নষ্ট ফলের মতন
বেঁচে থাকা সময়ের ভিতর কোথাও দাঁড়াতে পারি না। সাদা পৃষ্ঠার উপর নিজের অজান্তেই চুপ হয়ে থাকি। কখন কোথায় যাচ্ছি, কি কি করছি সারা দিন সারা রাত, কখন ঘুমাচ্ছি আর কখন জেগে থাকছি, ঠিক বলতে পারবো না। কখনো বাসের ছাদে, কখনো ট্রেনের বগিতে নানানজনের সাথে কথা বলছি, হাসতেছি আবার চুপ হয়ে থাকতেছি। লাল পরী নীল পরীদের সাথে মিশতেছি, হাসতেছি, ঘুমাচ্ছি আবার জেগে উঠে অন্য কোথায় ছুটে যাচ্ছি। পাতার মর্মরে দিনযাপনের লিপিতে উঠে আসছে রোদ বোঝাই সানাই।
শিশু গর্ভ থেকেই
সূর্যতাপের অনুভব যেমন চুষে নেয়, উষ্ণতায় প্যাচানো অন্ধকারে যেমন ছটফট করে তেমনি এক সময়ের তীরে, বাকল থেকে খসে পড়া ছায়ার ঘোরে, কদমের গন্ধে কাউকে কাউকে মনে রাখতে হয়, ছেড়ে যেতে পারিনা আমরা তাকে, সেরকমই সেবার ঘন বর্ষার শুরুতে খুব এলোমেলো হয়ে উঠলে মন, মগ্নচৈতন্যের রেলে চড়ে একবার ঢুকে পড়েছিলাম অজানা ফুলের পাপড়ির মধ্যে, একদম রেণুতে গিয়ে থেমেছিলাম মনে আছে। অনেক পোকামাকড়ের ভিতর নিজেকে মনে হয়েছিল, আমিও তো তাদের স্বজন, ঘরছাড়া। তারা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। খুব গায়ের কাছে নিবিড়ভাবে গা আগায়ে এনে তারা আমাকে তারাদের গল্প বলে ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের গল্প-কথা শুনেছিলাম। বাইরে তখন অনেক মানুষের পায়ের শব্দ বাজতেছিল। অনেক মানুষের গলার স্বর গম গম করতেছিল হাওয়ায়। আমার কানের পর্দায় সেসব শব্দের দাপাদাপি এখনো যেন টের পাচ্ছি।
দুজন খদ্দের গেটের কাছে পড়ে আছে। তাদের লুঙ্গি লাল। তাদের মুখে ফ্যানা। একজনের ডান হাতটা পাশের ড্রেনের কিনার ছুঁতে চাচ্ছে। অন্যজন কাত হয়ে আছে। দুহাত দুদিকে ছড়ানো।
অন্য অনেক মানুষ
হাসতে হাসতে ঢুকতেছে,
ভিতরে চা খাচ্ছে, বিড়ি সিগারেট খাচ্ছে।
কিছু টিয়ে পাখি খাচায়বন্দী
আর আমি দেখছি
রেণুর সুগন্ধীযুক্ত ঘরবাড়িগুলিতে শুধু পায়রাদের বাস। সবাই দেখি ডানা ঝাপাটায়। আর আমি তাদের ডানার ভিতর উড়ে উড়ে যাই, একটু বসি, আবার আর একটাতে যাই, আবার উড়ি। এই করতে করতে পায়রাদের পায়ের লালে আটকে থাকি।
কে যেন ফিস ফিস করে বলেছিল,
বইবা?
বইবা?
আমি অসংখ্য আমির ভিতর লুটিয়ে পড়ি, ডুবন্ত হিমের ভিতর ছড়িয়ে পড়ি আবার তাপের মধ্যে ফিরে এসে ছড়ানো ছিটানো আমিকে গেঁথে তুলি, আর বইবা? বইবা? এই ধ্বনির মধ্যে ঘুরতে থাকি আর ডুবতে থাকি।
বইবা?
বইবা?
আমি আমার মাথাটা ডান দিকে কাত করে ব্রক্ষ্মপুত্রের পানির ভিতর ডুবিয়ে তুলে তার দিকে তাকাই। সে হাসে। খুব রহস্যময়ী সে হাসি। আবার বলে,
কয়বার বইবা?
কয়বার বইবা?
খুলির মধ্যে কাশফুল ফোটে,
আমি আমার মাথাটা ডান দিকে একবার কাত করে এবং বাম দিকে আর একবার কাত করে ব্রক্ষ্মপুত্রের পানির ভিতর ডুবিয়ে তুলে আবার তার দিকে তাকাই। সে খুব নিবিড়ভাবে আমাকে দ্যাখে এবঙ হাসে। সে হাসি খুব রহস্যময়ী না। খুব সাদাসিধা হাসি। আমি তার সাদাসিধা হাসির ভিতরও কিছুক্ষণ মাথাটা চুবিয়ে রাখি। তার পর সে আমাকে দুই পাহাড়ের গল্প ব লে। জঙ্গলে বাঘ আর সিংহের গল্প বলে। হরিণের শিং খুব সুন্দর তা আমাকে শুনাতে থাকে। আমি অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারি না। এরপর সে আমার জিভেটা কেটে রাখে টেবিলে। চোখ দুটো খুব সাবধানে খুলে সে তার শাড়ীর আচলে বেধে রাখে। দু ডানার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি তাকে আটকাতে গিয়ে দেখি আমার ডানাও নাই। উধাও। সে আমার কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে কিছুক্ষণ অদ্ভূত হাসির ভিতর উচু করে ধরলো। রক্ত যখন টুপ টুপ বৃষ্টির মতো হাসির মধ্যে পড়তে থাকলো তখন সে খুব গোপন কান্নার মতোন ফুপিয়ে উঠে, আমাকে বললো, ওঠো।
ভূমিষ্ঠ্য শিশুর কান্না ছড়িয়ে পড়লো চৌদিকে।
আমি কোন কথা বলতে পারি না। খুব ভয় ভয় লাগে। বাইরে অনেক হাসির শব্দ। অনেক চুড়ির শব্দ। ট্রেন ছেড়ে গেলো। আমার খুব করে আলেয়ার কথা মনে পড়লো। ও কে মনে পড়ার পর আমি আমার কাটা মুণ্ডুর রক্তের ভিতর ছড়িয়ে পড়ি। খুব এলোমেলো হয়ে পড়ি।
রক্তের ভিতর উজ্জ্বল আবরণে ঢেকে রাখা
পাখিদের চোখ
ঠিকরে বের হবো, আলোয়াকে দেখবো।
আমি জেনেছি
আলেয়া আমার কবিতা পড়ে না। ও আমাকে বলেছে, আমার কবিতা পড়লে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অগ্নিকুণ্ডের ভিতর নাকি তার ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ও আমার কবিতা পড়েনা এখন। কিন্তু ও কবিতা পড়তে চাই। আমার শুনে খারাপ লাগে। খুব বেদনার ভিতর আয়না হয়ে ওঠে মন। লতানো রোদের ডোরায় মনে হয় - মিশে যাই, মনে হয় দেয়ালে দেয়ালে ভাঙা-চোরা সবুজ ছ্যাদলার কোষে কোষে ঢুকে পড়ি।
সংকেতের পিঠে
আলেয়া একটি কবিতা পত্র লিখেছে। এই সংবাদ দেয়ার সময় আমি তার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি, সেও।
আমাদের দেখা হওয়ার জায়গাটায় গাছ বেড়ে উঠছে।
সে আমাকে বললো, আমি কোন এক কৃষ্ণকে নিয়ে একটি পত্র লিখেছি। শুনার পর আমার চোখ ছোট হয়ে এলো। ছোট ছোট বলের মত তার চোখের মণিও দেখি ছোট ছোট হতে হতে আমার দৃষ্টির সীমা পার হয়ে উড়ে গেলো। আমি তার নাগাল পেলাম না।
খুব সাদাসিধা লাগছে অক্ষরগুলো।
সে লিখেছে;
সাদাসিধাভাবে
হে প্রিয় নাথ আমার, তোমাকে দেখিনা কতদিন বলোতো?
জানি তুমি বলতে পারবে না,
কেননা দিন ক্ষণের হিসাব রাখার মতো এতো সময় কোথায় তোমার?
আমি জানি কতদিন কত ঘন্টা দেখিনি তোমায়
কারণ আমার তো নষ্ট করবার মতো অফুরন্ত সময় আছে।
তোমাকে নিয়ে আমি কখনো স্বপ্নের দেশে যাই না
কেননা তুমি জাগরণেই
আমার পাশে থাকো সর্বক্ষণ।
হে নাথ আমার! কেমনে কাটাবো বলো তুমি বিহনে এ নিশি দিন।
তুমি কি আসতে পারো না প্রিয় স্বর্গলোক ছেড়ে
এ ধরাধামে,
শুধু আমারই প্রিয় হয়ে!
যতবার বলি ভালবাসি ততবারই যেন কম হয় তা প্রকাশে
ঠিক যতটা ভালবাসি তোমায়।
ভালবাসা পরিমাপের কোন যন্ত্র যদি কখনো আবিস্কৃত হতো
তবে দেখে নিতাম
কতটা ভালবাসি তোমায়।
আচ্ছা, তুমি তো আমার চেয়ে অ - নে - ক বড়,
তুমি বলো না তোমার মতো করে তোমায় ভালবাসতে হলে
আমাকে আর কতটুকু পথ হাঁটতে হবে!
সে পথ যদি হয় অতীব বন্ধুর, তবুও তা পাড়ি দেয়ার দুঃসাহস রাখি
মনে, কেননা আমি খুব ভাল করেই জানি
তুমি পাশে থাকলে আমি কখনোই পথ হারাবো না।
তবে তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি
আজীবন ভালবেসেও যদি তোমাকে ছুঁতে না পারি
তবে পরজনমেও তোমাকে ভালবাসার ঠিকাদারী
নেবো - কথা দিলাম।
আলেয়ার তৃষ্ণার্ত ঠোটের কোনে বালুভূমির দীর্ঘশ্বাস ওড়ে, সে অবলীলায় বলে ফেলে -
আমার বড্ড সাধ হয় তোমার বাহু বেষ্টনের আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখি নিজেকে ততক্ষণ
ঠিক যতক্ষণ আমার মনে না হবে এই ঢের আর না ।
কিন্তু সময় এলেই দেখতে পাই, আমার এই কোমনীয় সুন্দর চাওয়াটির অংকুরেই বিনাশ ঘটা
কারণ তখন আরও দুর্দান্ত চাহিদার উন্মেষ ঘটে আমাতে।
তখন আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই অস্বাভাবিক হতে শুরু করি।
মাঝে মাঝেই ভয় হয়
এই বুঝি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলাম।
এক সময় দেখি আকন্ঠ পূর্ণ হয়েছে ভালোলাগায়।
তৃষ্ণা মিঠেছে পুরোপুরি, সর্বাঙ্গ ভিজে জবজবে হয়েছে ভালোবাসায়
তবুও মনের কোন এক নিভৃত কোনে তোমাকে অ-নে-ক ক্ষণ আলিঙ্গনের তৃষ্ণা জেগেই থাকে।
তুমি বলেছ কিছু তৃষ্ণা আছে যা কিনা অফুরন্ত
আমারও তাই মনে হয়।
হয়তো কোন দিনই আমার এই ক্ষুধা মিটবার নয়।
শান্ত করে দাও আমার এই বক্ষের কম্পন
তোমার নরম সুন্দর হাতে আমাকে কর আন্দোলিত
আদরে আদরে মথিত কর আমার সর্বাঙ্গ।
উত্তেজনার শীর্ষ বিন্দুতে গিয়ে তুমি চেও না আমার অনুমতি
তখন আমি সম্পুর্ণই তোমার
কাদামাটির এই দলাটি নিয়ে যা ইচ্ছে কর
শুধু দোহাই তোমার খেলা শেষে অবহেলায় ছুড়ে ফেল না কাদায়!
- এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে মোহনের চূড়ায় আলো নিভে যাওয়া ক্ষণটুকুর ভিতর আমি নড়ে চড়ে বসি, নাকি ভাসি! পাহাড়ে চড়ে এইসব ভাবি। আর সে আমার জিভেটা কেটে রাখে টেবিলে। চোখ দুটো খুব সাবধানে খুলে সে তার শাড়ীর আচলে বেধে রাখে। দু ডানার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি তাকে আটকাতে গিয়ে দেখি আমার ডানাও নাই। উধাও। সে আমার কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে কিছুক্ষণ অদ্ভূত হাসির ভিতর উচু করে ধরে। রক্ত যখন টুপ টুপ বৃষ্টির মতো হাসির মধ্যে পড়তে থাকে তখন দেখি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে কবজিতে লেগে থাকা ঘড়ির দাগ উপরের দিকে উঠতেছে.....
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৪০