সিরিয়া যুদ্ধ শুরুকালীন সব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিবর্গ একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন না করে প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সিরিয়া যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে গভীর থেকে গভীর সংকটে নিপতিত হচ্ছে। প্রক্সিযুদ্ধের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছে একে একে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিবর্গ।ইরান দৃশ্যত সিরিয়া যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন না করলেও দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কিছু সেনা কর্মকর্তার সরব উপস্থিতি আছে সিরিয়ার মাটিতে।আইসিস বিরোধী যুদ্ধে তাদের ডজনখানেক সেনাকর্মকর্তা ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে হিজবুল্লাহকে সিরিয়ার মাটিতে পাঠিয়ে ও বাশার আল আসাদ সরকারকে সামরিকসহ সবধরণের উপদেশ, পরামর্শ অব্যহত রেখেছে দেশটি তেমনি যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট আইসিস দমনের নামে আইসিসের সাথে টম এন্ড জেরি খেলে পর্দার আড়ালে স্পষ্টত আইসিসকে শক্তিশালীকরণের মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সেই খেলা রাশিয়া দীর্ঘদিন উপভোগ করে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হল। তা দেখে পশ্চিমা ও মার্কিনপদলেহী আরবদের আক্কেল গুড়ুম! তাই কাল বিলম্ব না করে যুক্তরাস্ট্রও ঘোষণা দেয় তারাও আপাতত ৫০ জন চৌকস সেনাকর্মকতা সিরিয়ার মাটিতে পাঠিয়ে সরাসরি উপস্থিতি জানান দিবে। সেই সেনাকর্মকর্তাদের মূল কাজ হবে আসাদ বিরোধী জঙ্গী বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া।
অন্যদিকে পশ্চিমাদের আশ্রয়ে লালিত পালিত হয়ে পাখা গজিয়েছে এরদোগানের তুরস্কের। নিজের জন্ম দেওয়া সন্তান আইসিসের রাশিয়ার পুতিনের হাতে করুণ মৃত্যুদৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সন্তানদের রক্ষার্থে নিজেই সরাসরি সিরিয়ার মাটিতে উপস্থিত হলেন এরদোগানের তুরস্ক । রাশিয়ার সুখোই-২৪ জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করলেন সিরিয়ার মাটিতে। হতভম্ব পরাশক্তি রাশিয়া ! সিরিয়াতে রাশিয়ার বিমান হামলার কারনে সিরিয়ার সেনাবাহিনী যখন আইসিস ও আল নুসরার হাত থেকে মুক্ত করছে একের পর এক শহর তখনই তুরস্ক এই কাজ করল ! পুতিন বললেন রাশিয়ার পিঠে ছুরি মেরেছে তুরস্ক ! বিনা জবাবে রাশিয়া ছাড় দিবে না তুরস্ককে! ঘটনা কী ?তুরস্ক এই সাহস পেল কোথা থেকে ? পিঁপড়ার পাখা গজায় নাকি মরিবার ত্বরে । উত্তর জানা যাবে পুতিনের প্রতিক্রিয়া থেকেই-
পুতিন বলেছেন, তুরস্কের এফ-১৬ জঙ্গিবিমান থেকে ছোঁড়া আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে রুশ সুখোই-২৪ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন,“আমি বুঝি প্রত্যেকটি দেশের আঞ্চলিক স্বার্থ থাকে এবং আমরা সবসময় তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসছি। কিন্তু আজকে যে অপরাধ করা হয়েছে তা আমরা কোনোভাবেই সহ্য করব না।”
পুতিন আরো বলেছেন, সিরিয়ায় তৎপর সন্ত্রাসীরা প্রতিদিন তুরস্কে তেল পাচার করত এবং বিষয়টি রাশিয়ার অনেক আগে থেকেই জানা ছিল। এই তেল বিক্রির অর্থ দিয়ে আইএস তাদের অর্থের যোগান নিশ্চিত করত। গত কয়েকদিন সন্ত্রাসীদের প্রায় এক হাজার তেল ট্যাংকার ধ্বংস করা হয়েছে। এটা তুরস্কের স্বার্থের জন্য বড় ধরনের আঘাত।
পুতিন বলেছেন, বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা ঘটার পর তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ না করে তারা ন্যাটো জোটের সঙ্গে যোগাযোগ করছে; যেন আমরাই তুর্কি বিমান ভূপাতিত করেছি। এর অর্থ কী এই দাঁড়ায় যে, আইএস’র জন্য ন্যাটো জোট কাজ করুক? পুতিন পরিষ্কার করে বলেছেন,“বিষয়টি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখছি এবং বিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্ক করুণ পরিণতি বরণ করবে।
পুতিনের কথায় স্পষ্ট যে তুরস্ক আইসিসের প্রধান সহযোগী ও আইসিস ইরাক এবং সিরিয়ার তেল খনি থেকে তেল উত্তোলন করে ন্যুনতম মূল্যে তুরস্ককে সাপ্লাই দেয়। সেই তেল তুরস্ক হয়ে ইউরোপে বিক্রি হয় যা তুরস্কের জন্য একটি মহালাভজনক ব্যবসা, কিন্তু রাশিয়ার সিরিয়াতে আইসিসের উপর আক্রমেন তুরস্কের সেই লাভজনক ব্যবসা এখন ক্রমাবনতিশীল। হয়তো অচিরেই তুরস্কের সেই লাভজনক কারবারের বাকিটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তুরস্কের দিশেহারা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সিরিয়ার যুদ্ধে একপক্ষে আছে প্রকট ইরান, রাশিয়া ও প্রচ্ছন্ন চীন ও অন্যদিকে আছে যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা রাস্ট্রগুলি, আরব ও তুর্কি। কেউ কাউকে সূচাগ্র মেদিনীও ছাড় দিতে চাচ্ছে না কারন সিরিয়ার যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকবে এই দুই পক্ষের যে পক্ষ জয়ী হবে-হয় ইরান, রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে অথবা পশ্চিমা, সৌদি ও তুর্কির নিয়ন্ত্রণে। তাই সিরিয়াতে রাশিয়ার সামরিক সরব উপস্থিতিতে আইএসআইএল কার্ড শেষ হওয়াতে বেকায়দায় পড়া পশ্চিমারা শেষ কার্ড হিসাবে তুরস্ককে ব্যবহার করতে চাইছে। পশ্চিমাদের দুরভিসন্ধি হল সিরিয়াতে রাশিয়ার বিকল্প হিসাবে তুরস্ককে দাড় করানো কারন তুরস্ক সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য।এতে ন্যাটোও জড়িত হতে পারে ঠিক এই কারনেই রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার পরপরই তুরস্ক রাশিয়ার সাথে নয় ন্যাটোর কাছে বিষয়টা উত্থাপন করেছে। ন্যাটো ও যুক্তরাস্ট্রেউভয় তুরস্ককে সমর্থন জানিয়েছে। ওবামা বলেছেন, তুরস্কের অধিকার আছে রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করার। ঠিক একই যুক্তিতে বলা যায় সিরিয়ার আসাদ সরকারেরও অধিকার আছে সিরিয়ার মাটিতে আমেরিকার বিমান ভূপাতিত করার । এটা স্পষ্টভাবে বলা যায় তুরস্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলা শুরুর পরপরই যুক্তরাস্ট্রসহ পশ্চিমা নেতারা রাশিয়াকে এজন্য চড়া মূল্য দিতে হবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছিল ! তবে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের যুদ্ধ যদি বেঁধেও যায় তাতে ষোল আনা লাভ হবে পশ্চিমাদের আর তুরস্কের ঘরে যাবে ঘোড়ার ডিম এবং বোনাস হিসাবে সাদ্দামের ইরাকের ভাগ্য আর সিরিয়া হবে বিরানভূমি।