বিংশ শতকের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আসাদ। তিনি জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ইহুদী ছিলেন। খুব অল্প বয়সে তিনি জার্মানির(তথা ইউরোপের) তৎকালীন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ পত্রিকায় সাংবাদিক ছিলেন। এছাড়া রোড টু মেক্কা, ইসলাম এট ক্রসরোডস এবং কোরানের ট্রান্সলেশান লিখে তিনি ইউরোপীয়ান এবং আরবদের কালচারের মধ্যে প্রথম ক্রস-কালচারাল নিরপেক্ষ যোগাযোগ স্থাপনকারী। বিখ্যাত এনথ্রপলজিস্ট তালাল আসাদ তাঁর এবং তাঁর বেদুঈন স্ত্রী মুনিরার পুত্র। হ্যাইম ওয়্যাইজম্যানের সাথে তাঁর এই কথোপকথনটা যখন সংঘঠিত হয় তখনও তিনি ইহুদী ছিলেন।
আমি তাঁর লেখা বই ১৯৫৪ সালে সিমন এন্ড শুস্টার এর নিউ-ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত "রোড টু মেক্কা" থেকে অনুবাদ করেছি। পৃষ্ঠা নং ১০১-১০২। অনুবাদে এটাই আমার প্রথম প্রয়াস, তাছাড়া বাংলায় আমি খুব একটা ভাল না, শব্দচয়নে ভুল হলে ক্ষমা করবেন। বন্ধনীভুক্ত লেখা আমার নিজের।
তাহলে শুনুন মুহাম্মদ আসাদের মুখেই ওয়াইজম্যানের সাথে কথোপকথন।
//
আমার এখনও মনে আছে জায়নিস্টদের অবিসংবাদিত নেতা ডঃ হ্যাইম ওয়াইজম্যানের সাথে আমার এ (ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ) ব্যাপারে কথোপকথন। আমার যদ্দুর মনে আছে তিনি তখন লন্ডনে থাকতেন (১৯২২ সালে)। ফিলিস্তনে তিনি তখন মাঝে মাঝে আসতেন। আমার সাথে তাঁর যখন কথা হয় তখন তিনি ফিলিস্তিনে এসেছিলেন। (মুহাম্মদ আসাদ তাঁর চাচার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিনে, তিনি অস্ট্রিয়ার অধিবাসী ছিলেন।) আমার তাঁর সাথে দেখা হয় এক ইহুদী বন্ধুর বাসায়। এই লোকটার(ওয়াইজম্যানের) অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর তীব্র চাহনি দেখে যে কারও অভিভূত না হয়ে উপায় নেই।
তিনি ইহুদীদের জন্য একটা দেশ বানানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বলছিলেন। বিশেষ করে বিদেশে যারা ইহুদী থাকেন তাদের মধ্যে ইহুদীদের জন্য একটা নিজস্ব ভূমির স্বপ্নের প্রতি যেরকম প্রতিক্রিয়া থাকা দরকার তার চেয়ে অনেক কম প্রতিক্রিয়ার কথা বলছিলেন। অন্যান্য জায়নিস্টদের মত তাঁরও ফিলিস্তিনে যা হচ্ছিল তার নৈতিক দায়িত্ব বহির্বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। (মুহাম্মদ আসাদ সেসময়ে ইহুদী হওয়া স্বত্বেও ফিলিস্তিনিদের থেকে তাদের মাত্রভূমি কেড়ে নিয়ে ইহূদীদের জন্য দেশ বানানোর বিরুদ্ধে ছিলেন, উল্লেখ্য বর্তমান সময়েও লক্ষ লক্ষ ইহুদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে, এমনকি অনেক রাব্বাই-ও।) তাঁরও এই প্রবণতা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ঘরে আর যারা ছিলেন তারা ওয়াইজম্যানের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, এবং তারা ওয়াইজম্যানের প্রত্যেকটা শব্দ খুবই মনোযোগের সাথে শুনতেছিলেন। তাঁদের এই শ্রদ্ধাশীলতা ভেদ করে আমি ওয়াইজম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম :
"আরবদের নিয়ে কি আপনার কোন চিন্তা আছে?"
রুমের আবহাওয়া দেখে মনে হল প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে আমি বিরাট অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছি। ডঃ ওয়াইজম্যান খুব ধীরে ধীরে তাঁর মুখ আমার দিকে ফেরালেন, হাতের কাপ টেবিলে রাখলেন এবং খুবই আশ্চার্য্যান্বিত হয়ে বললেন:
"আরবদের নিয়ে?"
"না, মানে আপনি কিভাবে ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের নিজের দেশ বানাবেন যখন আরবরা প্রচন্ডভাবে তার বিরোধিতা করতেছে? তাছাড়া আরবরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ট। (সেসময়ে প্রতি দশজন আরবের অনুপাতে একজন ইহুদী ছিল।)"
ওয়াইজম্যান একটু কাঁধ ঝাকালেন আর নিরসভাবে উত্তর দিলেন:
"আমরা আশা করি কয়েক বছর পর তারা এখানে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেনা। তাঁর কথা সত্যি হয়েছিল। "
"আপনি এই সমস্যা নিয়ে অনেক বছর যাবৎ কাজ করতেছেন। আপনি নিশ্চয়ই আমার থেকে বেশি জানেন। ধরে নিলাম আপনার কথামতে একসময় আরবরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেনা। কিন্তু এমনকি আরবদের বিদ্রোহের কথা বাদ দিলেও, আপনাকে কি কখনও নৈতিক দিক থেকে (আরবদের থেকে তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার) এই কাজটা অন্যায় মনে হয়না? আপনার কি একবারও মনে হয়না যে যারা এই ভূমিতে সবসময় বাস করেছে তাদের থেকে তাদের শতবছরের ভূমি কেড়ে নেওয়াটা অন্যায়?"
"কিন্তু এটা তো আমাদের দেশ" ভ্রু কুঁচকে বললেন ডঃ ওয়াইজম্যান "আমাদেরকে অন্যায়ভাবে যেটা থেকে বন্ঞিত করা হয়েছে আমরা শুধুমাত্র তা ফেরৎ চাচ্ছি। এর বেশি কিছু তো না।"
"কিন্তু ইহুদীরা তো প্রায় দুইসহস্রাব্দ এখান থেকে বাইরে ছিল। তার আগে আপনারা এই দেশ শাসন করেছেন, তাও কখনও পুরোটা না, এবং মাত্র পাঁচশ বছরেরও কম। আপনার কি মনে হয়না, আপনার একই যুক্তি দেখিয়ে আরবরাও স্পেইনকে তাদের কাছে ফেরৎ দেওয়ার দাবি করতে পারে? তারা তো স্পেইন প্রায় সাতশ বছর রাজত্ব করেছে এবং মাত্র পাঁচশ বছর আগে সম্পূর্ণভাবে বহিস্কৃত হয়েছে।"
দৃশ্যতই ডঃ ওয়াইজম্যান অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন। বললেন "ননসেন্স। আরবরা শুধুমাত্র স্পেইন জয়ই করেছিল, এটা কখনই তাদের মাতৃভূমি ছিলনা। তাই তাদেরকে যে বহিস্কার করেছিল স্প্যানিয়ার্রডরা সেটা ঠিকই ছিল।"
"আমাকে মাফ করবেন" বললাম আমি, "কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা এখানে কিছু অনিচ্ছাকৃত ঐতিহাসিক ভুল তথ্য দিচ্ছি। কারন, হিব্রুরাও কিন্তু ফিলিস্তিনে দিগ্বিজয়ী হিসেবেই এসেছিল। তারা আসার আরো হাজার বছর আগে থেকেই এখানে অনেক সেমিটিক আর নন-সেমিটিক গোত্র বাস করত। যেমন ধরেন অ্যামরাইটস, এডমাইটস, ফিলিস্টাইনস, হিটাইটস, মোবাইটস। এইসব গোত্রগুলো কিন্তু ইসরাইল (জ্যাকব বা ইয়াকুব) এবং জুডাহ -এর সমকালেও বাস করত। তারা এখানে বাস করত এমনকি যখন রোমানরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এখান থেকে বহিষ্কার করেছে তখনও। তারাই এখানে এখনও বাস করছে। সপ্তম শতকে যে আরবরা সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন জয় করল তারা সবসময়ই এখানে খুব ছোট জনসংখ্যা ছিল। বাকি যাদেরকে আমরা ফিলিস্তিনি অথবা সিরিয়ান আরব হিসেব ধরে নিই তারা প্রকৃতপক্ষে এদেশেরই আদিবাসিন্দা। তাদের অনেকেই মুসলিম হয়েছে, অনেকেই খ্রিস্টান থেকে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরা তাদের একইধর্মের আরবদেরকেই বিয়ে করত। কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন যে ফিলিস্তিনে এখন যারা আছে, যারা আরবী কথা বলে হোক মুসলিম অথবা খ্রিস্টান, তাদের মেজরিটি সরাসরি এখানকার আদিবাসিন্দাদেরই সন্তান-সন্ততি? তারাই এখানকার অকৃত্রিম এবং আদিবাসিন্দা এই যুক্তিতে যে তারা এখানে বাস করতেছেন এমনকি হিব্রুরা এখানে আসার শতশত বছর আগে থেকে?"
আমার হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া দেখে ডঃ ওয়াইজম্যান একটু হাসলেন ভদ্রভাবে এবং এই বিষয়ে আর কোন কথা না বলে অন্যবিষয়ে চলে গেলেন।
//
নোট: উইকিপিডিয়ার লিংক শুধুমাত্র চিনার সুবিধার্তে দেওয়া। ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিষয়ক সংঘর্ষে উইকিপিডিয়ার বিষয়বস্তু কখনই নিরপেক্ষ হয়না, ইসরায়েলের দিকেই পক্ষপাতিত্বপূর্ণ থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ৭:০৪