somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

একটি চিঠি এবং ভ্রমন বৃত্তান্ত

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিয় শ্রাবন্তী,

শুভেচ্ছা নিয়ো।আশা করি ভালো আছো।তোমাকে ছাড়াই সমুদ্র পরিভ্রমণ শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসেছি।তুমি আমার সঙ্গে না থাকলেও ভ্রমনের প্রতিটিক্ষণ আমার অনুভূতিতে সঙ্গী হয়ে ছিলে ছায়ার মত।আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও তোমার জন্য ক্ষণে ক্ষণে জাগা অনুভূতিগুলোর সংক্ষিপ্ত রুপে বর্ণনা করছি......

আমাদের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দীর্ঘদিন যাবদ কক্সবাজার ভ্রমনের একটা পরিকল্পনা চলছিলো। পরে সেটা যখন বাস্তবে রুপান্তরিত হলো তখন শিক্ষকেরা আমাদেরকে এই সফরে অংশগ্রহনের জন্য তাড়া দিচ্ছিলো।

মনে হচ্ছিলো,এমন একটি সমুদ্র ভ্রমনে যদি একান্ত প্রিয় কোন বন্ধু কিংবা প্রিয় মানুষ পাশে না থাকে তাহলে নিষ্প্রাণ এরকম ভ্রমনে গিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করার কি দরকার। তাছাড়া তোমার দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা কক্সবাজার ভ্রমন করা , তাই তুমিহীনা ইচ্ছে ছিলোনা এই ভ্রমনে যোগ দেবার।ইচ্ছে ছিলো, কক্সবাজার গেলে তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।।সেজন্য রাজবাড়ী কলেজ থেকে অনেকবার কক্সবাজার ভ্রমনের উদ্যেগ নিয়েছি কিন্ত সফল হইনি। তাই এই ভ্রমন নিয়ে আমার তেমন কোন বিশেষ ইচ্ছে বা আগ্রহ মনের মধ্যে তাড়া করছিলো না।আবার যখন ভাবলাম, তুমি নাইবা হলে আমার ভ্রমন সঙ্গী কিন্তু আমার মোবাইল ফোনতো আছে। সৈকতে পাশাপাশী বসে নাইবা পারলাম আমার উচ্ছাস তোমাকে ব্যক্ত করতে, কিন্তু উচ্ছাস ব্যক্ত করার মাধ্যমতো একটা আছে। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যাওয়ার জন্য মন স্থির করলাম।কিন্তু সমস্যা হয়ে দাড়ালো অর্থনৈতিক সংকট, যাইহোক এই সমস্যারও একটা ব্যবস্থা হয়েগেলো।পরে ভ্রমনের নির্ধারিত চাঁদা জমা দিয়ে ভ্রমন নিশ্চিৎ করলাম আর তোমার জন্য মোবাইল কার্ড বাবদ বাজেট নির্ধারিত হলো তিন শত টাকা।

এর পর থেকে প্রহর গুনছিলাম কাঙ্খিত ২১ফেব্রুয়ারী তারিখের প্রতিক্ষায়।অবশেষে এলো ২১ তারিখ আর আমাদের যাত্রা শুরুর সময় নির্ধারিত হলো রাত ৯টা ৩০ মিনিট।
যখন সবকিছু গোচগাছ করে ৮টা ৩০ মিনিটে বাসা থেকে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হই, তখন পথের মধ্যে ঢাকায় আসার পর এই প্রথম বোবা প্রকৃতি আমাকে দারুনভাবে মুগ্ধ করছিলো।দীর্ঘ দিন মেকি শহরের মেকি সভ্যতার মধ্যে বসবাস করতে করতে আমার আমিত্বটাকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।তুমিতো জানো বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু।বসন্তের প্রকৃতিতে আমি নতুন এক মানুষে রুপান্তরিত হই,যখন একান্ত নিজের করে বসন্তের প্রকৃতিকে অবগাহন করি তখন আমার মধ্যে এক নিষ্পাপতা অনুভব করি,আমার অনুভূতিতে পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়,পৃথিবীর সমস্ত প্রেম ভালোবাসা ভর করে আমার মধ্যে।ক্যালেন্ডারের পাতাটা উল্টিয়ে বুঝেছি এখন প্রকৃতিতে বসন্ত চলছে।কিন্তু বসন্তের কোন রং রুপ গন্ধ এবার আমার মনের বীনায় সুর তোলেনি।কারণ, বসন্তের প্রকৃতির কিছু নিজস্বতা রয়েছে,যেমন কোকিলের ডাক,আম্র মুকুলের গন্ধ,খোলা প্রান্তরে মৃদমন্দ বাতাস,কাননে কাননে ফোটা ফুল,মৌমাছির গুঞ্জন,বৃক্ষে বৃক্ষে কচি পাতা আর আমার বর্ণনার বাইরে অনেক কিছু।যেখানে অবাধ বিচরনের জায়গা নেই সেখানে ককিলের ডাক শোনা যাবে কোথা থেকে।ঢাকার বাতাসে ভেসে আসে প্রেট্রোলের গন্ধ,কৃত্রিম কাননের টবে ফুল ফুটলেও মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যায়না, ঢাকার বৃক্ষরাজী নব পল্লবে ভরে উঠলেও ওদের রুপের দিকে তাকানোর একটু সময় এই ব্যস্ত নগরীর মানুষের নেই,তাই ওরা উজার করে ওদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ করেনা।এই ঢাকাতে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মত দুই একজন পাগল রাস্তা ঘাটে ঘোরাঘুরি করলেও ওরাও বুঝতে পারেনা কোন ঋতুতে অবস্থান করছে।আমার অবস্থা ঠিক এমনই।ভেবেছিলাম বসন্ত উপভোগ করতে দু চার দিনের জন্য গ্রামের বাড়ীতে যাবো,অনেক রাত অবধি বসে থাকবো আমার সেই ছেলে বেলার ন্যাংটো হয়ে ঘোলা জলে ডুব সাঁতার পারা নদীর ধারে,হেরে গলায় গলা ছেড়ে গান গাইবো 'আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোঁটে কত পাখি গায়'।যদিও আমার সেই নদীর বুকে এখন কোনো পানি নেই,তবুও ওর রুপে একটা মাদকতা আছে,তাই ওর সান্নিদ্ধের নেশা জাগে।পাইচারি করবো আমার সোনালী কৈশরের ভর দুপুরে নাটাই ঘুড়ি হাতে দৌড় পারা সবুজ মাঠে।কিন্তু হলোনা,হয়তোবা আর হবে না।যাইহোক অপ্রাসঙ্গীক বিষয়ে চলে যাচ্ছি........

যখন আমি কলেজ গেটে পৌঁছুই তখন ভ্রমন বাস কলেজে পৌঁছায়নি।আমার ভ্রমন সঙ্গীদের প্রায় সবাই বাসের অপেক্ষায় বসে আছে।কিছুক্ষণ পর, অর্থাৎ ৯টা৩০ মিনিটে ক্যাম্পাসে ভ্রমন বাসটি আসার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমন সঙ্গীরা চর দখলের মত হুরমুর করে বাসে উঠে ছিট দখল করলেও নির্ধারিত সময়ে আর বাস ছাড়লো না।কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের শুরু হলো বাকবিতন্ডা,হতে লাগলো সময় ক্ষেপন।এই বিদঘুটে পরিবেশ থেকে নিজেকে কিছুটা আড়াল করে নিলাম। হঠাৎ নিজের মধ্যে এক ভালোলাগা শুরু হলো,এক আচমকা ভালোলাগা। মনে হচ্ছিলো তিতুমীর কলেজের সবুজ মাঠ এক নতুন সাজে সেজে উঠেছে,মৃদমন্দা ফুরফুরে বাতাসে দোল খাচ্ছিলো কলেজের বোবা বৃক্ষগুলোর শাখা প্রশাখা।আকাশে চাঁদ ছিলো,আর মনে হচ্ছিলো চাঁদের মিষ্টি আলো স্ফুলিঙ্গের মত ছিটকে পড়ছিলো পৃথিবীতে।আমি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম পৃথিবীর সমস্ত কোলাহলের জাল ছিড়ে অন্য জগতে,মনের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা গানের লাইন বেরিয়ে আসছিলো 'বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা,দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা,শুধু এই পথো চেয়ে থাকা ভালো কি লাগে'।আর তোমার শূন্যতায় ভরে উঠছিলো বুক।
মনে পড়ছিলো তোমার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা।তোমার ইচ্ছে করে জোস্না রাতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে,ঝিল অথবা বিলে ডিঙ্গা ভাসিয়ে ঘুরতে,অবারিত লীলাকাম সবুজ বনানীর মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে।এগুলো শুধু তোমার ইচ্ছে হয়ে রয়েছে কিন্তু তুমি পারছনা প্রকৃতির এই বাস্তবতার পথ দিয়ে হাঁটতে।মনে হচ্ছিলো তুমি বন্দি,তুমি লোহার খাঁচায় বন্দি।আমার ইচ্ছে হয়,তোমাকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করে ছেড়ে দেই প্রকৃতির স্বর্গ ভূমিতে,তুমি পান করো প্রকৃতির অমেয় সুধা,স্নান করো ঝর্ণার স্বচ্ছ ফটিক জলে।
হঠাৎ শুনলাম বাস ছেড়ে দেবে,সবাইকে বাসে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।আমি ছিটকে পড়লাম আমার ভাবনার জগত থেকে,আর বুঝতে পারলাম আমি বসন্তে ছিলাম।
মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা১৫ বাজে।অনেকটা ভয়ে ভয়ে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু ফোনের ওপারের কোন সাড়া কানে এলো না তাই ফোনটা রেখে দিলাম।রাত অনেক হয়েছিলো তাই কিছুটা পথ জেগে থাকার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থান করছি।হঠাৎ জানালার কাঁচ ভেদ করে চোখে পড়লো এক বিশাল পাহাড়,আর এই পাহাড়ের অনেকটা দূরে সমতল ভূমির উপর দিয়ে আমাদের ভ্রমন বাসটি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে।জীবনে এই প্রথম প্রাকৃতিক পাহাড় দেখলাম তাই বার বার অবাক হচ্ছিলাম আর অবাক বিস্ময়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য অবগাহন করছিলাম।এভাবেই এক সময় পৌছে গেলাম চট্টগ্রাম শহরে।
চট্টগ্রাম শহরটা অনেকটাই পাহাড় কেটে সাজানো হয়েছে।স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি,ধনীদের প্রাসাদ সব কিছুই পাহাড়ের উপর।এখানকার জীবন যাত্রা অনেকটাই ভিন্ন মাত্রার।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব বাসে প্রায় চার ঘন্টার পথ।কর্ণফুলী নদী পার হয়ে আমাদের বাস এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করে প্রবেশ করলো পাহাড়ী পথে।পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ অতিক্রম করে যখন আমাদের বাস চলছিলো তখন আমি পলকহীন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলাম পাহাড়ের গাছপালার সৌন্দর্য্যের পাশাপাশী পাহাড়ী মানুষদের জীবনযাত্রা।মাঝে মাঝে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিলো পাহাড় কেটে চাষ করা আবাদী ফসলী জমিতে।মনে করে দেখো,ছোট বেলায় অবশ্যই পড়েছো পাহাড় কেটে এ ধরনের চাষকে বলা হয় 'জুম চাষ'।আবার কখনো হৃদয় দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম পাহাড়ের নিরব কান্না।এই পৃথিবীর বেরসিক মানুষগুলো মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গাছপালা কেটে অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত করেছে।পাহাড়গুলো যেন একটু ছায়ার জন্য ছটপট করছে।কষ্ট অনুভব করছিলাম পাহাড়ী মানুষগুলোকে দেখে,এদের জীবন যাত্রার মান অনেকটাই নিন্মমানের।এদের জীবন এবং জীবিকা উভয়ই সংগ্রামের।এদেরকে একদিকে যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যদিকে সমাজের সঙ্গে।এভাবে যেতে যেতে আমাদের বাস যখন পাহাড়ের অনেক উঁচুতে অবস্থান করছিলো তখন হঠাৎ চোখে পড়লো সমুদ্র আর অমনিতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ফেঁটে পড়লাম আমরা সবাই।কক্সবাজার পৌঁছানোর পর আমরা অবস্থান নিলাম সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত হোটেল 'লজ' এ।হোটেলে আমাদের সমস্ত জিনিস পত্র রাখার পর সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সমুদ্র স্নানের।আমি ভেবছিলাম সমুদ্রে গোছল করে ফ্রেস হয়ে খেতে যাবো কিন্তু যখন সমুদ্রে নামলাম তখন আমার সম্পূর্ণ ধারনাটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো।সমুদ্রের পানি অসম্ভব ধরনের লোনা।যখন পানি চোখে লাগছিলো তখন চোখ জ্বলছিলো,তারপরও আমাদের হৈহুল্লোরের কোন কমতি ছিলোনা।আসলে সমুদ্রের পানি শরীরে লাগলে শরীর অনেকটা আঠা এবং লবনাক্ত হয়ে যায়।সমুদ্রস্নান করে যখন হোটেলে ফিরছিলাম তখন দেখি আমার শরীরের উপর দিয়ে লবনের দানা পড়ে গেছে।হোটেলে ফিরে আবার ভালোভাবে গোসল করে স্যারের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য গেলাম অবকাশ রেস্তোরায়।সেখানে আমাদের খাবার তালিকায় ছিলো ভাত,সবজি,ডাল,সামদ্রিক মাছের শুটকি ভর্তা এবং সামদ্রিক মাছের তরকারি।আমি প্রচন্ড অভুক্ত ছিলাম তাই এত পরিমান খেয়েছিলাম যে অত খাবার আমার জীবনে এক সঙ্গে কখনো খাইনি ।কারন ২১ তারিখ সন্ধ্যার পর থেকে ২২ তারিখ বিকেল ৩টা পর্যন্ত প্রত্যেকটা ছাত্র ছাত্রীর পেটে হালকা খাবার ব্যতিত কোন ভারী খাবার পড়েনি।আমার মনে হয় ঐ দিন আমাদের লাঞ্চ করাতে গিয়ে রেষ্টুরেন্ট মালিক কোন লাভ করতে পারেনি।

মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শরীর এতই ক্লান্ত ছিলো যে,ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড রকমের সুখ অনুভব করছিলাম তাই সুখের রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে একটু বেশী সময় লাগছিলো।ঘুম থেকে উঠে দেখি হোটেলে কেউ নেই।তাই আমি আর আমার দুই হোটেল রুমমেট একটু সেজেগুজে সৈকতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।সৈকতে এসেই তোমাকে ফোন দিলাম,ভেসে আসলো চঞ্চলা সুমনার কন্ঠ তার পরেই তুমি।তোমার কন্ঠ আর সমুদ্রের গর্জন উভয়ের সংমিশ্রনে এক অন্য রকম ভালোলাগা অনুভব করছিলাম।তোমার এবং সমুদ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য বন্ধুদেরকে ফোন দিয়ে জেনে নিলাম ওরা কোথায় আছে।সিগনালের কাছে এসে পেয়ে গেলাম নঈম স্যারসহ সবাইকে।তার পর সবাই শপিংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম বার্মিজ মার্কেটের দিকে।মার্কেটে এসে সবাই কেনাকাটায় মেতে উঠলো আর আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলাম।আমার এরুপ অবস্থা দেখে নঈম স্যার জিজ্ঞেস করলো, কি স্রাবণ কেনাকাটা করছোনা যে? আমি বললাম,স্যার আমার মানি ব্যাগ হোটেলে রেখে এসেছি।উনি আমার হাতে ৫০০ টাকার দুটো নোট দিয়ে বললো যাও কেনাকাটা করো।

এরপর আমি এবং আমার বন্ধু কিছু কেনাকাটার জন্য বার্মিজ দোকানগুলোতে ঘুরতে লাগলাম।এখানকার প্রায় প্রত্যেকটা দোকানের মালিক উপজাতীয় মেয়েরা এবং বিপনন কাজটাও উপজাতীয় মেয়েরাই করে থাকে।ওদের গায়ের রং ও চেহারা বেশ আকর্ষনীয়,তাই প্রথমে ওরা ওদের সুন্দর হাসি ও চেহারা দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তারপর দাম হাঁকিয়ে জিনিসপত্র বেচাকেনা করে।ওদের হাসি ও সৌন্দর্যে আমিও যে মুগ্ধ হয়েছিলাম না, সে কথা বলছিনা,আমিও দারুনভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম।তাইতো আমি আর এমরান কিছুক্ষণের জন্য প্রচন্ড রকমের আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম ওদের সঙ্গে।আমাদের সঙ্গে ছিলো আরও একজন মানুষ ওয়াসিম।বেচারা বড্ড ভদ্রগোছের ও অতিমাত্রায় নিরীহ প্রকৃতির মানুষ।তাইতো কোন কথা না বলে আমাদের কার্যকলাপগুলো নিরব দর্শকের মত দেখছিলো এবং মাঝে মাঝে মেয়েদের মত লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিচ্ছিলো।ঘুরছিলাম আর ভাবছিলাম তোমার জন্য কি কেনা যায়।মনের মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।ইচ্ছে করছিলো সমস্ত বার্মিজ মার্কেটটাই তোমার জন্য কিনে নিয়ে যাই।যখন তোমার জন্য চন্দন,হাতির দাঁত ও হাড়গোড় দিয়ে তৈরী একটি মালা এবং খোপার কাঁটা কিনছিলাম তখন দোকানের উপজাতীয় মেয়েগুলো বলছিলো,বাবু এগুলো কাহার জন্য কিনছিস?আমি ওদের মত করেই বলার চেষ্টা করে বলেছিলাম, হামার একটা মানুষ আছে,তাহার নাম শ্রাবন্তী, আমার খুবই প্রিয় মানুষ।উত্তরে ওরা বলেছিলো,'লিয়ে নে বাবু, ও খুবই খুশী হুবে'।
তবে তোমার খোপার কাঁটা কেনার পর মনে হলো,কাঁটা পড়তে খোপার প্রয়োজন হয় কিন্তু তোমার চুলেতো খোপা হবেনা, কারন তোমার লম্বা সুন্দর চুলগুলো তুমি কেটে ছোট করে ফেলেছো।তাই খোপার কাঁটা পাঠালাম না। শ্রাবন্তী চুলগুলোর স্বাধীনতা খর্ব না করে এক বার ছেড়ে দাওনা, ওরা ওদের ইচ্ছে মত বড় হোক।

দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাড়ালাম,মনে হলো রোকেয়া আপু,খানিকক্ষণ পরখ করে দেখার পর নিশ্চিত হলাম।তাই কোন কথা না বলে চুপি চুপি ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, আর উনি মুখ ফেরাতেই আমাকে দেখে হতবাগ,তারপর আলাপ হলো।উনি বায়ু পরিবর্তনের জন্য এখানে এসেছে।আমার কেনা জিনিসগুলো দেখে আপু খুশী হলো এবং আমি জিনিসগুলো যে দোকান থেকে কিনেছি ঐ দোকানে ওনাকে নিয়ে যেতে বললো।দোকানে গিয়ে উনি আমার কেনা জিনিসগুলো কিনলো।তোমার জন্য একটা চুলের ক্লিপ কিনতে চেয়েছিলাম কিন্ত আপুর পছন্দ না হওয়াতে কেনা হলোনা।
এবার রোকেয়া আপু সম্পর্কে একটু বলি,উনি তোমাদের কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছেন।আমরা এক সাথে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি।আপুর সাথে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব সম্পর্ক রয়েছে এবং উনি আমাকে খুব আদর করেন।

বার্মিজ মার্কেট থেকে হোটেলে ফিরতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো।ভেবেছিলাম রাতের খাবারটা সেরে পরিপূর্ণ একটা ঘুম দেবো কিন্তু তা আর হলোনা।রাত ১টার দিকে নঈম স্যার সমুদ্র সৈকত থেকে খবর পাঠিয়েছেন আমাদেরকে সৈকতে যাওয়ার জন্য,তাই যেতে হলো।
স্যারের সঙ্গে যখন সমুদ্রের তীর দিয়ে হাঁটছিলাম তখন দেখলাম সমুদ্রের এক ভিন্ন রুপ।সমুদ্রের ভাঁটার কারনে পানি ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছিলো।ভাবছিলাম,এই পানি নিজের প্রয়োজনে সমুদ্রের তীরকে ভালোবেসে তীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে।তীরকে আদর দিয়ে,ভালোবাসা দিয়ে তীরকে সিক্ত করে দেয়।আবার সময় হলে স্বার্থপরের মত তীরকে ছেড়ে চলে যায়।আমার কানে মিনি টেপ রেকর্টারে বাজছিলো ছামিনা চৌধুরীর একটি গান'ফুল ফোটে ফুল ঝড়ে,ভালোবাসা ঝড়ে পড়ে না,দিন যায় দিন আসে সেতো ফিরে আসে না'।তীরের বিরহ উপলব্ধি করে,গানটা আমার হৃদয়ের সাথে মিশে যাচ্ছিলো।আর বার বার মনে পড়ছিলো তোমার কথা।তীরের মতই নিজেকে বড়ই হতভাগা মনে হচ্ছিলো, আর মনে প্রশ্ন জাগছিলো, তুমি কেন আমার পাশাপাশী হাঁটছনা? তাই সমস্ত দ্বিধা এবং দ্বন্দকে ঝেড়ে ফেলে তোমাকে ফোন দিলাম,বায়ু তরঙ্গে ভেসে আসলো তোমার শান্ত কন্ঠ স্বর।সব কিছু মিলে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছিল। আর এই প্রশান্তির রেশটুকু বুকে নিয়েই তীরকে ছেড়ে ফিরে এলাম হোটেল কক্ষে,শরীরটা এড়িয়ে দিলাম বিছানায় আর হারিয়ে গেলাম এক গভির ঘুমের রাজ্যে.........................

পরের দিন অর্থাৎ ২৩ তারিখ, আমাদের ভ্রমন তালিকায় ছিলো 'সেন্ট মার্টিন' দ্বীপ।এই দ্বীপকে আরো দুটি নামে ডাকা হয়,১:প্রবাল দ্বীপ২:নারিকেল জিনজিরা।
সমুদ্রের মৃত শৈবালগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে প্রবাল সৃষ্টি করে।আর এই দ্বীপের সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে অসংখ্য প্রবাল যা জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে দ্বীপে।অন্যদিকে দ্বীপের প্রায় সমস্ত অংশ জুড়েই রয়েছে অসংখ্য নারিকেল গাছ, তাই এই দ্বীপকে নারিকেল জিনজিরা বলা হয়।কক্সবাজার থেকে টেকনাফ গিয়ে জাহাজে অথবা ট্রলারের মাধ্যমে নারকেল জিনজিরায় পৌছাতে হয়।আর কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দুরত্ব চলন্ত বাসে প্রায় তিন ঘন্টার পথ এবং পাহাড়ী পথও অনেক উচুনিচু।আমরা যখন পাহাড়ী পথের টিলাগুলো অতিক্রম করছিলাম তখন বাস এমন ভাবে লাফিয়ে উঠছিল যে বাসের পেছনে বসা আমাদের সবার হাড়গোড় ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়ার উপক্রম।তোমাকে ফোন দেবার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগছিলো কিন্তু মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিলনা।
পাহাড়ী পথ অতিক্রম করার পর যখন সমতল ভূমি দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছিলো বড় বড় লবন চাষের মাঠ।সমুদ্রের পানি আটকিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এখানে লবন চাষ করা হচ্ছে।
দেখছিলাম আর জীবনের কল্পনা ও কৌতুহলগুলোর একের পর এক মরণ হচ্ছিলো।অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হচ্ছিলো নতুন মাত্রা।
চলতে চলতে হঠাৎ চোখ আটকে গিয়েছিলো রাস্তার পাশ দিয়ে অবস্থানরত মায়ানমার সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে পুশ ইন করা বাস্তুহারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর জীবন যাপন দেখে।এদেরকে অনেক দিন আগে পুশ ইন করা হয়ছে কিন্তু এখনো পুশ ব্যাকের কোনো উদ্যেগ নেওয়া হয়নি। ফলে এই সর্বহারা মানুষগুলো এখন না বাংলাদেশর নাগরিক , না আছে মায়ানমারে তাদের অধিকার।এই পৃথিবীতে আমরা যারা সভ্যতার বড়াই করি,মানবতার কথা বলি,ওদেরকে দেখলে আমাদের এই অহংকার নিমিষেই ম্লান হয়ে যাবে।ঘৃণা হচ্ছিলো এই পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থার প্রতি।এই পৃথিবীতে একটা কুকুর যে অধিকার নিয়ে বেঁচে আছে ,ওদের সে অধিকারটুকুও লুন্ঠিত।এই অবস্থার পরিবর্তণ আদৌ কি হবে? ভাবছিলাম এই অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো যখন প্রয়োজনের তাগিদে রাইফেল তাক করে সমাজপতিদের বুকের উপর তখন আমাদের মত মানুষেরা সমাজপতিদের পক্ষ নিয়ে ওদের নামের পাশে সেঁটে দেই জঙ্গী,দেশদ্রোহী ইত্যাদি তকমা।
ভাবনা এবং যাত্রার মধ্যে দিয়ে এক সময় পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাগরতরী 'কেয়ারী সিন্দবাদ' জাহাজে।আমাদের জাহাজ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রার শুরুতে জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রত্যেক ভ্রমন পিপাশুদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ,নদীর পার দিয়ে অবস্থিত পাহাড় ও জীব বৈচিত্র সম্পর্কে অবহিত করলেন।জাহাজ যখন নাফ নদীর মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছিলো তখন হৃদয় আমার বার বার নেচে উঠছিলো,রবীন্দ্রনাথের গানের মতই "হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে"।

পাশেই বার্মার সুউচ্চ পাহাড় আর এক পাশে নদীর কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সবুজ গাছপালা বেষ্টিত পাহাড়। আর এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী মিলে প্রকৃতি এক ভিন্ন মাত্রার আবহের সৃষ্টি করেছে।প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যের মধ্যেই অবস্থান করছিলাম আমরা। আসলে এই সৌন্দর্য বর্ণনা করার মত ভাষা এবং শব্দ আমার জ্ঞানের ভান্ডারে নেই।শুধু এতটুকু বলতে পারি,কোন চিত্রকর যখন কোন ছবি আঁকে তখন তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ইচ্ছে মত রং তুলির আঁচড় কেটে সৃষ্টি করে অনিন্দ্য সুন্দর চিত্র শৈলী।আমার মনে হচ্ছিলো,সৃষ্টিকর্তা ঠিক চিত্রকরের মতই তার সমস্ত সৌন্দর্য ডেলে দিয়ে,আনমনে নিজের হাতে এমন কৃত্তি সৃষ্টি করে প্রমান করেছেন,তিনি সুন্দর।তাইতো যখন তুমি ফোনে বলছিলে, কেমন আছি? আমি ভাষা হারিয়ে বলছিলাম,স্বর্গে আছি,স্বর্গে।ধীরে ধীরে আমাদের সাগরতরী প্রবেশ করলো সমুদ্রের বিশাল জলরাশির মাঝে।চারিদিকে শুধু জল আর জল ছাড়া চোখে কিছুই ধরা পড়ছিলোনা।ধু ধু সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ছিলো কেয়ারী সিন্দবাদের গায়ে। জাহাজ সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যখন আবার নিচে নেমে যাচ্ছিলো তখন মনে হচ্ছিলো জাহাজ যেকোনো সময় ডুবে সমুদ্রের তলদেশে চলে যাবে।জাহাজের এমন উন্মাতাল নৃত্য দেখে মেয়েরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু আমরা ছেলেরা সবাই দারুন এক এ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠেছিলাম।জাহাজে এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ দূরে চোখে ঝাপসা ঝাপসা কিছু একটার অস্তিত্ব ধরা দিলো এবং ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে এলো।আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবাল দ্বীপের সন্নিকটে চলে এসেছি।

দ্বীপে পৌছানোর পর জাহাজ থেকে নেমে সবাই ফটো সেশন করলাম।এখানে খাবার পানি খুবই দুষ্প্রাপ্য তাই সবাই তৃষ্ণা মিটিয়ে থাকে ডাবের পানি পান করে।নাকিকেল জিনজিরায় এসে যদি নারিকেল না খেয়ে ফিরে যাই তাহলে সেটা একেবারেই বেমানান হয়ে যায়।তাই নারিকেলের পানি পান করে আর নারিকেল খেয়ে শরীরের ক্লান্তি কিছুটা দূর করলাম।আমার পরনে ছিলো প্যান্ট শার্ট ও জুতা,এমন জায়গায় এমন পোশাকে নিজেকে ফুলবাবু মনে হচ্ছিলো তাই পোশাক পরিবর্তন করে শর্ট প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে নিলাম।কিছুক্ষণ খালি গায়ে বেলা ভূমির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরীরে দ্বীপের বিশুদ্ধ হাওয়া লাগালাম।মাঝে মাঝে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের মনোমুগ্ধকর সামদ্রিক ঝিনুক,শামুক ও প্রবাল এনে বলছিলো 'স্যার কিননা দুইডা ট্যহা দ্যান'।সমুদ্রের কূলে পড়ে থাকা পাথরগুলো দ্বীপের সৌন্দর্যের নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে,মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিলো তীরের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কেয়াবন।

সেন্ট মার্টিন একটি ইউনিয়ন আর দ্বীপের এই নামকরণ করা হয়েছে ইউরোপিয়ান এক ব্যক্তির নামে।এখানকার স্বল্প শিক্ষিত ও ধর্মভীরু মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস মৎস শিকার ও মৎসকে শুটকিতে প্রক্রিয়াকরণ।
দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ানোর পর আমরা কিছু সময় অবস্থান করেছিলাম কথা সাহিত্যিক ডঃ হুমায়ুন আহম্মেদের সমুদ্র বিলাসে।সমদ্র বিলাশ নিয়ে আমার কল্পনায় যেমন ছিলো কিন্তু বাস্তবের সাথে তেমন কোন মিল খুজে পেলাম না।তোমাকে ফোন করার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার সত্বেও দ্বীপে কোন একটেল নেটওয়ার্ক না থাকায় তোমাকে ফোন করা হলোনা।
দ্বীপের হৈ হুল্লোর,ঘোরাঘুরি,ছবি তোলা ও কেনাকাটা শেষ করে এখানকার একটা অভিজাত রেস্টুরেন্টে আমরা খাওয়া দাওয়ার পর্বটা সেরে নিলাম।এরপর দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল ছুই ছুই ঠিক এমনি এক সময় আমরা এই প্রবাল দ্বীপের ক্ষণিকের মমতার বন্ধন ছিন্ন করে আবার যাত্রা করলাম আমাদের অপেক্ষায় থাকা সাগরতরী কেয়ারী সিন্দবাদের দিকে.........................


সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফ ফেরার পর আমরা শপিং করার জন্য গিয়েছিলাম টেকনাফে অবস্থিত একটি বার্মিজ মার্কেটে।এখান থেকে তোমার জন্য কিনলাম তেতুল ক্যান্ডি,বড়ই আচার এবং বার্মিজ বাদাম।কেনাকাটা শেষ করার পর দিনের আলোকে বিদায় দিয়ে প্রকৃতি যখন হালকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে ঠিক তখন কক্সবাজারের ফেরার উদ্দেশ্যে সবাই বাসে উঠে বসলাম।
বাস যখন অন্ধকার বন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে লাগলো ঠিক তখন শিক্ষা সফর আয়োজক কমিটি লটারীর লাকি কুপন বিক্রি শুরু করলো।আমার কুপন কেনার তেমন কোন ইচ্ছে ছিলোনা কিন্তু নঈম স্যার যখন বললো 'শ্রাবণ, শ্রাবন্তীর জন্য কি কুপন কিনেছো?'তখন বাধ্য হয়েই তোমার জন্য ১০ টাকা দিয়ে একটি কুপন কিনলাম।কেনার পর আমার পাশে বসা বন্ধুদের বললাম 'দেখিস আমি কিছুনা কিছু পাবোই'।যা বললাম ঠিক তাই হলো, কক্সবাজার ফেরার পর যখন আমাদের হোটেলের লবিতে রাত ১২ টার দিকে লটারীর ড্র শুরু হলো তখন কুপনের তিনটি নম্বর উঠানোর পর বক্স থেকে উঠে এলো তোমার ৩৩ নম্বরের কুপনটি।আর উপহার হিসেবে পেলাম একটি নেইল কার্টার।খুব ভালো লাগছিলো, কারন জীবনের এই প্রথম লটারীর টিকেট কিনে কিছু পেলাম তাও আবার কুপনটি তোমার নামে কেনা।খুশীতে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়ে রাত একটার দিকে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু তোমার ওপারের কোন সাড়া পেলাম না।মোবাইলের কল লিষ্ট চেক করে দেখি তুমি চার বার কল দিয়েছো আমাকে।ভাবলাম কল দিয়েছো কিন্তু আমি ফোনে সাড়া দেইনি তাই হয়তো রাগ করেছো।সে জন্য আমার ফোনেত্ত সাড়া দিচ্ছোনা।আসলে এতটা হৈ হুল্লোরের মধ্যে ছিলাম যে তোমার ফোন কল আমি টেরই পাইনি।
শ্রাবন্তী আমার মনের অনেক কথাই তোমার অজানা।আমার যদি কখনো মনে হয়,তুমি আমার উপর কোনো কারণে রাগ করেছো,কিংবা তোমার কোন আচরণ যদি আমার কাছে এলোমেলো মনে হয় তাহলে আমার সমস্ত শরীরে কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে।মাঝে মাঝে ভয় হয়,যদি কখনো কোন ক্ষুদ্র,অতি সামান্য ও মামুলী কোন বিষয়ে আমাকে বড় ধরনের ভুল বুঝো।আমি জানি,কারো ভুল অথবা অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য যে গুনাবলী থাকার প্রয়োজন, তা আমার মধ্যে নেই।তাই অনেকে আমাকে মনে করে আমি একজন কঠিন হৃদয়ের মানুষ কিন্তু আমার হৃদের মধ্যেও যে একটি শান্ত এবং সুপ্ত মনের বসবাস অনেকেরই অজানা।

২৪ তারিখে আমরা রাঙ্গামাটির চিম্বুক পাহাড় পরিদর্শনের জন্য কক্সবাজার থেকে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।কক্সবাজার থেকে ১০০ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করার পর যখন আমরা গন্তব্যস্থল চিম্বুক পাহাড় থেকে ২২ কিঃমিঃ দূরে তখন প্রকৃতি আমাদের সাথে শুরু করলো এক বিরুপ আচরন।শুরু হলো গুরি গুরি বৃষ্টি।রাস্তার এক পাশে বাস থামিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিলো,কি করা যায়।বৃষ্টির গতি যদি আরো বেড়ে যায় তাহলে পাহাড়ী পথ পিচ্ছিল হয়ে যাবে, আর তাতেই ঘটতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা, এই ভেবে চিম্বুক পরিদর্শন বাতিল করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা আজকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র বন্দর ও ফয়েজ লেগ দর্শন করবো।এর পর আমাদের বাস দিক পরিবর্তন করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস!কর্ণফুলী নদী পার হতে গিয়ে ফেরির বিলম্বিত সার্ভিসের কারনে কালুর ঘাটেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো আর চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি।এরুপ পরিস্থিতিতে আমরা অবস্থান নিলাম শহরের একটি অভিজাত হোটেল 'মিসকা'তে। হোটেলে নৈশ ভোজের পর্বটা শেষ করার পর আমাদেরকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হলো পতেঙ্গা বন্দরে কিন্তু বন্দরে গিয়ে নিকষ কালো অন্ধকার ব্যতিত আর কিছুই চোখে ধরা দিচ্ছিলো না।একদিকে রাত অন্যদিকে বৃষ্টি তাই ফয়েজ লেগে যাওয়ার মত উৎফুল্লতা কারোর মধ্যেই ছিলোনা।ফলে ফয়েজ লেগ দর্শনও ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলে ফিরে এলাম হোটেল মিসকায়।

মিসকাতে আমরা অবস্থান করবো রাত ১২টা পর্যন্ত, কিন্ত বাকীটা সময় কি করা য়ায়,এই ভেবে আয়োজন করা হলো মিসকার অডিটোরিয়াম রুমের সাউন্ড সিস্টেমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করলাম।হঠাৎ মাথায় এলো এক নতুন ফন্দি,তোমাকে আমাদের এই অনুষ্ঠানে গান গাইতে হবে এই ভেবে তোমাকে ফোন দিলাম কিন্তু তুমি কিছুতেই রাজি হলে না।তাই এবার ফোন দিলাম তোমার রুমমেট সুমনাকে।সুমনার মধ্যে লাজুকতা কম,চঞ্চলতা বেশী।সুমনা গান গাইলো 'আমার সোনার ময়না পাখী' আর মোবাইলের লাউড স্পিকারে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে গান শুনলো অডিটোরিয়ামের সকল ভ্রমনার্থী।

দারুন ভাবে মুগ্ধ হলো সবাই।এমন একটা ব্যতিক্রম ব্যাপার সাড়া ফেলে দিলো সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে।সবাই সুমনাকে অভিন্দন জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো, কিন্তু সুমনার মোবাইল কোথায় কি এমন জরুরী কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে টানা একঘন্টা চেষ্টা করেও কেউ তার মোবাইলে নম্বরে ঢুকতে পারলো না।মনে হচ্ছিলো,মেয়েটা কিছু একটা হারাচ্ছে।কিছু কিছু প্রশংসা হাত পেতে নিতে হয় যা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে,সামনে এগিয়ে যাওয়ার আত্নবিশ্বাস বাড়ায়।সুমনা তেমনি কিছু হারালো।সুমনা যদি উপস্থিত হয়ে দেখতো, তাৎক্ষণিক ভাবে ও কতটা প্রিয় হয়ে উঠেছে সবার কাছে তাহলে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যেতো।আমাদের অনু্ষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলো ম্যাকতা ও এ্যান্জেলিনা নামে দুই অস্ট্রেলিয়ান বিদেশী তরুণী।ওরাও দারুনভাবে উপভোগ করেছিলো আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আর এই অনুষ্ঠানর মধ্য দিয়েই ইতি টানা হলো আমাদের মধুময় ভ্রমনের সমস্ত কার্যক্রম।প্রাত্যাহিক জীবনের টানে রাত ১২টা৩০ মিনিটে আমরা চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে........বাস তার চলন্ত গতি থামিয়ে দিলো ঢাকাতে কিন্তু জীবনের চলমান গতি চলছে জীবনের নিয়মে..........................

তোমার শ্রাবণ।


০১/০৩/২০০৫

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:৫০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×