আগের পর্ব।
যুক্তরাষ্ঠ্রের ষাটের দশকে জমজমাট নাগরিক আন্দোলন, যা মূলত কালদের অধিকার আন্দোলনই ছিল, সে সময়কার কথা স্মরনে আনা যেতে পারে। আরো বছর তিরিশেক আগে ন্যাশান অফ ইসলাম গঠিত হয়েছিল। কালদেরকে যখন ইউরোপীয়ানরা দাস করে নতুনবিশ্বে নিয়ে এসেছিল, তখন তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ ভাগ মুসলিম ছিল, অনেকর হিসেবে সেটা ৫০-৬০ ভাগও হবে। তাদের নতুন পরিচয় দাসের সাথে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ও ভুলতে হয়েছিল, তাদেরকে জিসাসকে সেইভিয়ার হিসেবে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদেরকে এই বলেও মগজধোলাই করা হয়েছিল যে তারা নিচের জাতি, গডের পরিকল্পনায় তাদের কর্ম হচ্ছে সাদাদের দাসগিরি করা, এটাই গড/জিসাস তাদের নিয়তি রেখেছে, তা না করলে জিসাস তাদের উপর খেপে যাবে এবং তারা ইটারনাল ডেমনেশান (Eternal Damnation) -এ পড়ে যাবে, তাদের সালভেশান (salvation) হবে না। আখিরাতে তাদের অনন্ত দোজখে থাকতে হবে, মুক্তি নেই। লিংকনের আমলের গৃহযুদ্ধের পর দাসবৃত্তি অফিসিয়াল বিলুপ্ত হলেও, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের দিক দিয়ে কালদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না, কেকেকে-র ত্রাসে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে কালরা নতুন ধর্মে দীক্ষিত হল, তারা শুনেছিল ইসলাম সবাইকে সমানাধিকার দেয়, সাদা-কালোর মধ্যে গড কোন তফাৎ করে না। ইসলামের নাম নিয়ে একটা বর্ণবাদী ন্যাশান অফ ইসলাম নামে ধর্মের জন্ম নিল, যেখানে বলা হত "গড ইজ ব্ল্যাক" এবং ইসলামের সাথে খুব কমই এর সাদৃশ্য ছিল। এখানে ধর্মের জন্ম আর ব্যবহার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্যই, পরজাগতিক সিদ্ধিলাভের জন্য নয়। কিন্তু এই ধর্ম তাদেরকে একটা ভিন্ন পরিচয় দিল, এরকম ভিন্ন পরিচয় তাদেরকে এক হতে অনেক সহায়তা করল। এখন শুধু তারা সাদাদের থেকে চামড়ার রং দিয়েই ভিন্ন নয়, বরং তাদের ভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ও আছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য ধর্মকে ব্যবহার এখানে শুরুও নয়, শেষও নয়, শুধু একটা উজ্জ্বল উদাহরন মাত্র। জাতিপ্রথা, ধর্ম এবং অন্যান্য মানুষকে বিভিন্নতা দেওয়া পরিচয়গুলো সবমসয়ই অধিকার আদায়ের জন্য যেমন ব্যবহার হয়েছে, তেমনি অত্যাচারের জন্যও ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু এইসব পরিচয়ভিন্নতার জন্যই এরকম আন্দোলন বা অত্যাচার হয়েছে তা নয়, বরং অত্যাচার-অবিচার হয়েছে বলেই এসব পরিচয়সাম্যতা বা পরিচয়ভিন্নতা পার্শ্বঅনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
তেমনি আমাদের সাথে পাকিস্তানিদের সংগ্রাম প্রথমত এবং প্রধানত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। পাকিস্তানিরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে কারন তা তাদের অত্যাচারকে লেজিটিমেসি দেওয়ার জন্য দরকার ছিল। আমরা আমাদের বাঙালিত্বকে ব্যবহার করেছি কারন তা আমাদেরকে আমাদের একতা এবং একটা কমন পরিচয়, যা হানাদার পাকিস্তানি ওপনিবেশবাদীদের থেকে ভিন্ন, এরকম একটা পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু সে পরিচয়টাই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মূখ্য কারন না, বরং অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বন্ঞনাই মূল কারন আর সে কারনকে আগে বাড়ানোর জন্য পরিচয়ভিন্নতা তৈরীর দরকার ছিল। যদি হাইপথেটিকালি এরকম হত যে পশ্চিম আর পূর্ববঙ্গ একটা দেশ হত আর পশ্চিমিরা আমাদেরকে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকার দিতনা, তখন পূর্ব বাংলার মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এক হয়ে, ইসলামের নামেই পশ্চিমিদের বিরুদ্ধে লড়ত। তখনও ধর্মকে পরিচয়ভিন্নতার জন্যই ব্যবহার করা হত এবং ধর্ম সেখানেও মূল কারন হতনা, বরং পার্শঅনুঘটক হিসেবেই থাকত। মূল কারন তখনও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামই থাকত। বাংলাদেশ নামক রাষ্ঠ্রে সিলেটিদেরকে ভিন্ন এথনিক অরিজিনের ধরা যায়, তাদের সংস্কৃতি, ভাষা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বেশ ভিন্ন। চট্টগ্রামের লোকের সংস্কৃতিও বেশ ভিন্ন, ভাষাও। কিন্তু তবুও এই দু'এলাকার মানুষ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ঠ্র কাঠামো থেকে পৃথক হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কেননা তারা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না। তাই আমাদের "বাঙালি" হওয়া আর পাকিস্তানিদের "অবাঙালি" হওয়া, এজন্যই তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে, আমরা "বাঙালি"-দের জন্য আলাদা রাষ্ঠ্র প্রতিষ্ঠা করেছি এই ভাষ্যটা কোন হিসেবেই সঠিক না। এরকম হলে "একজাতি-তত্ত্বের" পতন ঘটতনা। আবার ধর্মনিরপেক্ষতা কোনমতেই মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র না। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ১৫-২০ বছরে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কোন কথাই হয়নি তেমন, ছয়দফা দাবির পুরোটাই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য ছিল, কোথাও ধর্মনিরেপক্ষতার কোন লেশই নেই। প্রকৃতপক্ষে সেসময় ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে পশ্চিম ইউরোপীয়দেরও পরিষ্কার ছিলনা তেমন, যদিও তারা ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের ৮০-৯০ভাগ মানুষ সেসময় অশিক্ষিত ছিল, মধ্যবিত্ত ছিল বড়জোর শতকরা ৪-৫ ভাগ, যারা আবার যুদ্ধ করেছে খুবই কম এবং যাদের একটা বিরাট অংশ ২৪ বছর আগে পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল, সে ৪-৫ ভাগের কিয়দংশের ধারণাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলাটা যুক্তিযুক্ত না। বাংলাদেশের মানুষ মোটামোটি ধর্মীয় ব্যাপারে সহনশীল, সেটা হাজার বছর ধরেই, তাই আলাদাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারনাটার কোন দরকার পড়েনি। হয়ত সারপ্রাইজিং শুনাবে, কিন্তু জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তানকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বানাতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান কোথাও তেমন গুরুত্ব পায়নি। জিন্নাহ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ একজন লোক, বিজেপির আমলে ভারতে পররাষ্ঠ্রমন্ত্রী হওয়া জাসওয়ান্ত সিং-এর বইতে পড়ে দেখতে পারেন। সেই ৬০ এর দশকে বাংলাদেশীরা সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে এত অগ্রসর হয়ে যায়নি যে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনার জন্য যুদ্ধ করবে। পাকিস্তান ধর্মরাষ্ঠ্র ছিল এই দাবিটা কি যৌক্তিক? পাকিস্তান রাষ্ঠ্রের সেসময়কার ইতিহাস, কার্যক্রম এবং বাস্তবতা বিবেচনা করলে পাকিস্তানকে ধর্মরাষ্ঠ্র বলার কোনই যৌক্তিকতা নেই। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল, কিন্তু সেটা কোন দেশে নেই? যুক্তরাষ্ঠ্রকে কি ধর্মরাষ্ঠ্র বলা যায়? কিন্তু যুক্তরাষ্ঠ্রের রাজনীতিতে এখন যেরকম ধর্মের প্রভাব সেরকম পাকিস্তানেও সেসময় ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ঠ্রের আদালত রাষ্ঠ্র জন্মের একদশকের মধ্যেই আবুল আ'লা মওদুদীকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল রায়টের জন্য, কোন ধর্মরাষ্ঠ্র সেটা করে না, যদিও পরে মধ্যপ্রাচ্যের চাপে সে হুকুম রহিত করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের ইসলামিক রিপাবলিক বলে একটা ট্যাগও ছিল, কিন্তু যে অর্থে ইরান ধর্মরাষ্ঠ্র বা সৌদীরা কিছুটা ওয়াহাবী শরীয়তপন্থী সে অর্থে পাকিস্তান ধর্মরাষ্ঠ্র ছিলনা। উল্লেখ্য ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় ধর্মভিত্তিক মুসলিম দল এবং শক্তিগুলো কেউই দেশবিভাগ চায়নি, জামাতি ইসলামি দেশবিভাগ চায়নি, কাওমী মাদ্রাসার দেওবন্দ-বেইজড আন্দোলনকারীরা দেশবিভাগ চায়নি, ওলামা-মাশায়েক, পীর-বুজুর্গ কেউই দেশবিভাগ চায়নি, সবাই ভারতীয় উপমহাদেশকে একটা দেশ হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল। তাহলে দেশ ভাগ হল কেন? দেশভাগ কি ভুল ছিল? দেশভাগ হয়েছিল মুসলমানদের নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠার জন্য, ধর্মরক্ষার নিমিত্তে না, ধর্মরক্ষার নিমিত্তে হলে সেসময়ে ইসলামী শক্তি সবাই দেশভাগের বিরোধিতা করতনা। দেশভাগ ভুল ছিল সেটাও বলা সম্ভব না, কারন ইতিহাসে কি হলে কি হত এসব হাইপথিটিকাল প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু সেসময়ের বাস্তবতায় দেশভাগ যৌক্তিক ছিল, অন্তত বাঙাল মুসলমানদের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে তো বটেই। উল্লেখ্য সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে কি থাকবে না সেটাও ভিন্ন একটা বিতর্ক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা, এজন্যেই আমাদেরকে এখন ধর্মনিরপেক্ষতাতে ফিরে যেতে হবে এই যুক্তি ধূপে টেকেনা, কেননা মুক্তিযুদ্ধের বা বিশ্বের কোন সশস্ত্র যুদ্ধেরই মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা না, শুধু পার্শ্বঅনুঘটক হতে পারে মাত্র, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পার্শ্বঅনুঘটক হিসেবেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পাওয়া যায়না। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সংবিধান রচনা করে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র দুটাই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, কয়েকজনে মিলে অন্যান্য কয়েকদেশের সংবিধান কপি-পেস্ট করে একটা জগাখিচুরী সিংহরিন বা বকচ্ছপ টাইপ সংবিধান রচনা করেছিল, যেখানে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র দুটাই ছিল! এরকম উদ্ভট সংবিধান বিশ্বে কোথাও কেউ দেখেনি। একটা সংবিধান রচনা করতে দেশের সকল মানুষের চিন্তাভাবনা, কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস এসবকে আমলে নিতে হয়, সেসময়কার সংবিধানে সেরকম কিছুই করা হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মুলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলনা, সেজন্য এখনও আনা যাবেনা, সেটাও কোন যুক্তি না। সময়ের প্রয়োজনে যদি দেশের মানুষ মনে করে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করা দরকার, তবে তাই হবে।
পাকিস্তান যদি ধর্মরাষ্ঠ্র না হয়ে থাকে তাহলে সেটা কি ছিল? পাকিস্তান ছিল ওপনিবেশিক শোষক, আমরা তাদের কলোনি ছিলাম। এমনকি পাকিস্তান যদি ধর্মরাষ্ঠ্রও হত আর বাংলাদেশীদেরকে সমানাধিকার দিত, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোন নিপীড়ন না করত তাহলে বাংলাদেশীরা কখনও যুদ্ধ করত না, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা থাকতনা। কারন মনে রাখতে হবে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল বাঙালিরাই এবং সেটাও মুসলিমদের জন্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যই করেছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সেখানে মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল সময়ের প্রয়োজন। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ ইসলামকে ডিথ্রন করা বা ইসলাম ভার্সাস বাঙালিত্বের ক্ল্যাশ ছিল না, আবারও সেটা ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সময়ের প্রয়োজন। জহির রায়হানের "সময়ের প্রয়োজনে" পড়া থাকলে আমার প্রসংগটা ধরা সহজ হবে।
বেশ কিছুদিন আগে আমার ভারতীয় আল্ট্রা-সেক্যুলার সংশয়বাদী বন্ধু ইমরান আর পাকিস্তানি কিছুটা ইসলাম-পন্থী এবং চরম ভারত- এবং ভারতীয়-বিদ্বেষী জাভেদ, এই দু'জনের মধ্যে আমার আল্লাম ইকবালের "রিকন্স্ট্রাকশান অফ রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম" বইয়ের রিপাবলিকান ফরম অফ গভর্নমেন্টের একটা উদ্ধৃতি নিয়ে বাতচিৎ হচ্ছিল। সেখানে একজাতি/দ্বিজাতি এসব তত্ত্ব নিয়ে কিছুটা কথা বলেছিলাম, যা এখানে প্রাসংগিক।
"Two-nation/One-nation/multiple-nation theories are all trash. Nation-states don't exist and thrive based on how many different and distinct cultural, religious, national groups inhabit the nation-states. Rather how the different interest-groups, however divergent/convergent they be in terms of religion, culture, ethnic origins etc., divide/share the political and economic power among themselves in a way that no particular group feels left-out and discriminated."
এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পরে এসেও আমরা আমাদের দেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের একাডেমিক ইতিহাস, যা প্রতি সরকারের আমলে পরিবর্তন হবে না, সেটা রচনা করতে সমর্থ হয়নি। আমরা আমাদের ইতিহাসকে দলীয় চশমা লাগিয়ে দেখি এবং আমাদের ইতিহাস-চর্চা শুধুই একাত্তর কেন্দ্রীক। আমাদের ইতিহাসচর্চাটা অনেকটা আমেরিকানদের মতই, এখানে যেমন কলম্বাসের আগমনের পর থেকেই ইতিহাস শুরু, আমাদেরও যেন ইতিহাস শুধু ৭১-কেন্দ্রীক। এর পূর্বে দীর্ঘ ব্রিটিশ আন্দোলনে সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের ইতিহাস বা তিতুমীরের ইতিহাস আমাদের চর্চায় খুবই প্রান্তিক জায়গা দখল করে আছে। একাত্তর বাংগালদের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এবং অর্জন তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু একাত্তর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বাংলাদেশের ইতিহাস ৪৭-এর পরে শুরু হয়নি, এর আগের দীর্ঘ সময় ধরে বাংগালদের ইতিহাস আছে এবং সেই আগের ইতিহাসকে যদি বিবেচনায় না নিই তাহলে একাত্তরের ইতিহাস পাঠও একপাক্ষিক হবে, কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চশমা দিয়ে সেই ইতিহাস দেখবে কেউ ইসলামের চশমা দিয়ে। বস্তুনিষ্ঠ একাডেমিক ইতিহাসচর্চার জন্য এই দুই চশমা বাদ দিয়ে শুধুই বস্তুনিষ্ঠতা এবং ইতিহাসের দায় থেকেই ইতিহাস চর্চা করতে হবে। এতে জনগনের কিছু অংশের ইসলাম নিয়ে চুলকানি আর কিছু অংশের বাঙালিত্ব নিয়ে চুলকানি কমবে, আমরা আগে বাঙালি পরে মুসলমান বা আগে মুসলমান পরে বাঙালি এসব ফালতু বিষয় নিয়ে বাকবিতন্ডা হবে না, একটা যুক্তিভিত্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসভিত্তিক আত্মপরিচয় খাড়া করতে পারব। তাছাড়া একাত্তরে আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এই বয়ান জামাতি এবং পাকিস্তানিদের বয়ানকেই প্রতিষ্ঠিত করে, ভারতের ষড়যন্ত্রে আমরা স্বাধীন হয়েছি এই ধারণার পক্ষে এভিডেন্স দেয় এবং সর্বোপরি আমাদের বিপক্ষে ২৪ বছরের চরম অন্যায়-অবিচারের ইস্যুটাকে অপ্রধান করে ফেলে যা কোনভাবেই কাম্য নয়।