somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুমসন্দর্ভ

২৪ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৬:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মহাভারতে আছে,অর্জুন জিতনিদ্র ছিলেন। শ্রীকৃঞ্চ তাকে বেশ কয়েকবারই গুঁড়াকেশ (জিতনিদ্র) বলে সম্বোধন করেছেন। আবার রামায়নে লক্ষণ নাকি চৌদ্দ বছর একবারও দুচোখের পাতা এক করেননি !
ব্রক্ষবৈবর্ত পুরানের ঘটনা তো আরও ভয়াবহ। ওখানে শুধু ঘুম ভাঙ্গানোর অপরাধে জরুৎকারু মুনি তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মনসাকে তালাক দিয়ে হিমালয়ে চলে যান। মনসার অপরাধ, জপের সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে কাঁচা সন্ধ্যেবেলা তিনি স্বামীর ঘুম ভাঙ্গান্।
দেবতালোক ছেড়ে এবার মানবলোকে নেমে আসি। একি ! ঘুমের ভাঁজে স্বয়ং 'ভানুসিংহ'ও যে ডুবে ! তিনি বুঝলেন-
'পরশ করিলে জাগে না সে আর
কুসুমের হার লাগে গুরুভার
ঘুম জাগরনে মিশি,একাকার নিশিদিবসে'
আধো-ঘুম,আধো-জাগার শব্দজটে কবি কি 'ভাতঘুমে'র ইঙ্গিত করেছিলেন ? বাঙালির সেই পরম পুলকিত ঘুম.যার বিহ্বলতার কোন তুলনাই নেই এই ধরাধমে। দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় শরীরের ভার ছেড়ে,খুব আবেশে চোখের জানালা বন্ধ করে.......ইচ্ছেখুশির বন্দরে।
গর্বে বুকের ছাতিটা কেমন ফুলে উঠছে তাই না ? নিশ্চয়ই এই ভেবে,ভাতঘুমের 'সংস্কৃতি'টা বাঙালীর একান্তই নিজস্ব 'সম্পদ'। দোষ দেইনা। 'আমার' শব্দটির ওপর দখল তো গোটা গ্রহে শুধু আমাদেরই আছে। তা,খালি শব্দ দখলেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুন,কিন্তু ওদিকে আমাদের 'ভাতঘুম'কে,ইংরেজরা বলছে 'ন্যাপ',চীনারা 'উজিয়াও' আর স্প্যানিশরা 'সিয়েস্তা।' এই সিয়েস্তা শব্দটি সম্ভবত লাতিন শব্দ 'হোরা সিক্সটা' থেকে এসেছে,যার অর্থ ষষ্ঠ ঘন্টা। অর্থাৎ, সকালে ঘুম থেকে উঠিবার ছয় ঘন্টা পর কিঞ্চিৎ সময় চক্ষু মুদিবার যে ব্যবস্থা.তাহাই 'সিয়েস্তা।'
এখানেই শেষ নয়। কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রতি জাপানিদের একটা বিশেষ 'ইয়ে' আছে। তাই আমাদের ভাতঘুমকে ওরা সরকারী স্বীকৃতি দিয়েছে। ওদের বিশ্বাস,দিবানিদ্রা মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ায়। তাই ওদের দেশের অনেক কারখানাতেই শ্রমিকদের জন্য ঘুমোনোর ব্যবস্থা আছে,যেন একটুখানি ভাতঘুমের পর চাঙ্গা মনে শ্রমিকের ঘাম ঝড়ে উৎপাদনের সন্ধানে।
তাই, বুকের ফুঁলে-ফেঁপে ওঠা ছাতিটা ফুট্টুস করে বন্ধ করে ফেলুন,আর মনকে বোঝান,ঘুমের ভুলটা শুধু আপনিই করেননি। আপনার প্রতিবেশি দেশের প্রয়াত 'পন্ডিত'ও হিসেবে ভুল করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা লগ্নে তার দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষনটি সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন। অনেক ভারতীয়রই এই লাইনটা মুখস্ত-At the stroke of the midnight,when the world sleeps,india will awake to life and freedom.
লাইনগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান পেশ করেই বলছি,আধুনিক ভারতীয় জাতির আকর মানবটির উচ্চারিত বাক্যে সময়ের সামান্য হের-ফের আছে। আচ্ছা, ভারতে যখন মধ্যরাত,তখন গোটা বিশ্বও কি ঘুমে কাত ? তখন তো ব্রিসবেন উষার সোনালু হাসিতে মাত,সানফ্রান্সিসকোর অফিসগুলোয় শতশত কর্মব্যস্ত হাত,নিউইয়র্কে মধ্যাহেৃর আহার.আর প্যারিসের সন্ধ্যার সাঁজে সাকির হাতে সুরার বাহার।
তবে এটাও ঠিক,তখন অর্ধেক পৃথীবি ঘুমাচ্ছিল। তাদের অনেকের নাসারন্ধ্রই হয়তো চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের করার মতো 'খরখর' আওয়াজ ছাড়ছিল । ভাল কথা,ট্রেনে জেগে রাত পাড়ি দিয়েছেন কখনো ? দিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই জানেন,রাতের ট্রেনের বগি নাসিকা গর্জনের খনি ! কুউউ-ঝিকঝিক শব্দের খিঁচুনি আর ঝাঁকুনির পাকচক্রে হয়তো ঘুমের অভ্যাস নেই,আশে পাশে কান পাততে হবে না,একের পর এক 'খররররর,খরখরখর',পংক্তিমালা শুনতে পাবেন। অনেকটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগের অবরোহন-আরোহনের মতো। তারপরও যদি আপনার ঘুম এসে যায়,তাহলে সকালে উঠে আপনার আশেপাশে যে সবচেয়ে বেশি নাক ডাকছিল,সেই হয়তো অভিযোগ করে বসতে পারে-'ধুর মিয়া, ওই রকম ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ করে কেউ নাক ডাকে !'
লোকের মুখে গল্প শুনে থাকবেন,নেপোলিয়ন নাকি যুদ্ধের সময় ঘোড়ার ওপর একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতেন। আমাদের এলেমের কাছে কিন্তু নেপোলিয়নও নস্যি।হাত গলেনা এরকম ভিড়ে বাসের হাতল ধরে আমরা ঘুমিয়ে নিতে পারি। সিট পেলে তো রক্ষে নেই। সরকারি অফিসের টেবিলে অশ্রুমালায় গাঁথা পোড়া বয়সগুলোর ফাইলের স্তুপের মাঝে, মাথা গুঁজেও আমরা ঘুমোতে করতে পারি। আসলে হয়েছে কি,দেখায় শিক্ষা নাচায় বিদ্যা। ওই অফিসের চেয়ার থেকে উর্দ্ধক্রম অনুসারে সাজিয়ে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারটিতে গিয়ে বসুন,ঘুমটা ততোই গাঢ় হবে।আর যদি বসতে না পারেন,তাহলে করজোরে নিদ্রালু নয়নে বলুন-
'তুমি মা কল্পতরু'
আমরা তোমার পোষাগরু।'
শীতনিদ্রার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই ঘুম মৃত্যুপ্রতিম। প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি। একটুও না নড়ে দিনের পর দিন শুধু চামড়ার ফাঁক গলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ব্যাঙ-সাপ-কচ্ছপদের সে এক নিদাল মরশুম। ঈশ্বর সর্বজ্ঞেয়। তাই মানুষকে এই ক্ষমতা দেননি। তাহলে হয়তো, অর্থ-বিদ্যুৎ-জ্বালানি বাঁচিয়ে আরো বলশালি হয়ে, বন্য নেকড়ের মতো একে অপরের ওপর হামলে,দুনিয়াটাকে আমরা নরক গুলজার বানিয়ে ছাড়তাম !
সে তুলনায় প্রিয়ার বুকের খোন্দলই পুরুষের জন্য ঢের নিরাপদ।যেখানে দাঁড়িয়ে নজরুল চুপিচুপি বলেন-'মোর ঘুম ঘোরে এলে প্রিয়।' জেমস অভিমানি কন্ঠে উচ্চারন করে-তালপাখা হাতে নিয়ে বসে রইবো তোমার শিয়রে।ঘুমাও তুমি,ঘুমাও।'
এখনকার বাংলাগান প্রিয়ার ঘুম পাড়ানি গান কাটালেও অন্য এক ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই আজকাল নাসিকা গর্জনের নিনাদই বাজার কাটছে।
একটা কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা,জোসনা রাতে মায়ের কোলে মাথা পেতে সেই গানটা তো শুনেছেন-আয়,ঘুম আয়,আমার চাঁদের চোখে আয়।'এখন আর শোনার সুযোগ নেই। তাই জানিনা,সেই গানটার সুর একইরকম আছে কিনা ? মনে হয় কথা ঠিক থাকলেও এই থ্রিজি'র যুগে Rap-break-এর গুঁতোয় সেই গানটার তালান্তরই ঘটেছে।
জীবনের বেশিরভাগ সময় তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম। তবু কি জানি ঘুম ব্যাপারটা ঠিক কি ? আবার,নির্ঘুম রাত কাটিয়েও তা পরিষ্কার বোঝানো গেল না। শুধু মনের সিন্দুক থেকে উপচে পড়ছে কিছু কথা-এই যে মাটির কমলালেবুটা আমাদের ধরে রেখেছে সর্বক্ষন,চক্ষুর গোচরে-অগোচরে যা কিছু ঘটছে,যা কিছু অতীত যা বর্তমান,যা কিছু বাস্তব,তার কিছুটায় কল্পনার আবীর মিলে-মিশে আমাদের নিত্য বাঁচার খোরাক যোগায়।এসব থেকে ছুটি পাওয়ার নাম কি ঘুম ? আমি যেমন ছিলাম,তেমনই আছি,তবু আমি ভাবছিনা-শুনছিনা,লোভ-ঈর্ষা-বিদ্বেষ,কাম-ক্লেশ সব অনুভূতির ছুটি। অর্থাৎএই খাঁচা থেকে কিছুক্ষনের মুক্তি ! সেই প্রচেষ্টায় নিজেকে সমর্পন করতে যাওয়ার আগে কানে-মুখে দুটো কথা জিজ্ঞেস করি,বলুন তো সবচেয় বিপদজ্জনক ঘুম কি ? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন,জেগে ঘুমোনো। এবার বলুন তো.এই ঘুমে বেঘোর কে?
জবাবটা আয়নার বুকে !








সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×