ধর্মের প্রয়োজন কী? নৈতিকতার জন্য ধর্মের কোন দরকার নাই। এরকম প্রশ্ন সেক্যুলার শিক্ষিতরা প্রায়ই করেন, এবং এটা যুক্তিযংগত প্রশ্ন। মূলত এটা ধর্মের প্রয়োজনীয়তা/উপযোগিতা আছে কিনা তার গোড়ার প্রশ্ন। আমি আমার নিজস্ব ভাবনা শেয়ার করব, উল্লেখ্য এই ভাবনায় হাজার লোকের/স্কলারের বিভিন্ন সময়ের চিন্তার মিশ্রণ ঘটেছে।
০১.
পবিত্র কোরানের মানব সৃষ্টির কাহিনী এ বিষয়ে খুবই প্রাসংগিক। আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের গাছের নাম শিখিয়ে ছিলেন, পরে যখন আদম (আঃ)-কে গাছের নাম জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি খুব সহজেই তার উত্তর দেন, কোন ভুল করেননা সেখানে।
আদম (আঃ)-কে আল্লাহ একটা গাছের দিকে নির্দেশ করে বললেন সে গাছের ধারেও যাবেনা। কিন্তু আদম (আঃ) নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে শয়তানের কথাই শুনলেন, আর আল্লাহর আদেশ না শুনে গাছের ফল ভক্ষণ করলেন। ভুল করলেন।
এই কাহিনীর মধ্যে গভীর ফিলজফি লুকিয়ে আছে। গাছের নাম মূলত এখানে দুনিয়াবী/প্রাকৃতিক জ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে। আদম (আঃ) এই জ্ঞানে পারঙ্গমতা দেখিয়েছে, গাছের নাম বিনা ভুলে বলে দিতে পারছে। তার মানে মানুষকে প্রাকৃতিক জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হবার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছে। সে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে চাষাবাদ করবে, শিল্প করবে, বিজ্ঞানে উন্নতি করবে, টেকনলজি হাসিল করবে, চাঁদে যাবে, এইযে প্রকৃতিকে জেনে নিজের কাজে ব্যবহার করার সক্ষমতা, যেটাকে লোকে সেক্যুলার নলেজ বলে, সেটাতে মানুষ পারদর্শী হবে। আদম (আঃ) গাছের নাম বলতে পারাটা মানুষের চরিত্রের এই সক্ষমতাকে প্রতিনিধিত্ব করে।
আদম (আঃ) নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে আপেল গাছের ফল খেয়েছে, খেয়ে ভুল করেছে। আপেল গাছের ফল খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল নৈতিক সিদ্ধান্ত। আদম (আঃ) নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে যখন নৈতিক সিদ্ধান্ত নিছে তখন ভুল করেছে, গাছের নাম বলার মত সক্ষমতা এখানে আদম দেখায়নি। এর মানে মানুষের পক্ষে সৃষ্টিকর্তার গাইডেন্স/সহায়তা ছাড়া নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। এজন্য সৃষ্টিকর্তার আরো গাইডেন্স দরকার লাগবে। গাছের নাম বলার ক্ষেত্রের সক্ষমতা আদমের প্রাকৃতিক জ্ঞানচর্চার পারদর্শীতা যেমন প্রমাণ করে তেমনি আপেল খাওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত তার চরিত্রের নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা প্রমাণ করে। এজন্যই মানুষকে যুগে যুগে গাইড করার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে নবী পাঠাইতে হয় এবং ঐশীবাণী পাঠাইতে হয়, কেননা নৈতিক সমাজ গড়ে তোলা, নৈতিকতার প্রশ্নর মীমাংসা করা তার পক্ষে ধর্ম/গাইডেন্স ছাড়া সম্ভব না।
০২.
নৈতিকতার উৎসকে মূলত তিনটা ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম হচ্ছে সাধারণ মানবতা (কমন হিউমেনিটি)। কোরানের ভাষায় এটাকে বলে ফিৎরা, মানুষের নৈতিক যেটা সেটার দিকে ধাবিত হওয়ার গুণ। এটা নাস্তিক-আস্তিক, ধার্মিক-অধার্মিক, ধর্ম-কাল-স্থান-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকলের আছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিরপেক্ষ অবস্থায় ফেয়ারনেসের/সুবিচারের পক্ষে থাকে। তার এই গুনটা আল্লাহ দিয়ে দিয়েছে। এই স্বাভাবিক নৈতিকতার জন্য ধর্ম বা সংস্কৃতির দরকার পড়বেনা। যেসব নৈতিক ইস্যু সারাবিশ্বের সব মানুষেরা একমত, সেসব বিষয় এই নৈতিকতার ছায়ায় পড়ে। যেমন বিনাকারনে কাউকে হত্যা করা, এটা যে অনৈতিক সেটা বুঝার জন্য কোন বিশেষ ধর্ম লাগেনা, মানুষ নিজে থেকেই কোনভাবে অনুভব করে এটা খারাপ কাজ। তাই ধর্মযুক্ত বা ধর্মবিহীন সব সমাজেই নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করা অনৈতিক।
নৈতিকতার দ্বিতীয় সোর্স হচ্ছে সংস্কৃতি। কিছু কিছু বিষয় কোন সংস্কৃতিতে নৈতিক আবার একই বিষয় অন্য সংস্কৃতিতে অনৈতিক। তাই সংস্কৃতি নৈতিকতার একটা বড় অংশ। যেমন ইসলাম ধর্মের নৈতিকতা বুঝ বাংলাদেশে আর উত্তর আফ্রিকায় ভিন্ন, এমনকি একই মাজহাবের মধ্যেও সংস্কৃতিভেদে নৈতিকতার মানদন্ড কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। হাজার বছর ধরে চলে আসা জীবন-যাপানের রূপ, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক চালচলনের শক্তিসমূহ নৈতিকতা প্রভাবান্বিত করে।
নৈতিকতার তৃতীয় সোর্স, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোর্স, হচ্ছে ধর্ম। বিশেষ করে যেসব ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আছে, যা সে ধর্মের অনুসারীরা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বলে বিশ্বাস করে। যেমন ধরেন মহানবী (সাঃ)-এর সময়কার মক্কার কাফেররা নিজের সৎমাকে বাপ মারা যাওয়ার পর নিজের উত্তরাধিকার সম্পত্তি হিসেবে ভোগ করত। এটা তাদের কাছে নৈতিক ছিল। কিন্তু ইসলাম বলে নিজের সৎমার অধিকার মায়ের মত, তাই মক্কার শত বছর ধরে চলে আসা নৈতিক মানদন্ডকে নিমিষেই ইসলাম অস্বীকার করে বসল। তাতে একই সমাজের একই সংস্কৃতির মানুষের নৈতিকতার মানদন্ড ধর্মের বিভিন্নতার জন্য বিভিন্ন হয়ে গেল।
ধর্মের নৈতিকতার মানদন্ড অন্য দুইটা মানদন্ড থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেন তার কারন ব্যাখ্যা করছি। কমন হিউমেনিটির চর্চিত মানদন্ড সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। ১০০ বছর আগে মানুষ যা নৈতিক মনে করত তা এখন করেনা। তেমনি সংস্কৃতির নৈতিক মানদন্ডও পরিবর্তনশীল। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে এ দুটা মানদন্ড স্বার্থান্বেষী মহল তাদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পরিবর্তন করতে পারবে। যেমন হিটলার তার সময়ের বিশাল জনগোষ্টীকে মগজধোলাই করে তাদের নৈতিকতার মানদন্ড ১০ বছরেই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তেমনি ধরেন পশ্চিমে ২০ বছর আগে সমকামিতাকে বেশিরভাগ লোক অনৈতিক মনে করত। গত ২০ বছরে সমকামি মানুষরা সংগঠিত হয়ে ব্যাপক প্রচার চালায়, মিডীয়া, মুভি, সমাজিক এক্টিভিজমের মাধ্যমে তার সমকামিতাকে সমাজে শুধু প্রতিষ্ঠিতই করেনি, তারা সেটাকে উদযাপনের বিষয়ে নিয়ে গেছে। এখন সমকামি হলে তারা নানা সুবিধা পায় পশ্চিমে, তারা সমকামিতাকে উদযাপন করতে সবাইকে বাধ্য করে। এই যে খুব স্বল্প সময়ে সমকামিতা বিষয়ে নৈতিকতার মানদন্ড ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেছে, সেটা খুবই ভয়ংকর। এটার মানে হচ্ছে ধর্মের ডিসিপ্লিনিং ফোর্স না থাকলে স্বার্থান্বেষী মহল আপনার আমার নৈতিকতা মানদন্ড ঠিক করে দেবে। মিডিয়া যার কন্ট্রলে তার নৈতিকতাই হতে হবে আমার আপনার নৈতিকতা। ধর্ম যেহেতু নৈতিকতার একটা রূপরেখা (ফ্রেমওয়ার্ক) দেয়, তাই ধর্মীয় নৈতিকতা একটা সীমারেখার ভিতরে থাকতে হয়। এখানে আমি আদম (আঃ)-এর কাহিনীতে ফিরে যেতে চাই। মানুষ নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারছেনা, সে আজকে যা নৈতিক বলছে কালকে সেটাকে অনৈতিক বলছে, পরশু আবার সেটাকে নৈতিক বলছে। প্রতিদিন নৈতিকতা ভিন্নরূপ ধারণ করলে সেটা নৈতিকতা না, সেটা সুবিধাবাদিতা।
ধর্মের নৈতিক রূপরেখা ছাড়া আপনি কোনমতেই বলতে পারবেননা মায়ের সাথে সন্তানের যৌনসম্পর্ক অনৈতিক। তেমনি বিয়েপূর্ব যৌনসম্পর্ক নৈতিক নাকি অনৈতিক সেটাও ধর্মের সাহায্য ছাড়া বলা সম্ভব না। সমকামিতা নৈতিক না অনৈতিক সেটাও ধর্মের সাহায্য ছাড়া বলা সম্ভব না। মূলত কোন কিছু ভাল না খারাপ, নৈতিক না অনৈতিক সেটা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার অস্থিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে তার প্রদত্ত বিধানমালাকে মেনে নেওয়া ছাড়া বলা সম্ভব না। ধর্মীয় ফ্রেমওয়ার্রক ছাড়া সমাজের কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল যেটা বলবে সেটাই নৈতিক, তারা যেটা চাইবে সেটাই ভাল, তারা যখন যেটা বলবে সেটাই অনৈতিক হবে। কিছু এলিট ঠিক করে দেবে কোনটা সমাজ আজকে ভাল বলে গ্রহণ করবে, কোনটা কাল আবার ছুঁড়ে ফেলে দিবে।
এজন্যই ধর্ম অর্থসম্পর্ণ নৈতিকতার সবচেয়ে বড় উৎস। ধর্ম হল নৈতিকতার এংকরিং পয়েন্ট, এই এংকরিং পয়েন্ট ছাড়া নৈতিকতার মানে শুধুমাত্র উপযোগবাদিতা এবং সুবিধাবাদিতা, আর কিছুই নয়।
দ্রষ্টব্য: এই বিষয়টা অনেক বড় আলোচনার দাবি রাখে, আমি স্বল্প পোস্টে মূলভাবনা গুলো তাড়াতাড়ি প্রকাশ করাতে সবকিছু আলোচনায় রাখতে পারিনি, তবে মূলভাবনা এটাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ২:১৬