একজন বাদ্য যন্ত্রসহ গান গাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। তাকে সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। আসলে প্রসঙ্গটি অনেক গুরুত্বপূর্ন। কেন এটি অনেক গুরুত্বপূর্ন তার কারনটা বোঝার জন্য বর্তমান প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাল্টে যাওয়া আধুনিক সমাজ জীবনের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া প্রয়োজন। এখন পাপ করা কত সহজ! অন্যায়ে যুক্ত হওয়া কত ইজি! একটা সময় ছিল, তখন ক্যামেরা ছিল না। ভিডিও হত না। স্টিল ছবিও হত না। কেউ অন্ধকার কুঠুরিতে কোন অন্যায়ে লিপ্ত হলে, সেই পাপ ঐ একবারই তিনি একাই করতে পারতেন। তার ঐ একবার মাত্র কৃত পাপের কারনে তাকে বারবার দহনে দগ্ধ হতে হত না। তার একবারের পাপ তার কর্মলিপিতে একবারই উঠে যেত। কিরামান কাতিবীনকে এর জন্য একবারই মাত্র লেখালেখি করতে হত। এর কারন হচ্ছে, ঐ পাপটি কথিত ব্যক্তি একবারই মাত্র করেছেন, এবং তার পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয়বার কখনও ঘটে নি। এমনকি এটি এমনভাবেই সংগোপনে সংঘটিত হয়েছে যে, অন্য কেউ এ পাপের কথা জ্ঞাতও হয় নি।
পক্ষান্তরে আধুনিক প্রযুক্তির নানাবিধ কল্যানে আজকের মানব সমাজে অন্যায় অপরাধ তেজষ্ক্রিয় লাভার মত রূপ ধারন করে একটি মাত্র অপরাধ গোটা সমাজকে কলুষিত করছে। একটি মাত্র অপরাধ হাজারও মানুষের পাপের পথ খুলতে সাহায্য করছে। অসংখ্য মানুষের আমলনামাকে অনাকাঙ্খিত পাপের বোঝা অযাচিতভাবে এসে ভারি করে তুলছে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, আমেরিকার নিউইয়র্কের কোন এক নির্জন প্রাসাদে যুবক যুবতিদের সমঅংশগ্রহনে একটি অশ্লীল কুরুচিপূর্ন নৃত্যানুষ্ঠান কিংবা এরকম জঘন্য কিছু অনুষ্ঠিত হল। লাইভ ক্যামেরার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হল ইন্টারনেট এবং লাইভ টিভিতে। এসবের কল্যানে তা উপভোগ করলেন বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। অশ্লীল নৃত্যানুষ্ঠান পরিচালনায় যুক্ত লোকদের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে যারা এটি দর্শন করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই সমান পাপের অংশিদার হলেন। নাউ'জুবিল্লাহ।
কথা এখানেই যদি থেমে থাকতো তাহলেও হত। কিন্তু, আরও গভীর চিন্তার বিষয় হচ্ছে, উক্ত অনুষ্ঠানটি ভিডিও করা হচ্ছে। এবং এটি হাজার হাজার বার কিংবা আরও বেশি সংখ্যকবার যারা পরবর্তিতে দেখবেন, এদের সকলের সম্মিলিত পাপের সমান পাপ প্রযোজক, আয়োজকগন প্রত্যেকে একাই লাভ করবেন। নাউ'জুবিল্লাহ।
এবার আসুন বাদ্য যন্ত্রসহকারে গানের প্রসঙ্গে। ইসলাম ধর্মে আমাদের জন্য আসলে প্রচলিত সিস্টেমে বাদ্য যন্ত্র সহকারে যে অবাধ গান বাজনার সর্বপ্লাবি ঢেউ টিভি রেডিও ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের সর্বক্ষেত্রে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিদৃশ্যমান, এগুলোর আদৌ অনুমোদন আছে কি না, কিংবা থেকে থাকলেও তা কতটুকু এবং কোন পর্যায় পর্যন্ত- অবশ্যই মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জানার দাবি রাখে।
একচুয়ালি, মুসলিম হিসেবে আমরা পরকালের অন্তহীন যে জীবনে বিশ্বাসী, সেখানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবেই আমাদের এই পৃথিবীর ক্ষনস্থায়ী জীবন। মহান আল্লাহ পাকের অমোঘ নির্দেশ আল কুরআনের বানীসমগ্র, তাঁর প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেখে যাওয়া সর্বোত্তম আদর্শ তথা সুন্নতকে আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সত্যিকারভাবে ধারন এবং বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই পরকালের জীবনের সঠিক সঞ্চয় অর্জন করা সম্ভব।
আজকের সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কি দেখি? আদর্শ বলতে আমরা এখানে কোন জিনিষগুলোকে ফলো করার চেষ্টা করছি? আমরা কি কাজে-কর্মে সত্যিকার আদর্শ মুসলিম হিসেবে নিজেদের দাবি করার সাহস রাখতে পারছি? আমরা আল্লাহ পাক প্রদত্ত মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে কি আমাদের জীবন পরিচালনার গাইডলাইন হিসেবে পরিপূর্নভাবে গ্রহন করছি? রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া অনুপম আদর্শকে একমাত্র এবং সর্বোত্তম আদর্শ মনে করে তা পুঙ্খানূপুঙ্খ বাস্তবে রুপায়িত করে আমাদের জীবনের পরতে পরতে তার প্রতিফলন ঘটাতে অাদৌ পেরেছি? সে চেষ্টাও কি আমাদের আদৌ রয়েছে? আমরা কেমন মুসলমান হলাম? কোথায় আমাদের সেই সোনালী আদর্শ? সাহাবায়ে কেরামের অনুপম জীবন জিন্দেগীর শিক্ষা বিমুখ এ কি জীবন আমাদের? হায় হায়!!
ভাই, সত্যি বলতে কি, এগুলোকে গ্রহন এবং ধারন না করা পর্যন্ত আমরা তো নিজেদের যতই দাবি করি না কেন, আমাদের ঈমানকে পরিপূর্ন করতে পারব না। রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ''লা- ইউ'মিনু আহাদুকুম হাত্তা আকূনা আহাব্বা ইলাইহি মিও ওয়ালিদিহী ওয়া ওয়ালাদিহী ওয়ান্নাছি আজমাঈন''- অর্থ: ''তোমাদের কেউ ততক্ষন পর্যন্ত পরিপূর্ন মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন সে তার পিতা থেকে, তার সন্তান-সন্তুতি থেকে, এমনকি সকল মানুষ থেকে আমাকে বেশি ভাল না বাসবে।''
এখন বলুন, আমরা কি সত্যিই প্রিয়তম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই পরিমান ভালবাসতে আসলেই পেরেছি? জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকেই কেবল আদর্শ হিসেবে গ্রহন করতে পেরেছি? তাঁর সুন্নতগুলোকে আঁকড়ে ধরে পথ চলতে পেরেছি? পারি নি। পারি নি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। তিনি যদি দয়া করে মাফ করেন!
অন্য এক হাদিসে এসেছে- ''মান আহাব্বা ছুন্নতি ফাক্কাদ আহাব্বানী, ওয়ামান আহাব্বানী কানা মায়ী' ফিল জান্নাহ'' অর্থ: ''যে আমার ছুন্নতকে ভালবাসবে অর্থাৎ, যে ছুন্নতকে ফলো করলো, সে যেন আমাকে ভালবাসলো, আর যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতী হবে''।
তো রাসূলের সাথে জান্নাতী কে হতে না চায়? অবশ্যই আমরা প্রত্যেকে তা একান্তভাবে চাই। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? সারা জীবন আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে যাব, পশ্চিমা তথাকথিত আধুনিকতার দাবিদারদের, চলনে-বলনে, আচার-আচরনে, পোষাকে-আষাকে, ওঠা-বসায় এক কথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরন-অনুকরন করব অন্য জাতির আর রাসূলের উম্মত দাবি করে তাঁর ভালবাসার মিথ্যে দাবি করব, এটাতো অনেক বড় দ্বি-চারিতা বৈ কিছুই নয়!
হাশর কায়েম হয়ে যাবে। আরশের নিচে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকবেন। উম্মতের দরদী সেখানেও উম্মতের মায়ায় হয়রান-পেরেশান থাকবেন। অত:পর আল্লাহ পাক তাঁকে শাফায়াতের ক্ষমতা প্রদান করবেন। আল্লাহ পাক বলবেন, প্রিয়তম, আপনি শাফায়াত করুন। আপনার শাফায়াত মঞ্জুর করা হবে। হাদিসের ভাষায়- ''ইশফা' তুশাফফা'''।
তো তাঁর শাফায়াত পেতে হলে তো তাঁর সাথে একটু সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাঁর নৈকট্য পেতে হলে তো তাঁর ভালবাসাকে সবার উপরে স্থান দিতেই হবে। সুর করে শিল্পীর মত করে গেয়ে উঠতে মনে চায়, শাফায়াতের অধিকার, হাতেতে আপনার, পিলায়ে কাউসার...। অাল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন।
হাদিসে এসেছে- ''মান তাশাব্বাহা বিক্কওমিন ফাহুয়া মিনহুম'' অর্থ: ''যে জাতির অনুসরন যিনি করবেন, তিনি সে জাতির মধ্যে গন্য হবেন।'' আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করুন।
আর মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এই নির্দেশই আমাদের প্রদান করেছেন-
''বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।'' (সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত ৩১।)
''বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না।'' (সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত ৩২।)
তাই পারলৌকিক অন্তহীন জীবনে মুক্তি পেতে আমাদের তো এই একটাই পথ। আল্লাহর নির্দেশ মেনে প্রিয়তম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বর্নোজ্জ্বল আদর্শকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি কাজে আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে যাওয়া।
অনেক কথা বলে ফেললাম। ক্ষমা করবেন। প্রিয় ব্লগারবৃন্দ, দয়া করে কথাগুলোকে অন্যভাবে নিবেন না। একথাগুলো হয়তো আপনার/ আপনাদের প্রয়োজনে নাও লাগতে পারে, মানে- আপনি/ আপনারা হয়তো পূর্ব থেকেই এগুলো যথাযথভাবে ফলো করে আসছেন। কিন্তু, আমার নিজের জন্য আমি এগুলোকে অনুক্ষন উপদেশ এবং নির্দেশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। সে জন্যই এই বলা।
আল্লাহ পাক আমাকে আপনাকেসহ আমাদের সকলকে তাঁর নির্দেশ অনুসরন করে প্রিয়তম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখানো পথে আমাদের চলা-বলা আর প্রতিটি নি:শ্বাস-প্রশ্বাস কবুল করুন। আমীন।
সকলের কল্যান কামনায়। ভাল থাকুন অহর্নিশ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:৩০