ঘুরাঘুরির অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল ক্লাস টেনে যখন থেকে ক্লাস পালানো শুরু করেছিলাম তখন থেকে । তখন আমাদের মনে হত ,"মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়"-এর একটা বড় মাপের ঐতিহ্য ক্লাস পালানো । আর স্কুলের সিনিয়র ছাত্র হিসেবে এই ঐতিহ্য ধরে রাখাটাকে আমরা আমাদের দায়িত্ব বলেই মনে করেছিলাম । মনে পড়ে , একদিন যথারীতি দায়িত্বের ভার মাথায় তুলে নিয়ে ক্লাস পালিয়ে কমলাপুর চলে গেলাম আমি আর আমার দুইটা ফ্রেন্ড । গিয়ে ঢুকলাম শহরতলী প্লাটফর্মে । তারপর ত্রিশ টাকায় তিনটা টিকিট কিনে চলে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ । এটা ছিল আমাদের তিনজনেরই আম্মু আব্বু ছাড়া ট্রেনে প্রথম জার্নি । ঐদিনের পরে আরও অনেকবার ঐ একই জায়গায় গিয়েছি আমরা । ট্রেনে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া , স্টেশন থেকে বের হয়ে নৌকায় করে শীতলক্ষ্যার ওপারে যাওয়া , আবার ষ্টেশনে ফিরে ট্রেন ধরে কমলাপুর আসা এভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন । যদিও খারাপ ছিলনা , তবুও এক জায়গাতে আর কত ! এই ভেবে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া বন্ধ করেছিলাম , কিন্তু ঘুরাঘুরি বন্ধ থাকেনি । স্কুল পালিয়ে এই জার্নিগুলো থেকেই "জার্নি" শব্দটা মনের অগোচরেই এঁটে গেছে আমার সাথে দৃঢ়ভাবে । জার্নি এখন আমার নেশা হয়ে গেছে ।
আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার একটা জার্নির কথা শেয়ার করছি । এই জার্নিটা করা হয়েছিল শব-ই বরাতের রাতে । যে রাতে সবাই নামাজ পড়ে সেই রাতে । আগেরই প্লান ছিল আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে শব-ই বরাতের রাতটা কাজে লাগাবো । রাতের বেলায় জার্নির এরকম সুযোগ একদমই আসেনা । তাই এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে । আমরা ছিলাম মোট ৫ জন । আমি , ফাহিম , প্রিন্স , সাইমুম আর রুশাদ । রাত এগারটায় আমরা একত্রিত হলাম টি এন্ড টি কলোনিতে । তখনও আমরা জানিনা আমরা কোথায় যাব বা দূরে কোথাও যাব কিনা । আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিলো অন্য একটা টপিক নিয়ে , তাই "কোথায় যাব?" এই বিষয় তোলাটাও সম্ভব হচ্ছিলো না । আমরা কথা বলতে বলতেই হাঁটা শুরু করলাম । হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর রেইলওয়ে ষ্টেশনে ঢুকলাম । তখনও আমাদের মধ্যে ঐ টপিক নিয়েই কথাবার্তা চলছিল । হঠাত ট্রেনের "পঅঅঅঅঅঅঅ" ডাক সামনে থেকে ভেসে আসলো । সামনে চোখ পড়তেই দেখলাম কিছু লোক ঐ ট্রেনটার দিকে দৌড়াচ্ছে । বোঝা যাচ্ছে ট্রেনটা এখনি ছাড়বে । আমি তখন বললাম - " দোস্ত দৌড়া , ঐ ট্রেনটা এখনি ছাড়বে ।"
কথাটা বলতে বলতেই আমি দৌড় দিলাম । আমরা ট্রেনের অনেক পেছনে ছিলাম । আমি দৌড়ে ট্রেনের কাছাকাছি যেতেই ট্রেন ধীরগতিতে চলতে শুরু করলো । পেছনে তাকালাম , দেখলাম ওরা ট্রেনের দিকে দৌড়িয়ে আসছে । আমি ট্রেনে উঠে পরলাম । প্রায় সাথে সাথে একে একে প্রিন্স , ফাহিম , সাইমুম আর রুশাদও ট্রেনে উঠল । আমরা সবাই ট্রেনের একদম শেষ বগীতে । বগীর পেছন দিকটায় তাকাতেই খুশি হয়ে গেলাম । কারণ পেছন দিকে এই ট্রেনটার কোন দেয়াল নেই । মানে এই বগীর পেছন দিকের দরজার জায়গাটাতে কোন দরজা নেই । আর যেহেতু এটা ট্রেনের একদম পেছনের বগী , তাই পেছন দিকে যা যা ফেলে আসছি সবই দেখা যাচ্ছে । ফাহিম গিয়ে ট্রেনের পেছন দিকের বাড়তি অংশটায় দাঁড়ালো । দেখাদেখি আমিও ওখানে দাঁড়ালাম । সাইমুম আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল , প্রিন্স আর রুশাদ ট্রেনের দরজাতে বসে ছিল । ট্রেনের পেছন থেকে রেললাইনের দিকে তাকালে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় । রেললাইনের সমান্তরালভাবে পেছন দিকে যাওয়ার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় আমি এখন টাইমমেশিনে আছি । আর প্রচন্ড গতিতে সবকিছুকে পেছনে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ।
আমাদের পেছনেই দুইজন অল্প বয়স্ক টিটি দাঁড়িয়ে ছিল । এই ট্রেন কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা ময়মনসিংহ যাবে । আর একটা কথা বলা হয়নি । আমাদের কাছে কখনোই ট্রেনের টিকিট কাটবার মত টাকা থাকেনা । আর স্টুডেন্ট পরিচয়ে আমরা অনেক জায়গাতেই বিনা ভাঁড়ায় ভ্রমণ করি । মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু টাকা টিটি আঙ্কেলদের দিতে হয় । বরাবরের মত সেদিনও আমরা টাকা এবং টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠেছিলাম । আমি ভাবলাম , বিমানবন্দর পর্যন্ত বিনা ভাঁড়ায় সহজেই যেতে পারব । কারণ বিমানবন্দর যাবার আগে টিকিট চেক হবেনা । তাছাড়া টিকিট চেক হলেও বিমানবন্দরে স্টুডেন্টরা বিনা ভাঁড়াতেই যেতে পারে । কিন্তু বিমানবন্দরের পর টিকিট চেক হবে । ফাহিমকে ডেকে বললাম , বিমানবন্দর গিয়ে আমরা এখান থেকে নেমে যাব । নেমে গিয়ে ইঞ্জিনে উঠবো । ইঞ্জিনে যাবার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক । আমাদের বেশিরভাগ জার্নিই হয় ইঞ্জিনে করে , ভাঁড়া থেকে সহজে বাঁচা যায় বলে । সাইমুম , প্রিন্স আর রুশাদকেও জানিয়ে দিলাম এই কথা ।
ট্রেন বিমানবন্দর থামল । আমি আর ফাহিম ট্রেনের পেছন দিক দিয়েই লাফ দিয়ে নেমে দরজার কাছে গেলাম । বাকিরা দরজা দিয়ে নামলো । তারপর ট্রেনের ইঞ্জিনের উদ্দেশ্যে পাশের রেললাইন ধরে দৌড় শুরু করলাম আমরা । আগেই বলেছি , আমরা ছিলাম একদম শেষ বগীতে । আর ট্রেনটা যে এতো বড় ছিল তা আমরা আগে জানলে হয়তো ইঞ্জিনে উঠবার জন্য ওখান থেকে নামতাম না । মধ্যপথে ভয় হল যদি ইঞ্জিনে উঠবার আগেই ট্রেন ছেড়ে দেয় ? এই চিন্তা মাথায় আসতেই দৌড়ের গতি বেড়ে গেল । ট্রেন ছাড়ার কিছুটা আগেই আমরা ঠিকমত ইঞ্জিনে উঠে বসলাম । ফাহিম বসলো ইঞ্জিনের একপাশের একটা সিড়িতে , আমি আমার পা ইঞ্জিনের ঠিক পেছনের বগীটার একটা লোহার অংশে রেখে বসলাম ইঞ্জিনের পেছন দিকে , আর সাইমুম , রুশাদ আর প্রিন্স বসলো ইঞ্জিনের আরেক পাশে । ট্রেন চলতে শুরু করলো । আমি আর ফাহিম যেই পাশটায় বসেছি সেখান থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছিলো । ইঞ্জিনের উত্তাপে গরম বাতাস লাগছিল আমাদের গায়ে । তুরাগ নদী , টঙ্গি পার হয়ে ট্রেন চলছে । উত্তরবঙ্গের লাইনে ঢুকেছে আমাদের ট্রেন । আমরা প্রথমে ঠিক করলাম জয়দেবপুর নেমে যাব । ট্রেন জয়দেবপুরের আগের কোন ষ্টেশনে আর থামবে না । কিন্তু হঠাত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার ইচ্ছা চেপে বসলো । ফাহিম বলল , নাহ , জয়দেবপুর নামবো না । আজকে ময়মনসিংহ যাব । প্রিন্সও রাজি হল । কিন্তু বাকি দুইজন রাজি হলনা । ওদের সকালের মধ্যেই নাকি ঢাকা ফিরতে হবে । ফাহিম বলল , তাহলে ওরা চলে যাক । আমরা থাকব । ময়মনসিংহ যেতেই হবে আজকে । আমিও বললাম , হুম । এমন সুযোগ আর পাবনা । আজ যাবই । ওরা গেলে চলে যাক । ট্রেন জয়দেবপুর থামল । সাইমুম , প্রিন্স , রুশাদ তিনজনই নেমে গেল । ওদের অনেক বললাম , আয় তোরা , এসে পড় । এমন সুযোগ আর পাবনা । কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে পারব , আয় । কে শোনে কার কথা । উল্টো রুশাদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল , দেখ বিজন , নেমে যা বলতেসি । আমি কিন্তু তোর আম্মুকে ফোন করে বাসায় জানিয়ে দেব । আমি বুঝলাম , রুশাদ ছেলেটা কলেজে পড়লেও এখনও অনেক ছোট । যে ছেলেটা রাত ১ টায় ট্রেনের ইঞ্জিনে বসে ময়মনসিংহ যাবার প্লান করে তাকে ও ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে বাসায় জানিয়ে দিবে একথা বলে ! আমার তখন অনেক হাসি পাচ্ছিলো । আমি হেসেও দিয়েছিলাম আসলে ।
ট্রেন ছেড়ে দিল । আমি আর ফাহিম ট্রেনের ইঞ্জিনে আগের জায়গাতেই বসে আছি । রুশাদ , প্রিন্স আর সাইমুম আমাদের কথা শুনেনি । ওরা জয়দেবপুরেই বসে থাকবে চারটা পর্যন্ত । তারপর চারটার ট্রেন ধরে আবার ঢাকা চলে যাবে ।
আমি আর ফাহিম এই জার্নিটা খুব উপভোগ করছিলাম । ইঞ্জিনে আরও তিনজন ছিল । একজন বুড়ো ,আর দুইজনই ছোট ছেলে । দেখে বোঝা যাচ্ছে বাড়ি ফিরছে ওরা । ছেড়া পোশাক । ঐ দুইটা ছেলের একজনের সাথে কথা হয়েছিল । ঢাকায় কাজ করে ছেলেটা , ওর বাড়ি গফরগাঁও । ওর কাছ থেকেই জানলাম ট্রেন ময়মনসিংহ যাবার আগে আর একটা জায়গায় থামবে । সেই জায়গার নাম গফরগাঁও । আমি আমার জায়গাতেই দাঁড়ালাম । অনেক বাতাস ছিল । মনে হয় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে । দাড়িয়ে হাতের বামে তাকাতেই সবকিছু অদ্ভুত সুন্দর মনে হল । রাতের ধানক্ষেত , রাতের বাগান , রাতের বড় বড় গাছপালা , রাতের ঘরবাড়ি সবকিছুই চাঁদের আলোতে অদ্ভুত সুন্দর । এর আগে কখনও এতো সৌন্দর্য আমি দেখিনি । চারপাশের সৌন্দর্যের সাথে বাতাস যুক্ত হয়ে দিচ্ছে এক স্বর্গীয় অনুভূতি । ফাহিমও নিজের মত করে সবকিছু উপভোগ করছিল । আমরা দুইজন স্থান বদল করলাম । তারপর চিৎকার করে গান গাইলাম আমরা । অনেক গান গাইলাম । মনে হচ্ছিলো , প্রকৃতি আমাদের নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কনসার্টের আয়োজন করেছে । সেই কনসার্টে গান গাচ্ছি আমরা । আর সাড়া দিচ্ছে বাতাস , গাছপালা , দূরের ঘরবাড়ি , এমন কি দূর আকাশের ঐ চাঁদটাও । গফরগাঁওয়ে যখন ট্রেন থামল তখন ইঞ্জিনের ভেতর থেকে নেভি ব্লু শার্ট পড়া একজন বেড়িয়ে আসলেন । উনি ট্রেনের ড্রাইভার । এসে ফাহিমকে বললেন , কোথায় যাবা ? ফাহিম ময়মনসিংহ বলতেই উনি বললেন টিকিট কই ? ফাহিম বলল , টিকিট তো নাই আঙ্কেল । উনি বললেন , তাহলে ভাঁড়া দাও । ফাহিম তখন আমার দিকে তাকাল । সেই সাথে ড্রাইভার আঙ্কেলও আমার দিকে তাকালেন । আমি হেসে বললাম , আঙ্কেল , টাকা তো নেই । দেখি আঙ্কেলও আমার দেখাদেখি হাসলেন । বললেন , কোথা থেকে এসেছ ? বললাম , ঢাকা থেকে । তারপর আঙ্কেল আর কিছু না বলে হেসে চলে গেলেন । আমি আর ফাহিম পরে ভাবলাম , সম্ভবত শব-ই বরাতের রাত হওয়ায় উনি এতো সহজে আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন । ট্রেন আবার চলতে লাগলো , সাথে আমরাও । এতো ভালো লাগা ছিল আমাদের ঐ জার্নিটায় তা বলে প্রকাশ করার মত না । যখন ঐ জার্নিটার কথা আমি ভাবি , আমার সন্দেহ হয় , আসলেই কি ঐ রাতটা বাস্তব , নাকি শুধুই কল্পনা ? আমি জানি , সেটা বাস্তব । তবু কল্পনা ভাবতেই যেন ভালো লাগে । শান্তি পাই , অনেক সুখও পাই । এতো সুখ বাস্তব সাধারণত আমাদেরকে দিতে পারেনা বলেই হয়তো আমার মনে হয় এটা কল্পনা ছিল ।
আমরা ভোর চারটায় ময়মনসিংহ ষ্টেশনে নামলাম । তারপর ফ্রেশ হয়ে খাবার হোটেলে ঢুকলাম আমরা । হালকা নাস্তা করে ভোর বেলায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যাবার জন্য অটোতে উঠলাম । অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে । ক্যাম্পাসটা যে এতো বড় তা আমার আগে জানা ছিলনা । অনেক মনোরম পরিবেশ , অনেক গাছপালা চারপাশে । আর যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদ । কিছুক্ষণ ব্রম্মপুত্রের পাড়ে বসলাম । এটা আমার কোন নদীর পাড়ে দ্বিতীয় সকাল । প্রথম নদী পাড়ের সকালটা ছিল শীতলক্ষ্যায় । তারপর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আবার ষ্টেশনে ফিরে আসলাম । অনেকক্ষণ ষ্টেশনে ঘুরাঘুরির পর ঢাকা যাবার ট্রেন আসলো । উঠে পড়লাম আমরা । কিন্তু এই ট্রেনে গফরগাঁও পর্যন্ত এসে আমাদের নামতে হল ।কারণ টিটি আঙ্কেল বিনা ভাঁড়ায় গফরগাঁও এর বেশি আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারবেন না । আমরা গফরগাঁও নেমে হাত মুখ ধুতে পুকুরে নামলাম । কিছুক্ষণ পরই ঢাকাগামী আরেকটা ট্রেন এল । ঐটাতে করেই আমরা ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলাম । তবে এবার আর বিনা ভাঁড়ায় আসতে পারিনি । টিটি আঙ্কেল চল্লিশ টাকা খেয়েছেন আমাদের কাছ থেকে । তবুও পুরো জার্নিটা ছিল অনেক বেশি উপভোগ্য । বিশেষ করে রাতটা ছিল অসাধারণ , অতুলনীয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩০