মীজানুর রহমানের সাহিত্য পত্রিকার মীজানুর রহমানের সঙ্গে আমার সরাসরি দেখা হয় নি, কিন্তু বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। শেষমেষ তাঁকে আমি দেখেছি যখন তিনি শুয়ে আছেন শেষ বিছানায়। তাঁর পত্রিকার গণিত সংখ্যা দুটো সবসময় আমার হাতের নাগালে থাকে। ইন্টারনেটে তার সম্পর্কে কী কী তথ্য আছে সেটা দেখার জন্য গুগল করেছিলাম। সচলায়তনের এই পোস্ট টি পেয়েছি । তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছলাম গণিত ইশকুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে। সে লেখাটি আমার প্রকাশিতব্য ‘যারা গণিত ভালবাসে’ বই-এ রেখে দিচ্ছি। আজকে সচলায়তনের পোস্ট দেখে ভাবলাম সে লেখাটি থাকুক আমার ব্লগে। ধন্য হোক অলসের এই ব্লগ।
লোকটা নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে, ভেসে ওঠে তার
দু’চোখে, সুদূর নীলিমার বীথিকায় পরস্পর
হাত ধরে নাচে অবিরত সঙ্গীত, কবিতা আর
বিশুদ্ধ গণিত, শোনে গোলাপ বলছে মৃদু স্বরে
‘আমিই গণিত আর গণিতই গোলাপ গূঢ় এক
ঝলসিত তরঙ্গের ভেতরে সৃজনে উন্মুখ!’
--শামসুর রাহমান
সাহিত্যের সঙ্গে গণিতের যোগাযোগ সব দেশে, সব কালেই নড়বড়ে। সাহিত্যের লোকেরা কেন জানি গণিতকে ভয় পায় (নাকি অবজ্ঞা করে)! অন্যদিকে গণিতের লোকেরা গণিতেই পেয়ে যায় সাহিত্যের রস! ফলে ব্যবধানটা থেকেই যায়। মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভোলানাথের অঙ্ক কষা কিংবা সুকান্তের জ্যামিতি চর্চা অনেকটা ব্যতিক্রম হিসেবেই আসে। তবে আমাদের দেশে গণিতের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং বৃহৎ সংকলনটির সম্পাদক কোনো গণিতবেত্তা নন। এ কাজটি করেছিলেন আমাদের এক দিকপাল সম্পাদক মীজানুর রহমান। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে গণিত সংখ্যা হিসেবে। ১৯৯৪ সাল থেকে কাজ শুরু করেন তিনি। পরে বের হয় এ দুটি খণ্ড। আমাদের জানা মতে, চার মলাটে আবদ্ধ বাংলা ভাষায় গণিতের এত বড় সংকলন আর নেই। তিনি গণিতের প্রায় সব বিষয় হয় কোনো গণিতবিদকে দিয়ে অথবা কোনো সাহিত্যিককে দিয়ে তুলে এনেছেন এই বিশাল গ্রন্থদ্বয়ে। স্পর্শ করেছেন গণিতের ইতিহাস থেকে আজকের কম্পিউটার পর্যন্ত।
মীজানুর রহমান জন্ম ৬ ফাল্গুন, ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বাবা খন্দকার ফজলুর রহমান (১৮৯৮-১৯৮৪) এবং মা কাজী খুরশিদা খাতুন (১৯০৯-১৯৯২)। বিক্রমপুরের ফাল্গুনের মধুকালে ইছামতী নদী-কোলের নিভৃত গাঁয়ে মীজানুর রহমানের জন্ম। বাবার কর্মস্থল কলকাতায় কাটিয়েছেন পুরো শৈশব ও কৈশোর, মীজানুর রহমানের ভাষায়, ‘দ্বিতীয় জন্মভূমি’তে। ১৮২৫ সালে স্থাপিত চ্যাপেল গার্লস স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু এবং মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেইন)-এ স্কুলজীবন শেষ (১৯৪৭) করেন। দেশভাগের পরপরই মীজানুর রহমান বাবা-মার সঙ্গে আপনভূমে ফিরে আসেন।
তারপর বিক্রমপুরে প্রাইভেটে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে জগন্নাথ কলেজে আইএতে ভর্তি, পাঁচ মাস পর চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি (১৯৪৯) এবং তৃতীয় বর্ষে আঁকাজোকায় ইস্তফা দিয়ে আবার জগন্নাথে ফেরা, সেখানেই স্নাতক। এরপর বিএমডিসি থেকে ডিপিএম ডিপ্লোমা লাভ।
মীজানুর রহমানরা ছিলেন তিন ভাই, ছয় বোন। মীজানুর রহমান ভাইদের মধ্যে মধ্যম। বড় ভাই ডা. মঈদ-উর-রহমান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, ১৯৫৮ থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, ময়ূরের পা গল্প সংকলনের (১৯৫৮) লেখক; ছোট ভাই ইফতিখার আহমদ রাজস্ব বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সত্যের পরাজয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ সংকলনের (১৯৯৩) লেখক। বোনেরা হলেন বেগম আখতার জাহান মির্জা (প্রয়াত) রূপালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মসচিব, নাজমা বেগম, আসমা বেগম, নাসিমা বেগম, ফরিদা বেগম ও খালেদা বেগম । সহধর্মিণী: লুৎফা খানম (প্রয়াত)। একমাত্র সন্তান আহমদ মীজান। লুৎফা খানমের মৃত্যুর পর তিনি নূরজাহান বকশিকে বিবাহ করেন। এ ঘরে তাঁর সন্তানেরা হলেন নূরজাহান বকশি, তারেক মীজান, তানিয়া ফাতেমা, ফাহিমদ মীজান। মীজানুর রহমান সম্পাদনায় মনোনিবেশ করেন সেই ১৯৪৯ সাল থেকে।
কিশোর মাসিক ঝংকার (১৯৪৯-৫০), বিনোদন সাহিত্য মাসিক রূপছায়া (১৯৫১-১৯৬১), সাপ্তাহিক ডিটেকটিভ (১৯৬১-৬৫), বাংলা-ইংরেজি মাসিক ফায়ার ফাইটার (১৯৭০-৭২), বাংলার খেয়া (১৯৯৩) ইত্যাদি কর্মজীবনের ফসল। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার কাজ তিনি শুরু করেন ১৯৮৩ সালে।
পত্রিকাটির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা হলো কামরুল হাসান, আহসান হাবীব, রশিদ চৌধুরী ও শামসুর রাহমান সংখ্যা; বৃক্ষ, নদী, গণিত ও বিদ্যাসাগর সংখ্যা।
মীজানুর রহমান সম্পাদনার পাশাপাশি বেশ কিছু সাহিত্যকর্মও তৈরি করে গেছেন। রক্ত পিছল কাশ্মীর (১৯৬৬), মলিয়ের রচিত ল্যে প্রেসিওজ রিডিকিউল-এর অনুবাদ রূপান্তর কাকাতু (১৯৮৪); স্মৃতিচারণ কমলালয়া কলকাতা (১৯৯১) এবং কৃষ্ণ ষোলোই (২০০০) রচনায় তিনি তাঁর মননশীলতা ও সৃজনশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন।
মীজানুর রহমান উত্তরাপথ শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন গবেষণাগার ও লাইব্রেরি পুরস্কার (১৯৯৫); চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা ও লাইব্রেরি পুরস্কার (২০০১) পুরস্কার পান। জাতীয় পর্যায়ে কোনো পুরস্কার বা পদক পাননি। তবে ১৯৯৩ সালে কবি শামসুর রাহমানের আহ্বানে ও সভাপতিত্বে ঢাকা জাদুঘর মিলনায়তনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মীজানুর রহমান সংবর্ধিত হন।
সাহিত্যের আঙ্গিনায় সদাব্যস্ত এই মানুষটি বাংলাদেশের গণিতপ্রেমীদের জন্য রেখে গেছেন গণিতের সবচেয়ে বড় সংকলন।
গণিতপ্রেমী মীজানুর রহমানকে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গণিত ইশকুল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
---------
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪৮