somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আব্দুল মুত্তালিব তার এক সন্তানকে বিসর্জন দিবে।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আব্দুল মুত্তালিব তার এক সন্তানকে বিসর্জন দিবে, ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য, ক্বাবার সামনে। কাকে দিবে বিসর্জন? সেটার ফায়সালা হওয়া দরকার। আব্দুল মুত্তালিব তার সন্তানদের সবাইকে ডাকল। আজ তার অনেক বছর আগের করা এক মান্নতের পরিণতি দিতে হবে। তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাকে তার এত মায়া লাগে কেন? ভয় হয় যদি আব্দুল্লাহকেই বিসর্জন দিতে হয়? তার প্রিয় যদি ঈশ্বরেরও প্রিয় হয়? তাহলে?

সে অনেকবছর আগের কথা। শুধুমাত্র এক সন্তানের জনক ছিল আব্দুল মুত্তালিব। মক্কার কঠিন সমাজে শুধু এক পুত্র সন্তান নিয়ে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। যত বেশি পুত্রসন্তান তত বেশি মর্যাদা, আধিপত্য, এবং সম্পদ। আরো সন্তানের আশায় আব্দুল মুত্তালিব অনেকগুলো বিয়ে করেছে, কিন্তু কোনমতেই তার একের বেশি সন্তান হয়নি। শেষে কিছুটা বুড়া বয়সে আব্দুল মুত্তালিব এক মান্নত করল, যদি তার দশ সন্তান হয় এবং দশ সন্তানই বেঁচেবর্তে বড় হয়, তবে আব্দুল মুত্তালিব ঈশ্বরের প্রতি শোকরিয়া স্বরূপ এক সন্তানকে বিসর্জন দিবে, ক্বাবার সামনে।

ঈশ্বর তার সে প্রার্থণা কবুল করেছে, একে একে তার আরো নয়টা সন্তান হল, সবাই এখন বালেগ, টগবগে তরুন। দশ সন্তান যখন হল, আব্দুল মুত্তালিব তার মান্নতের কথা মনে করছিল, যতই সন্তানরা বড় হচ্ছে ততই তার মান্নতের কথা বেশি মনে পড়ছিল, আব্দুল্লাহ তার দশম সন্তান (আব্দুল্লার পরেও তার সন্তান হয়েছিল)। যখন মান্নত করেছিল তখন মনেই হয়নি কোনদিন তার দশ সন্তান হবে, ভেবেছিল মান্নত করলে সমস্যা কি, ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাকে দশ দশটা সন্তান দিবেনা বুড়ো বয়সে। কিন্তু সেটাই সত্যি হল, এখন এক সন্তানকে বিসর্জন দিতেই হবে। তার মনের মধ্যে খুবই উতাল পাতাল করে উঠল, এই কষ্ট সে সহ্য করতে পারবে? কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব এক কথার মানুষ, ঈশ্বরের কাছে মান্নত সে কোনদিন ভাংতে পারবেনা।

আজ সেদিন এসে পড়ল, কুরবানির দিন। কিন্তু কোন সন্তানকে কুরবানি দিবে? আব্দুল মুত্তালিব খুবই সুবিচারক, তাই সে নিজে কাকে কুরবানি দিবে সেটার ভার নিজের উপর নিবে না, নিজে নিলে পক্ষপাতিত্ব করতে পারে, সেটা করা যাবে না। সব সন্তানকে ডাকল সে, সবাইকে নিজের মান্নতের কথা বলল। সন্তানরা জানে ক্বাবার ঈশ্বরের কাছে করা মান্নত অবশ্যই ভাঙা যাবেনা, তাছাড়া তাদের পিতার মান্নত তাদেরও মান্নত। তাই রাজি না হয়ে উপায় ছিল না তাদের।

সব ছেলে নিজেদের নামে একটা করে দাগ টানল একেকটা তীরে। এরকম বিসর্জন আরো অনেক হয় মক্কায়, তার জন্য একজন বিশেষ নিয়োজিত তীর বাছাইকারি আছেন, যিনি লটারির মাধ্যমে তীর বাছাই করে যার নামে আসবে তাকেই বিসর্জন দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই বিসর্জন দেখার জন্য অনেক লোক হাজির হয়েছে, সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। আব্দুল মুত্তালিব তার লম্বা এবং ধারালো ছোরা নিয়ে দাড়িয়ে আছে, ক্বাবার হুবালের পাশে, মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনারত অবস্থায়। তীর বাছাইকারি বাছাই করা শেষ, নাম আসল আব্দুল্লাহর! আব্দুল মুত্তালিব দেরি না করে আব্দুল্লাহকে হাতে ধরে ক্বাবার দরজার দিকে নিয়ে গেল, দেরি করলে আবার মন পরিবর্তন হয়ে যাবে, মায়া লেগে যাবে, তাই তাড়াহুরা।

কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব তার স্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করতে ভুলে গেছিল। বিশেষ করে আব্দুল্লাহ্‌র মা ফাতিমার সাথে। ফাতিমা ক্বোরাইশের মেয়ে, তাই তার অনেক প্রভাব। তাকে না বলে তার সন্তানকে কুরবানি দিলে সেটা মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে। ততক্ষণে সবখানে খবর চলে গেছে। ফাতিমার মাখজুম গোত্রের লোকরা সবাই চলে এসেছে, তারা বুঝল তাদের বংশের নাতিকেই কুরবানি দেওয়া হবে। তারা সমস্বরে জিজ্ঞেস করল, ছোরাটা কিসের জন্য? আব্দুল মুত্তালিব তাদেরকে নিজের মান্নতের কথা বলল। মাখজুমের প্রধান নেতা মুঘিরাহ চেঁচিয়ে বলল, "না আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেওয়া যাবেনা। বরং তার বদৌলতে অন্য কোন কুরবানি দাও, যদি সেটার দাম মাখজুম গোত্রের সবার সম্মিলিত সম্পত্তির পরিমাণও হয়, আমরা সেটা দিতে রাজি আছি, কিন্তু কোনমতেই আব্দুল্লাহকে কুরবানি দেওয়া যাবেনা।"

আব্দুল মুত্তালিবের অন্যান্য সন্তানরাও আব্দুল্লাহকে অসম্ভব ভালবাসে, তারাও পিতাকে অনুরোধ করলে যেন আব্দুল্লাহর বদৌলতে অন্য কিছু কুরবানি দিতে কাফফারা হিসেবে। আদতে ভীরের মধ্যে একজন লোকও ছিলনা যে আব্দুল মু্ত্তালিবকে কুরবানি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলনা। আব্দুল মুত্তালিব নিজেও মনে মনে কুরবানি দিতে চাচ্ছিলনা তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে, কিন্তু ওয়াদা ভাঙতে খুবই আপত্তি তার। অনেক অনুরোধের পর আব্দুল মুত্তালিব রাজি হল ইয়াথরিব শহরের এক বিজ্ঞ মহিলা পীরের সাথে পরামর্শ করতে। ইয়াথরিবের দিকে রওনা হল, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল সে বিজ্ঞ মহিলা অনেক দূরের খায়বারে চলে গেছে। তার সেদিকেই রওনা হল। মহিলা পীর সব শুনল, বলল সে পরের দিন সাধনা করে জানাবে। পরের দিন যখন ফিরে গেল, মহিলা বলল, "তোমাদের ওখানে মানব বিসর্জনের বিপরীতে কাফফারা কি?" আব্দুল মুত্তালিব বলল, "দশটা উট"। বলল, "তোমরা মক্কায় ফিরে যাও, গিয়ে এক পাল্লায় তোমার ছেলেকে দাড় করাও, অন্য পাল্লায় দশ উট। তারপর লটারি কর, যদি উটের দিকে যায়, তাহলে দশ উট বিসর্জন দাও। যদি তোমার ছেলের দিকে লটারি যায়, তাহলে আরো দশ উট যোগ কর, এভাবে যতক্ষন লটারি উটের দিকে না যাচ্ছে ততক্ষণ দশটা করে উট যোগ করে পূনরায় লটারি কর। যেবার উটের দিকে পড়বে, বুঝবে ঈশ্বর তোমার কাফফারা গ্রহণ করেছে।"

আব্দুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহকে নিয়ে ফেরৎ আসল মক্কায়, লটারি চালু হল। কিন্তু লটারি পড়ল আব্দুল্লাহর দিকে। দশটা উট যোগ করল, এখন হল বিশ উটের বিপরীতে আব্দুল্লাহ। আবার লটারি হল। আবারও আব্দুল্লাহর দিকেই পড়ল। এভাবে প্রতিবারই আব্দুল্লাহর দিকে পড়তে থাকল লটারি, প্রতিবারই দশটা করে উট যোগ হল। এরকম করতে করতে একশটা উট একপাাশে হল, অন্যদিকে আব্দুল্লাহ। এবার উটের দিকে লটারি গেল। তার মানে একশটা উট বিসর্জন দিলে আব্দুল্লাহকে কুরবানি দিতে হবে না। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিবের মনে খটকা রয়ে গেল, বলল আবার লটরাি কর। একশটা উটের বিপরীতে আব্দুল্লাহ, আবার লটারি হল, এবার আবার উটের দিকেই লটারী পড়ল। আব্দুল মুত্তালিব বলল, "না, আবার কর।" আবার লটারিতে উটের দিকেই পড়ল। তিনবার পরপর উটের দিকে লটারি পড়ার পর আব্দুল মুত্তালিবের মনে হল এবার ঈশ্বর তার কুরবানি গ্রহণ করেছে। একশটা উট কুরবানি দেওয়া হল।

***** সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচল! কি কঠিন পরীক্ষার উপর দিয়ে যে গেল আব্দুল্লাহ্‌র জীবন। শেষে আব্দুল্লাহ বেঁচে ফিরল। আব্দুল্লাহর বেঁচে থাকা দরকার ছিল। কেননা, আব্দুল্লাহর মাধ্যমেই মুহাম্মদ (সাঃ) পৃথিবীতে আসবেন সামনের বছরেই, আব্দুল্লাহর সাথে আমিনাার বিয়ের পর।*******

(মার্টিন লিংসের মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনি Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources বইয়ের ভাবগত অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। এস্টেরিস্কের মধ্যে শেষ কয়েকটা লাইন আমার নিজের।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:১৩
৩৭টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×