আলু সিদ্ধ করার কাজটা তারা ঘরেই সেরে থাকে। এরপর নুন-মরিচ,জিরা-পেঁয়াজ আর খানিকটা লেবুর রস মাখিয়ে একটা শুকনো কাপড়ে মুড়ে আলুর মন্ডটা রেখে দেয়া হয় কয়েকঘন্টা। নুন-মরিচ আর আলুর ত্রিভুজ প্রেমের স্বাদটা ধরে রাখে লেবুর রস। আস্ত মন্ডটার সঙ্গে বেগুন,রেসন,ডাল আর কাটা পেঁয়াজের ঝুড়ি সহযোগে,রোজ বিকেল নামার আগে এতিমখানা বাজারে চলে আসে মা আর ছেলে।
বেগুনি,গন্ধভাদাইল বড়া,ডাল বড়া ভাজলেও আলুর চপেই বুধনীর যত কারিকুরি। ঝাল-ঝাল, তাল তাল আলুর দলা বেচেই 'টং' থেকে তারা উন্নীত হয়েছে 'দোকানে'। নিশি রাতে বাজারে মাতালদের আসরে এমন কথাও শোনা গেছে,সন্ধ্যা নামতেই বুধনীদের বেগুনি-চপের ডালিতে যে মাছিগুলো ভনভন করে ঘুরে বেড়ায়,সেগুলো আসলে মাছি নয়। বুধনীর ভাজাপুড়ির টানে স্বয়ং ঈশ্বর নাকি ধরাধমে নেমে আসেন,মাছি হয়ে !
ঢাকার অনেক জায়গার ভাজাপুড়িই পেটে পড়েছে। নীলক্ষেত,শুক্রবাদ হয়ে ফার্মগেট দিয়ে মহাখালি থেকে গুলশানের বেশকিছু ভাজাভুজির দোকানেই পা পড়েছে,সেসব জায়গায় শুধু চপ নয়,সমুচা থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অবধি বিকোয় দেদারসে। কিন্তু আমার জিভের নেশা জমে আলুর চপে। কেমন একটা রগরগে ঝাল। মুখে পুরলে বেসনের পর্দা ভেদ করে বিটনুন আর ঝালের মন্থনে আলুর বুকে খোন্দলের ব্যাপারটা যেন, মাধ্যমিক দেয়ার আগেই হাতে লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার চলে আসার মতো !কামনা ও রসনা, এই দুটি জগতে তো ঝালেরই রাজত্ব। বুধনীর দোকানটা তাই আমার খুব প্রিয়।
ফুটন্ত তেলে বেসন মাখা পুরগুলো ছেড়ে দেয়ার সময় বুধনীর চোখে আলো খেলা করতে দেখেছি। দেখার ভুলও হতে পারে। আবার এও হতে পারে,ওইসময় বাজারের সব আলো শুধু বুধনী চোখেই ঠাঁই খুঁজে পায়। পুরগুলো ভাজার কায়দা দেখার মতোন। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে নাড়া-চাড়া করে বুধনী পুরগুলো খেলায়,তারপর রং পাল্টিয়ে তা চপে পরিণত হওয়ার মাঝে পিঠগুলোও বারকয়েক উল্টে যায়। বুধনী ঠিক মোক্ষম সময়ে বাদামী চপগুলোকে চামচের পিঠে করে তুলে নিয়ে আসে। কখনো পোড়া গন্ধ পাইনি।
অফিস থেকে একটু আগে বের হতে পারলে,একেক দিন ঢুঁ মারি বুধনীর দোকানে। ও আমায় চিনে রেখেছে। তাই হয়তো চপের সঙ্গে সালাদ ও বিটনুনের পরিমানটা বেশি থাকে। আমার চাহিদা সম্পর্কে বুধনী জানে।সন্ধ্যেবেলা থেকেই ওকে ঘিরে ধরে রাখে বাজারের মানুষ। কেউ শুধু চপ খায়। কেউ আবার নুন-মরিচ সহযোগে মুড়ির সঙ্গে মেখে নেয়।একটু একটু করে খায়,যেন ফুরিয়ে না যায়। জিভ দিয়ে একটু টুকরো বের করে তা আবার মুখের ভেতর খেলায়। কোন অভাগা হয়তো পকেটে ঝাঁপ দিয়ে অনেক হাতড়ে একটা ময়লা দশ টাকার নোটের সব খেয়ে ফেলেছে,তারপর কেলো মুখে আবিষ্কার করেছে আর টাকা নেই। গভীর সংকোচে সে কিছু একটা বলে ওঠার আগেই বুধনী বুঝে ফেলে ! এমন অনেকবার দেখেছি। তখনও বুধনীর চোখে সেই আলোটা দেখেছি। হতে পারে,বাজারের শেষ আলো ? কে জানে,তবে বড় ক্লান্ত সে আলো।
এই যে দোকান, আগুনে পুড়তে থাকা কড়াই,তার আঁচেই চলছে মা-ছেলের বেঁচে থাকার লড়াই। মুড়ির সঙ্গে চপের ভাঙ্গা টুকরোর প্রেমে বুঁদ হয়ে তা এড়িয়েও যাচ্ছে সবাই। কিন্তু এরা না থাকলে,পিজা হার্টজৎ-হেলভেশিয়া-কেএফসিদের নিয়েই কি শুধু বেঁচে থাকবে ঢাকা ? সে কেমন ঢাকা ?
চারশো বছরের কোকিল বসন্তে কাশবে,কেশে কেশে মুখে রক্ত তুলবে,সে কেমন বসন্ত ?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




