাকরিটা বাঁচানো যায়, কি করে উদ্ধার করা যায় আমার প্রেমিকাকে অর্থপিশাচটার হাত থেকে!
একসন্ধ্যায় প্রেমিকাকে উপরওয়ালার হাত ধরে অফিস থেকে বের হতে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। কিন্তু মেরুদন্ডহীন এই আমার প্রতিবাদ করা হল না। প্রবল আক্রোশে ফুসতে ফুসতে ফিরে এলাম। তার দেয়া সমস্ত চিঠি বারান্দায় জড়ো করে পোড়াতে লাগলাম। ধোঁয়ায় ঢেকে গেল বুড়ো গাছটা। পড়ে থাকা ছাইগুলো তুলেও উজাড় করে ছড়িয়ে দিলাম গাছটার পাতায় পাতায়। খুব ছোটবেলায় কোন কারণে রাগ হলে আমি সেই রাগ উজাড় করে দিতাম আমার মায়ের উপর, সেই জায়গাটা এখন দখল করেছে এই বোকা-সোকা গাছটা। সে মুখ বুজে সব সয়ে যায়। তার সবুজ পাতাগুলো ফ্যাকাশে, ধূসর, প্রাণহীন হয়ে উঠে; সে এখন আর হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ করে না, বাতাসের সাথেও তার ফিসফিস বন্ধ বহুদিন। টিয়া পাখিগুলো তল্পি-তল্পা গুটিয়ে কোথায় চলে গেছে, চড়ুইগুলোও যাচ্ছে এক-এক করে। এতটা বিষন্নতা সইবার ক্ষমতা তাদের নেই। অথচ আমার একবার ঘুরে দেখবার সময় হয় না।
(৪)
চাকরিটা খুইয়েছি প্রায় তিনমাস হল। চিরকালের আবেগসর্বস্ব, বদমেজাজী আমার কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি আর কি আশা করা যায়! ভালমানুষ বাড়িওয়ালাটি অনুমতি দিয়েছেন ভাড়া বাকি রাখবার। যতদিন অন্য কোন ব্যবস্থা না হয়। থাকার ব্যবস্থা না হয় হল, কিন্তু হাতেতো ফুটো পয়সাটাও নেই। পেটপূজার কি ব্যবস্থা হবে! বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি বেশ কিছুদিন সাহায্যও করেছেন, কিন্তু এরকম হাত পেতে নেয়া যায় ক'দিন! আধবেলা খেয়ে খেয়ে শরীর বেশ দুর্বল। ঘরেই থাকা হয় বেশিরভাগ সময়।
দুর্বল, নির্জীব দেহটা খিদে সহ্য করতে না পেরে ঘুমে ঢলে পড়েছিল শেষরাতে। কিন্তু ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম চটে গেল। বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম বুড়ো গাছটা বিজ্ঞের মত মাথা দুলাচ্ছে। সবুজ পাতাগুলো ফ্যাকাশে হতে হতে প্রায় হলুদ তার, ঝরে গেছে বেশিরভাগই, নিরস, নিষ্প্রাণ গাছটা; ঠিক আমারই মতন। কতদিন আমি তার কাছে যাইনি, হাত বুলাইনি খসখসে গুড়িটায়, পাতাগুলোয় ধূলা জমেছে, জমেছে ছাই আর ক্লেদ।
আমি এগিয়ে যেতেই গভীর অভিমানে বুড়োটা ফোসফোস করে উঠে। গ্রীলের বাইরে হাত বাড়িয়ে হালকা আদর বুলাই আমি তার দেহে, নাগালে থাকা পাতাগুলো পরিস্কারের ব্যর্থ চেষ্টা চালাই। বুড়োটা সরে যেতে যেতেও আরেকটু এগিয়ে আসে যেন। আমি ফিসফিস করে তার সাথে কথা বলি, ক্ষমা চাই ছেড়ে গিয়েছিলাম বলে। আর আমার জ্ঞানী বন্ধুটা বারবার মাথা দোলায়, যেন সে বলতে চায় 'দেখো তোমাকে সাবধান করেছিলাম। তুমি শোনোনি। ঠিক হলতো আমার কথা!' আমি হাসি, 'হ্যাঁ বুড়ো, তুমিই ঠিক।'
রঙচঙে মিথ্যে আকর্ষণে ভুলে আমার এই নির্বিরোধী, ভালমানুষ বন্ধুগাছটিকে আমি ভীষণরকম অবহেলা করে ছেড়ে গেলেও সে মূহুর্তের জন্য আমাকে ছেড়ে যায়নি। বরং সারাক্ষণ কামনা করেছে আমার মঙ্গল। তাই যখন আমি একটুখানি আশ্রয়ের জন্য ফিরে এলাম তার কাছে, সে মুখ ফিরিয়ে নিল না। বরং বাড়িয়ে দিল বন্ধুত্বের, নির্ভরতার হাত। আমার আদরে, কথায়, হাসিতে একটু একটু করে হয়ে উঠতে লাগল সবুজ, সজীব।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




