আমার জীবনটা জানি কেমন, কেমন জানি আর সবার থকে আলাদা। নাকি এটা সবারই মনে হয়? মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনে কিছু পাইনি, অপূর্ণতাগুলো খোঁচা দেয়। আবার ভাবি যা পেয়েছি বা পাচ্ছি তাই বা কম কি? কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাবার সবচেয়ে বড় অসুবিধা বোধোহয় এটাই - মনটা সন্তুষ্ট হতে চায় না। 3110 থাকলে N70 কিনতে মন চায়, আর N70 কিনলে N96 থাকলে কি কি করতে পারতাম সেই চিন্তা মনে ভর করে। 42 inch Bravia S-Series LCD TV কিনলে মনে হয় - আহা! Z-Series হলে কতোই না মজা হতো। একটা সময় DVD প্লেয়ার অস্পৃশ্য বস্তু বলে মনে হতো আর এখন PS3 কিনে Blu-ray দেখতে মন চায়। ২০০৫ এর আগে নিজের PC ছিলো না, আর এখন ৪ গিগা RAM আর ২ গিগা PCI-E তে GTA-4 খেলার দিবাস্বপ্ন বিভোর। আজব আমি....আজব মানুষ।
তবে যতো যাই বলে মানুষ হয়েছি বলে সবকিছু স্বভাবের উপরে চাপিয়ে দেবো না, দেয়া যায়ও না। কিছু কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। এগুলো মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, মনকে সান্ত্বনাও দেয়া যায় না, আবার এতোই ক্ষুদ্র যে হেসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে বা নিজেকে বলতে ইচ্ছে করে - "ব্যাপার না"। কিন্তু পারি না। মনে হয় এগুলো তো আমার পাওনা ছিলো, তবে কেন আমি বঞ্চিত হলাম, কেন জীবন আমাকে বঞ্চিত করলো। আমার এখনও মনে আছে - ছোটবেলায় সদ্য এ্যামেরিকা ফেরত ফুফাতো খেলানার ঢের দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কতোগুলো খেলনার প্রেমে, কতোগুলোর লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। একটা লাল গাড়ি ছিলো এর মধ্যে, পিছনে চাবি লাগানো ছিলো। চাবিটা ঘুরিয়ে দিলে সামনে এগিয়ে চলতো গাড়িটা। সেই বয়সে গাড়িটাকে আমাকে কি পরিমাণে আকর্ষণ করতো আমি তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমার এখনো গাড়িটার বডিতে আলো পড়ে যে আলোর ঝলকানি চোখে ধরা দিতো তাও মনে আছে। গাড়িটা যেনো আমি নিজের ভাবতে শুরু করেছিলাম। সারা বাড়ি এটা নিয়ে খেলতাম, নিজের রুমে নিয়ে খেলতাম। ওরা যেদিন এ্যামেরিকা ফেরত যাবে তার আগের দিন রাতে গাড়িটা আমি বিছানার ওপর রেখেই ঘুমিয়েছিলাম। সকালে ছিলো ওদের ফ্লাইট। সকালে উঠে দেখি বাসা প্রায় খালি। আমি আর মা খালি বাসায়। জানলাম ওরা এয়ারপোর্ট চলে গিয়েছে এবং শুধু তাই নয়, গত রাতে ব্যাগপত্র গোছানোর সময় গাড়িটাও নিয়ে গিয়েছে। ঐদিন সারা সকাল গাড়িটার কথা মনে করে কেঁদেছি। বালিশ চাপা দিয়ে দুপুর অব্দি শুয়ে ছিলাম।
নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছিলো। আজ ২০০৯ এ এসে, একবিংশতম জন্মদিনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন চিন্তা করি, তখন মনে হয় - হয়তো ওরা ঠিকই করেছিলো। হয়তো ঐ সময় আমার চেয়ে বেশি জ্যামিতি বক্সের দরকার আমার কাজিনটারই ছিলো। কিন্তু জিনিসটা তো আমার ছিলো, আমাকে দেয়া হয়েছিলো। আবার আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। জানি না গিফট কথাটার সাথে "কেড়ে নেয়া" কথাটা কতোটা সামন্ঞ্জস্যপূর্ণ - কিন্তু এটুকু জানি যে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।
যে কাজিনের কথা বললাম আমার জ্যামিতি বক্সটা পেয়েছিলো তার সাথেও আমার এমনই একটা ঘটনা ঘটেছিলো। ওর আব্বু বিএনপি করেন, সাদেক হোসেন খোকার সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। খোকা সাহেব তার বছর খানেক আগে বোধোহয় ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন (আমি ঠিক জানি না)। সেই সময়ই বাগিয়ে নেয়া কিছু স্পোর্টস কিট খোকা সাহেব আমার ঐ কাজিনটিকে উপহার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলো। ক্রিকেটের ২টা ফুল সেট সরন্ঞ্জাম (স্টাম্প, গ্লাভস, প্যাড, কিপার'স প্যাড, হেলমেট) সাথে ৮টা GM ও SG ব্যাট আর ২ বাক্স কাঠের বল, ২টা ক্যারম সেট, আর ২টা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাস ফুটবল। ওদের বাসায় যেতাম আর দেখতাম কিভাবে ও বাসায় আয়নার সামনে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছে। বন্ধুরা মিলে পাড়ায় টেপটেনিস ক্রিকেট খেলতো কিন্তু সেখানেও ও যেতো পূর্ণ সাজে সজ্জিত হয়ে - গ্লাভস, প্যাড আর হেলমেট পরে। ওর খেলার সরন্ঞ্জামগুলোর ব্যবহার ঐটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আমার ফুফু আমায় খুব আদর করতেন। তিনিই আমাকে বলেছিলেন একটা ব্যাট তিনি আমাকে দেবেন ভাইয়াকে বলে। কিন্তু না, তিনি পারেননি। ভাইয়া কোনোদিনও রাজি হয়নি তার এ ৮টি GM ও SG ব্যাটের একটিও আমাকে দিতে। আমি ওকে মাঠে বল করেই যেতাম, করেই যেতাম। ও চার মারতো......ছয় মারতো......বল দূরে চলে যেতো.....আমি কুড়িয়ে আনতাম.....আবার বল করতাম.....ও লফটেড স্ট্রেট ডাইভ করতো.....বল আমার বুকে লাগতো বা নাকে লেগে রক্ত ছুটতো। ঐ ৮টা ব্যাটের ১টা মাত্র আজো টিকে আছে ভগ্নদশায়। বাকিগুলো বন্ধুদের মাঝে বিলিয়েছে, ঘুনে খেয়েছে, বাসা রং করার সময় হারিয়েছে.......কিন্তু তাও আমার কপালে জোটেনি। চাচা সৌদি আরবে থাকেন, একবার দেশে আসার আগে ফোন করেন। আমাদের কি লাগবে জিজ্ঞেস করেন। আমি আর আমার কাজিন দু'জনেই গেইম খেলার জন্য ২টা SEGA মেশিন চাই। চাচা দেশে আসেন, বিদেশী কার্টন খোলেন, ভেতর থেকে SEGAও বেরিয়ে আসে। তবে ২টা নয়, ১টা। আমাকে এবারো বুঝানো হলো লাগেজের ওজন বেশি হলে এয়ারপোর্টে আটকে দেয়। তবে এবার একটু বড় হয়েছি তাই আর ঘটনাস্থলেই কাঁদি না। আস্তে করে রুমে চলে যাই, বালিশটা মাথায় চেপে ধরে একটা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই - "কেন আমি? কেন আমি....?"
২০০৩ এ প্রথম যখন পিসি কিনেছিলো কাজিনটা আমাকে ছুঁতেও দিতো না - তার ধারণা আমি পিসিতে ভাইরাস ধরিয়ে ফেলবো! (মা'বুদ জানেন এটা কেমনে সম্ভব!), ফাইল ডিলেট করে ফেলবো। আমিও দিনের মধ্যে ১বার ভার্চুয়া কপ বা NFS খেলতে দিলে যেন আঁকাশের চাঁদটা হাতে পেতাম। ঐ দিনগুলোর দুঃস্মৃতির পর আর কোনোদিন কোন পিসি ধরার আগ্রহ পাইনি। ও হ্যাঁ, PC পাওয়ার পর SEGA মেশিনটা ও আমাকে দিয়ে দেয় - বলাই বাহুল্য ওটা আর গেইম খেলার অবস্থায় ছিলো না, নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
মামা থাকতেন হল্যান্ড। ১০ বছর পরে দেশে ফিরলেন এই বছরের জানুয়ারীতে। খালাতো ভাই দু'টো পেলো দু'টো আইপড, আর কি পেলাম বলুনতো?
=> মামা এবার অনেক তাড়াহুড়ো করে দেশে ফিরেছি তো, কিছু আনার সময়ও পাই নাই..........
=> আরে ধুর কি যে বলো! কিছু আনা লাগবে না, তুমি এতোদিন পরে আসছো এটাই অনেক।
খালু ফিরলেন বিদেশ থেকে। সবার কপাল খুলে, কিন্তু আমার এখনো সেই ফুট্টুস। অবশ্য এখন আর আফসোস হয় না।
এই বঞ্চনাগুলো আর কিছু না হোক আমাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। আজ যখন আমি আমার এ্যামেরিকাবাসী ফুফুকে ঘন্টার পর ঘন্টা কষ্ট করে স্ক্যান করে পাতার পর পাতা প্রয়োজনীয় দলিলপত্রের কপি পাঠাই মনে হয় এইতো প্রতিশোধ নিচ্ছি। আজ ঐ ফুফাতো ভাইটির পিসি বা খালুর ল্যাপটপের নানাবিধ ভাইরাস আর সফটওয়্যার জনিত সমস্যার সমাধান নেই প্রতিশোধের আত্মতৃপ্তিতে মনটা ভরে উঠে। আজ যখন ব্লগে একটা মানুষকেও কোন একটা গান বা সফটওয়্যারের লিংক দেই, পিসির কোন একটা সমস্যার সমাধান করি আমি যেনো আমার আত্মীয় আর বন্ধুটির ওপরই প্রতিশোধ নেই। আজ যখন কোন পোস্টে একটা প্লাস পাই, মন্তব্যে একটা ধন্যবাদ পাই তখন বুঝি আমার প্রতিশোধ ভালো মতোই এগোচ্ছে - তবে প্রতিশোধের আগুনটা এখনও নেভেনি।
লক্ষ্য করুন পোস্টটি কেমন অতিনাটকীয় ভাষায় লেখা হয়েছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। মানুষ স্বভাবগতভাবেই তার জীবনের দুঃখগুলোকে অতিনাটকীয় রূপ দিয়ে বর্ণনা করতে ভালোবাসে। এটা নিতান্তই এই ভয় থেকে যে আরেকজন হয়তো তার মনের অবস্থাটা ঠিকভাবে বুঝতে পারবে না। সারাজীবন মানুষকে দেখেছি মামা, চাচা, খালু, ফুফাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পায়। আমি আজ অব্দি পাইনি। আগে এটা ক্ষোভ ছিলো, সময়ের সাথে অভিমানে পরিণত হয়েছিলো আর এখন জীবনের এমন একটা অধ্যায় যা ফিরে দেখলে হাসি পায়। সবাই ভালো থাকুন।
* আশা করিতেছি আমার সুপ্রিয় আত্মীয়-স্বজনগণ আমার এই পোস্টখানি পড়িয়া দেখিবেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করিবেন।
ব্লগ হালখাতা:
* পোস্ট করেছেন: ২১৬টি
* মন্তব্য করেছেন: ১১,৫৮৩টি
* মন্তব্য পেয়েছেন: ১৫,৬৮০টি
* ব্লগ লিখেছেন: ১০ মাস ৩ দিন
* ব্লগটি মোট ২,০০,০১৭ বার দেখা হয়েছে
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



