somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খোয়াড়:গবাদি পশুর কারাগার, আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য

২৪ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খোঁয়াড় হচ্ছে জমির ফসল অথবা বসতবাড়ির বাগান বিনষ্টকারী গবাদিপশু আটক রাখার গারদ বিশেষ। ফসল বিনাশ করার আশঙ্কা রয়েছে, এমন অবাধে বিচরণকারী গবাদিপশুও খোঁয়াড়ে আটক রাখার বিধান রয়েছে।কৃষি ও উৎপাদনব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে এ ব্যবস্থা অনেকটা বিলুপ্তির পথে। অথচ একসময় সর্বত্র ছিল গ্রামীণ এই ব্যবস্থার চল। মোগল আমলে যখন সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল কৃষি, তখন জমির ফসল রক্ষার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৪৭ ধারায় ৩৪ নং ক্রমিকে ইউনিয়ন পরিষদের তত্বাবধানে খোয়ার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার কথা বলা আছে।
বোধশক্তিহীন প্রাণীকে মানুষের বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি করা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অমানবিক মনে হবে।তবে এককালে খোঁয়াড়ের সঙ্গে কৃষকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা গ্রামাঞ্চলে অভিজ্ঞরা হয়তো কিছুটা জানেন।আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে খোঁয়াড় প্রায় বিলুপ্ত। অথচ কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে খোঁয়ার থাকার বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের এই খোঁয়াড় ব্যবস্থার উদ্ভব কীভাবে? বাংলাদেশে কি এখনো খোঁয়াড়ের অস্তিত্ব আছে? কীভাবে চলছে এসব খোঁয়াড়? সেগুলো চালাচ্ছেই বা কারা?
চিন্তিত মুখে দাওয়ায় বসে আছে গফুর। মহেশের খোঁজ নেই। সারাদিন খোঁজার পর বাড়ি ফিরে আমিনা জানায় মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দেওয়া হয়েছে। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' ছোটগল্পে এভাবেই উঠে আসে খোঁয়াড়ের কথা। কিন্তু এই খোঁয়াড় আসলে কী? এ যুগে কয়জনই বা খোঁয়াড়ের কথা জানেন?
নিম্নবর্গের সমাজ ব্যবস্থার উপেক্ষিত অনেক বিষয়ের মতোই খোঁয়াড় নিয়েও তেমন আলোচনা নেই। সহজ ভাষায় বললে খোঁয়াড় হলো গবাদি পশুর জেলখানা। শরৎচন্দ্রের মহেশ ছিল দরিদ্র গফুরের পালিত এক নিরীহ গরু। খাবারের আশায় অন্যের বাগানে ঢুকে গাছপালা নষ্ট করে মহেশ। বোধশক্তিহীন কোনো প্রাণী এমন কাজ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তাকে মানুষের আইনে শাস্তি দেওয়া কেমন বিধান?
ঔপনিবেশিক খোঁয়াড় ব্যবস্থা
উপনিবেশবাদ কেবল মানুষ নয়, গৃহপালিত প্রাণীদেরও জিম্মি করেছিল। সাধারণত গবাদিপশু ফসলের ক্ষতি করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ওই পশুকে খোঁয়াড়ে দেন। এক্ষেত্রে যতদিন পশুর মালিক ফসলের ক্ষতিপূরণ না দিবে ততদিন পশুটিকে খোঁয়াড়ে আটকে রাখা হয়।
১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার প্রথম গৃহপালিত প্রাণীর ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ১৮৭১ সালে জারি হয় গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন।
তবে এই আইন মোটেই শুধু গবাদি পশুর কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। আইন প্রণয়নের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, গবাদি পশুগুলো বন্য প্রাণীর আক্রমণের শিকার হতো। শুধু ১৮৯২ সালেই বার্মার ইরাবতীতে সাপ, কুমির ও বাঘের আক্রমণে ৬৮৬টি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয়ত, সেসময় গবাদি পশুর মড়ক ছিল ভয়াবহ বিষয়। ১৮৯৫ সালের মড়কে মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে বাংলার সীমান্তে আকিয়াব জেলায় ১,৫৬৩টি পশু মারা যায়। এছাড়া কোনো গরু অসুস্থ হয়ে মারা গেলে তাদের যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা হতো। সেগুলোর সংস্পর্শে এসে অন্যান্য গরু-ছাগলও আক্রান্ত হতো।
তৃতীয়ত, সরকার বার্মা জাতের গরু সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। শক্তিশালী ও উন্নত প্রজাতির গরু হওয়ায় এদের সংকরায়ন রোধ করে প্রজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়।
সংকরায়ন রোধ ও গবাদি পশুর উচ্চ মৃত্যুহারের কারণ অনুসন্ধানে মানুষের অসচেতনাকেই বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্রিটিশ সরকারের আমলারা। সেসময় মানুষ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে খুব বেশি ভাবত না। গরু-ছাগল ইত্যাদি মাঠেঘাটে অবাধে বিচরণ করত। আর তাই গৃহপালিত ও বেওয়ারিশ গরু-ছাগলের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে আনতেই সরকার গবাদিপশু অনুপ্রবেশ আইন কার্যকর করে। এর ফলে প্রথমবারের মতো গবাদি পশুর মতো ব্যক্তিগত সম্পদেও সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী খোঁয়াড় ব্যবস্থা
১৮৭১ সালে গবাদি পশু অনাধিকার প্রবেশ আইন অনুযায়ী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে গবাদি পশুর খোঁয়াড় থাকবে। এক্ষেত্রে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শুকর, হাতি, উট, খচ্চর, গাধা ইত্যাদি প্রাণী গবাদি পশু হিসেবে বিবেচিত হবে। আইনে না থাকলেও হাঁস-মুরগিও খোঁয়াড়ে দেওয়ার চল রয়েছে।
২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ীও খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের বিধান রয়েছে।
বর্তমানে ক্ষেত খাওয়ার অপরাধে কোনো কৃষক গরু নিয়ে খোঁয়ারে আসলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান ২০ টাকা, ছাগলের জন্য পান ১০ টাকা। আর পশুর মালিক সেগুলো খোঁয়ার থেকে ছাড়িয়ে নিতে গরুর জন্য ১০০ টাকা, ছাগলের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা গুনেন। যতক্ষণ না পশুগুলোর মালিক সেগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলোকে খাবার-পানি খাওয়াতে হয়।
খোঁয়ার ইজারা দিতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে নিলামের ডাক দেওয়া হয়। বাংলা বছরের বৈশাখ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এক বছরের জন্য খোঁয়ার ইজারা দেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বার ও ইউপি সচিবের সাথে আলোচনার পর নিলামের ডাক দেওয়া হয়। আগে মাইকিং করে খোঁয়ারের ডাক দেওয়া হলেও এখন তেমন দেখা যায় না। বর্তমানে কেউ খোঁয়ার নিতে আগ্রহী নয় বলে আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদেরই পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইজারায় সংগৃহীত অর্থ জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
কেন বিলুপ্ত হচ্ছে খোঁয়াড়
খোঁয়াড় থেকে আর্থিক লাভ না হওয়াই খোঁয়াড় বিলুপ্তির মূল কারণ। এখন আর হাল দিতে বা পরিবহনের কাজে গরু-মহিষের দরকার পড়ে না। দুধ আর মাংসের জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে গাভী ও ষাঁড় লালন-পালন করা হয়। আলাদা ঘর নির্মাণ করে সেখানেই গরু-ছাগল পালন করেন গবাদি পশুর মালিকরা। খাওয়ানো হয় পোল্ট্রি ফিড ও বিশেষ খাবার। এছাড়া ধানের আবাদ বিস্তৃতি লাভ করায় জমি আর অনাবাদি থাকছে না। ফলে আগের মতো গোচারণ ভূমিও নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:১৮
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×