somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে আমার জীবনের প্রথম লেখা (মুক্তিযুদ্ধে যারা বাবা হারিয়েছ তোমাদের সবার জন্য উৎসর্গ)

২৫ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার জীবনে বাবার কোন স্মৃতি নেই। আমার বয়সী অন্য অনেকের মতোই। সন্তান হিসেবে বাবার আদর-ভালবাসা, বকুনি খাওয়া, বাবার স্পর্শ, শরীরের ঘ্রাণ, এসব স্মৃতির কোনটাই না। নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত বাবা শব্দটি আমার শিশু মনের শব্দ ভান্ডারে যোগ হয় নি। হতে পারে নি। সম্ভবত দরকারও পড়েনি। তারপর যখন শব্দটি শিখেছি তখন মনে হতো বাবারা অনেক দূরে থাকে। শহরে। মাঝে মাঝে আসে। বিশেষ করে ঈদের সময়।

আমরা তখন গ্রামের বাড়িতে থাকি। মা এবং আমরা তিন ভাই। সাতটি পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়ি। মোটামুটি বড় বাড়ি। জমির পরিমাণে। জনসংখ্যার দিক থেকেও। শৈশবে এ বাড়িতে বা আশপাশের যাদের সাথে বড় হয়েছি দেখতাম তারা সবাই ঈদের সময় যার যার বাবার জন্য আনন্দে উদ্বেল হয়ে অপেক্ষা করছে। ঈদে বাবা আসবেন। নুতন জামা-কাপড় নিয়ে। আনন্দের যেন সীমা নেই। আমার খালি মনে হতো আমার বাবাও আসবেন। এবারের ঈদে। অবশ্যই। ছোট্র মনের এ অনুভূতি নিয়ে অনেকেই হাসতেন। তামাসা করতেন। মাঝে মাঝে এমন হতো যে, কেউ আমাকে ডেকে বলছে ‘শামীম তোর বাবা আসছে’। আমি দৌড়ে গিয়েছি। বাড়ির দরজায়। আমার এ ছুটে যাওয়া দেখে তারা আরও মজা পেতেন। শুধু দেখতাম মাকে চুপ করে থাকতে। অথবা নিরবে কাঁদছেন। ঘরের কোণে কোথাও বসে। আমি ওসবের কোন অর্থই বুঝতাম না। আজ ওসব মনে হলে বুকটা ভারী হয়ে আসে। ঘৃনায়, লজ্জায়। কী ভয়ানক মজাইনা করেছে সে সময় আমার সাথে। আমারই খুব কাছের কিছু মানুষ।

প্রতিবার ঈদ এলে দেখতাম মা কাঁদছেন। চোখের পানি মুছছেন। বেশির ভাগ সময় নিরবে। আমি হয়তো তার পাশেই বসে আছি। কিন্তু সেসব কান্নার অনুবাদ করার কোন সামর্থ্য আমার ছিল না। ইচ্ছেটাও জাগেনি তখন। হয়তো মায়ের অঝোরধারায় কান্না চলছে। আমি এটা ওটা নিয়ে খেলছি। তারই পাশে বসে। মা কাঁদতেন ঈদের সময়। ২৬ মার্চ। ১৬ ডিসেম্বর। হয়তো সারা বছর। রাতের বেলা হয়তো খানিকটা বেশি করে। আমাদের অগোছরে।

জানি না কেউ আমাকে বলেছে কিনা। তবু এক সময় বুঝি, আমার বাবা নেই। বেঁচে নেই। তার আরও পরে জানি, আসলে বাবাকে খুন করেছে। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী। রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায়। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। আস্তে আস্তে এও বুঝতে শুরু করি যে, মা কেন ২৬ মার্চ এলে বেশি কাঁদেন। ১৬ ডিসেম্বরে কেন মার চোখ থেকে বেশি বেশি পানি ঝরে। পাড়ায় যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজে মা তখনও কাঁদেন। এভাবে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর কান্না দেখতে দেখতে আমার/আমাদের শৈশবের বেড়ে উঠা।

পরে জেনেছি বাবার বদলির চাকরি ছিল। কাজ করতেন দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-এ। সে সময়ের বড় ঠিকাদার কোম্পানী। বাবাকে যেদিন গুলি করা হয় তখন তার কোলে আমার এক খালাত ভাই ছিল। বাবা নাকি কোলের শিশুটিকে, আমার খালাত ভাইকে, রেহাই দিতে বলেছিল। বলে ছিল শিশুটিরতো কোন অপরাধ নেই। হায়নারা শোনেনি। দু’দিন মৃত্যুর সাথে লড়ে আমার সেই শিশু খালাত ভাইও শহীদ হন। আর মা হন বিধবা। আমরা হারাই আমাদের বাবাকে। যাদের কারোরই তখন স্কুলে যাবারও বয়স হয়নি।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাকে যে বয়সে বিধবা বানান সে বয়সে এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশির ভাগ মেয়ে বিয়েই করেন না। অথচ সে বয়সেই তাঁর খুব কাছের মানুষটিকে হারিয়ে শুরু করলেন নুতন এক সংগ্রাম। তিন শিশু সন্তানকে বড় করার দায় পড়লো এক তরুনী বিধবার ঘাড়ে। আমার মায়ের ওপর। আমার শহরে থাকা মার আশ্রয় হলো আমার বাবার গ্রামের বাড়ি। যে বাড়িতেই আমার শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে। আমার খুব মনে পড়ে মার সাথে রাতে ঘুমুতে যাবার কথা। বড় একটি খাটে আমরা তিনভাই এবং মা। কাতার হয়ে শুয়ে পড়তাম। প্রথমে মা, তারপর আমি (সবার ছোট হিসেবে), মেঝভাই, তারপর বড় ভাই। আমাদের তিনজন কে আগলে রেখে কী এক অজানা স্বপ্নে তাঁর সব চেয়ে সম্ভাবনাময় দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছেন। সেটি ভাবলে এখনও শিওরে উঠি। কৃতজ্ঞতায় মাথা নূয়ে আসে মার প্রতি।

সিরিয়াস অভাব বলতে যা বোঝায় সেটি হয়তো আমাদের ছিল না। সামান্য জমি-জমি থাকার কারণে ঘরে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তিন ছেলের লেখা-পড়ার খরচ? এটি নিয়ে মাকে সবসময় হিমশিম খেতে হয়েছে। আজ আমার খাতা নেই তো কাল বড় ভাইয়ের কলম নেই। আগামী কালের মধ্যে বেতন, আজাকের বিচারে যদিও তা খুবই সামন্য, না দিতে পারলে স্কুলে থেকে নাম কেটে দেওয়া হবে। পরীক্ষার ফি দিতে না পারলে নিশ্চিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না। মা সব নিরবে ব্যবস্থা করতেন। বুঝতে দিতেন না। আর মাঝে মাঝে শুধু কাঁদতেন।

আমার জীবনে সম্ভবত একটি বারই বাবার অভাব খুব প্রচন্ড রকমভাবে অনুভব করেছি। এবং কেঁদেছিও। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রথম দিন। হল থেকে বের হয়ে দেখি বন্ধুদের মধ্যে থেকে প্রায় সবার বাবা অপেক্ষা করছে। আমার জন্য বাবা নেই। থাকার কথাও না। সেদিন কেন জানি মনকে মানাতে ব্যর্থ হয়েছি। খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েও অঝোর ধারায় কেঁদেছি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক হতে চলেছে। আমার মার চুলও এখন প্রায় সাদা। অবয়বে বয়সের ছাপ। নানা রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। আজ ভাল তো কাল মন্দ। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। যে যার মতো ব্যস্ত। মা সারা দিন বাসায়। একা একা। মার এ একাকীত্ব জীবনে তাঁকে এখন আর কাঁদতে দেখি না। জানি না, কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে কিনা। নাকি শোকে পাথর হয়ে গেছেন। মনে পড়ে নিজামীর মন্ত্রী হওয়ার সংবাদে কেন জানি মা হেসেছিলেন। একটা বিদ্রুপের হাসি। একবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-পরিবারের সদস্যদের সরকার একটি সভায় ডেকেছিল। মা দাওয়াত পেয়েও সেখানে যাননি। ক্ষোভ ও ঘৃণা হয়তো এতটাই জমাট বেঁধেছে যে মার মনে, মা কোন আগ্রহ পান নি।

অনেকদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন বেগম খালেদা প্রধানমন্ত্রী। গিয়ে দেখি আমাদের উপজেলা শহরে আমার বাবার নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটি এখন শহীদ নূরুল হক সড়ক। আমরা খুশি হতে পারি নি। আমার মাও না। কারণ একই সময়ে নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে আমার/আমাদের বাবার রক্ত খচিত লাল-সবুজের পতাকাও উড়তে শুরু করেছিল। আমার মায়ের এ বেদনার স্মৃতি আমরা কোথায় রাখি!!!! কীভাবে রাখি। আমি জানি না, আমার মা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিজ চোখে দেখে যেতে পারবে কিনা???????
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০০৯ বিকাল ৩:১৫
১১১টি মন্তব্য ১০৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×