somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (বুক রিভিউ)

২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার লেখায় উঠে এসেছে তৎকালীন ভাসমান নিম্ন পর্যায়ের মানুষের জীবনের গল্প। প্রত্যেকটি গল্পে তিনি যেন নিজের মুখে সেই সকল মানুষদের চাওয়া, তাদের আবেগ, তাদের জীবনকে বর্ণনা করেছেন। লিখেছেন রাইকমল, কবি, অভিমান, নাগিনীকন্যার কাহিনী, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, সপ্তপদী, ডাকহরকরা ইত্যাদি।

যতদূর জানি কবির জীবনকে মূল উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত তিনটি উপন্যাস রচিত হয়েছে। তারাশঙ্করের “কবি”, হুমায়ুন আহমেদ এর “কবি”, হুমায়ুন আজাদের ” কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ”

হুমায়ূন আজাদ বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত কবিদের নিয়ে উপন্যাস শুধু আমিই লিখেছি, অন্যরা লিখেছে কবিয়ালকে নিয়ে।

হুমায়ূন আহমেদের কবি পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। হুমায়ূন তার লেখায় তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো কবি নামক চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন।
এখানে আমি মোটেই কার কবি সব থেকে বড় সেটা আলোচনা করতে আসিনি। তবে হ্যাঁ, তারাশঙ্কেরে কবি যে এতদিন পরেও আমাদের মাঝে তার দ্যুতি ছড়াতে ব্যস্ত সে থেকেই প্রমাণিত হয় যে এটি পছন্দ হওয়ার মতন একটি গল্প। শৈল্পিক গুণ আছে গল্পটিতে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পুতুল নাচের ইতিকথা’র শুরুতেই যেমন কয়েকটা লাইন আমাকে গল্পটিতে আকর্ষিত করে ঠিক তেমনিই তারাশঙ্করের কবি আমাকে গল্পের সাথে আটকে থাকতে বাধ্য করেছে। গল্পের শুরুতেই লেখক বলেছেন...

“শুধু দুস্তরমত একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমত এক সংঘটন। চোর ডাকাতের বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া উঠিলো”
উপরোক্ত লাইনে পাঠক ভাবানায় ঠেই হারাতে বাধ্য। চরিত্রের ঘাত প্রতি ঘাত এখানে বাধ্যতামূলক।

হিন্দু সমাজের পতিততম ডোম বংশে নিতাই চরণের জন্ম। এই ডোমরা একসময় বাংলার নবজাগরণের বিখ্যাত লাঠিয়াল ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই পেশী শক্তির জন্য তাদের নাম ডাক ছিলো। কিন্তু কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর নবাবদের জমিদারী ঐতিহ্য ও আশ্রয় চ্যুত হয়ে এরা ডাকাতে পরিণত হয়,নিতাই এই বীরবংশী ডোম বংশেরই উত্তরাধিকারী।

"তারাশঙ্করের কবিয়াল নিতাইচরণ চরিত্রটি চট্টগ্রামের পটিয়ার বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের জীবনছায়া অবলম্বনে রচিত বলেও কেউ কেউ মত দেন। ১৯৩৯ দিকে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে যোগ দিতে এসে তারাশঙ্কর কবিয়াল রমেশশীল সম্পর্কে অবগত হন। উৎসাহী তারাশঙ্কর রমেশীলের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে অনেকের মত। তবে এ ঐতিহাসিক সূত্রের যথাযথ প্রমাণ মেলেনি এখনো পর্যন্ত”।

নিতাই এর জীবন একজন কবিয়ালের জীবন। সে পড়তে ভালোবাসে, গাইতে ভালোবাসে বাপ দাদার পেশা ডাকাতি সে করতে রাজি নয়। তাইতো বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেই এক বন্ধুর কাছে। সেখানেই সে প্রেমে পড়ে ঠাকুরঝি’র। প্রেমের বিভিন্ন পর্যায়ে কবি মনের আকুলতা, অনুভূতিগুলো যেন স্পষ্ট ধরা দিয়েছে প্রত্যেক কবিতায়।

আমি ভালোবেসে এই বুঝেছি
সুখের সার সে চোখের জল রে”।


গল্পের প্রথম পর্যায়ে ঠাকুরঝি কি নিয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ যেকোন পাঠক মাত্রই মনে রাখতে বাধ্য...
“আলকাতরার মত রঙ। ছি, ঐ কথাই কি বলে। কালো? ঐ মেয়ে কালো? রাজনের চোখ নাই। তা ছাড়া কালো কি মন্দ। কৃষ্ণ কালো, কোকিল কালো। চুল কালো- আহা হা! আহা হা! বড় সুন্দর বড় ভালো একটি কলি মনে আসিয়া গিয়াছে রে। হায় হায় হায়।
“কালো যদি মন্দ হবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেন?? কেন কাঁদ”?

ঠাকুরঝি’র প্রতি নিতাইয়ের ভালোবাসা সমাজ সস্মত নয়। নিতাই জানে ঠাকুরঝি’র সংসার আছে। গল্পের পেষণে বাধ্য হয়ে নিতাই গাইতে থাকে...

চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে বলে কে দেখেনা চাঁদ?
তার চেয়ে যাওয়াই ভালো ঘুচুক আমার দেখার সাধ।
ওগো চাঁদ তোমার নাগি-
ওগো চাঁদ তোমার নাগি-না হয় আমি হব বৈরাগী
পথ চলিব রাত্রি জাগি সাধবে না কেউ আর তো বাদ”।


গল্পের প্রবাহে এক পর্যায়ে নায়ক নিতাই ষ্টেশনের পাশের বসতি ছেড়ে যোগ দেয় ঝুমুর দলে। পুরো গল্পে আসলে চরিত্রটি খুঁজে ফিরেছে তার কবি সত্ত্বার পিছে। কবিতার পিছে। কিন্তু সেই ঝুমুর দলেও তার মন টিকতে চায়না। কারণ, অশ্লীল কবিতার সাথে যে তার কবি সত্ত্বাকে সে বিকোতে পারবেনা। আবার অশ্লীলতা না করলে দলে টেকা দ্বায়।

সকলের লজ্জা যেন জমিয়া জমিয়া বোঝা হইয়া তাহার মাথার উপর প্রচণ্ডভাবে চাপিয়া বসিতেছে। শুধু তো লজ্জাই নয়, দুঃখের যে তার সীমা ছিল না। খেঁউড় যে তার কিছুতেই আসিতেছে না”

কিন্তু বসন্তের প্রেমে সে আটকে পড়ে নিতাই। বসন্তের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে গেয়ে চলে ঝুমুর দলে। বসন্তের মৃত্যুর পর টাকার লোভ তাকে ঝুমুর দলে আটকে রাখতে পারেনি।

কবিয়াল আসলে ভালবেসেছেন দুই নারীকে। তবুও সে তার চাওয়াকে পূর্ণতা দিতে পারেনি। তাইতো গেয়েছেন......
এই খেদ আমার মনে
ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে!
হায়- জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?'


মানব প্রেমের পাশাপাশি স্বদেশ প্রেম কবি হৃদয়কে যেমন উদ্বেলিত করে নিতাইও তেমনি কাশী নামক বিভুয়ে যেয়ে স্বদেশের প্রতি তার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণে কবি নামক সত্ত্বাকে স্পষ্ট করে...

তোর সারা না পেলে পরে মা, কিছুতে যেন মন ভরে না
চোখের পাথায় ঘুম ধরে না, বয়ে যায় মা জলের ধারা”


তারাশঙ্কর কবি সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে কিছু প্রচলিত মত রয়েছে। কবিয়াল নিতাইয়ের আছে কথা ও সুরের ভাষা। ঠাকুরঝির স্বামী আছে সংসার আছে অথচ নিতাই চরণে সে নিবেদিত মন ও প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের সাথে তারাশঙ্করের কবি’র হয়তো মিল আছে কোথাও। অমিত লাবণ্য দাশ ও কেটি মিত্রের মতো আধুনিক ব্যক্তি-সত্তার ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতায় সমাজের উঁচু শ্রেণীর সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়নের গল্প। অপরদিকে, কবি আরও একটু আগে অথবা কাছাকাছি সময়ের সমাজের নিম্নবিত্ত ও সর্বহারা ভাসমান শ্রেণীর সম্পর্কের মানবিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়ানের তথা চরম দুঃখ ও বিচ্ছেদে জরাজীর্ণ কাহিনী।



-সমাপ্ত-
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৬
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×