কৈশোরে গাওয়া সেই সব প্রিয় না'ত গজলগুলো বড় প্রিয় ছিল। বারে বারে মনে পড়ে। হৃদয়ের ভেতরে অদ্ভুত এক আলোড়ন তোলা কিছু ছিল বোধ হয় এগুলোর ভেতরে। অন্তরের গভীর অনুভূতি আর পূর্ন দরদ নিয়ে যখন ওইসব সঙ্গীত পরিবেশন করা হত, হৃদয়-মন তন্ময় হয়ে যেত। অজান্তেই চোখ অশ্রু ঝড়াতো। আহ! কি প্রশান্তি! কি মধুর অনুভূতি! কি অচেনা স্বাদ! যেমন-
'রাহে মেরা মাছকান হাওয়ালিয়ে কা'বা,
বানে মেরা মাদফান দিয়ারে মদিনা।'
অর্থ '(প্রভূ হে!)
আমার নিবাস যেন হয় গো তোমার কাবারই ছায়ায়,
আমার কবর তুমি কবুল কর সোনার মদিনায়।'
কখনও গেয়ে উঠতাম-
'ইন নিলতি ইয়া রিহাচ্ছবাহু,
ইয়াওমান ইলাল আরদিল হারাম,
বাল্লিগ ছালামি রওদাতান,
ফিহান্নাবিয়্যুল মুহতারামি।'
'অর্থ 'ওরে ভোরের বায়ুরে,
যাবি রে তুই সোনার মদিনায়।
আমার সালাম পৌছে দিস,
নবীজীর রওজায়।'
কিংবা-
'কে যাওরে মদিনার পথে ওহে মুসাফির
আমার সালাম কইও দরবারে নবীর।'
অথবা,
সালাত ও সালাম গো আমার,
দরুদ ও সালাম গো অামার,
কইও নবী মোস্তফায়,
তোমরা যদি যাওরে মদিনায়।।
হাজীদেরই যাত্রা পথে,
আমি বসে আছি সকাল হতে গো,
আমার সালামখানি পৌছে দিও,
মদিনাতে হায়রে হায়-ঐ
বা,
মন যে আমার টেকে না কো এ দেশেতে হায়রে,
প্রিয় নবী লওগো ডাকি সোনার মদিনায় রে, সোনার মদিনায়।
আল্লাহর ঘর পবিত্র বাইতুল্লাহকে কল্পনা করে তার অভিমুখী হয়ে সিজদায় মাথা অবনত করি। প্রতি দিন পাঁচ পাঁচ বার করে। বিশ্বময়। অগুনতি বনি আদম করে। শত হাজার মাইলের ব্যবধানে থেকে মনের আয়নায় প্রিয় প্রভূর প্রিয় ঘর দেখে হৃদয় জুড়াই আমরাও। কাবার প্রেমিক, কাবার মালিকের প্রেমিকরা তো বছর বছর ছুটে চলে যান মালিকের ডাকে তাঁর ঘরের পানে। লক্ষ লক্ষ প্রভূ প্রেমিক সারা বিশ্ব থেকে জড়ো হন কাবার প্রাঙ্গনে। প্রতি বছর। মনের টানে। হৃদয়ের আহবানে। পরম প্রভূর ডাকে। প্রেম ও মিলনের এই অপূর্ব অসামান্য মিলনমেলায় একত্রিত হওয়া মহাসৌভাগ্যবানদের খাতায় নাম লেখানোও যে আসমানের ফায়সালা ব্যতিরেকে হয় না! হায় হায়, কত কত বছর পার করে দিলাম, জীবন থেকে কত মূল্যবান সময় ঝড়ে ঝড়ে পড়ে গেল, একটিবারের জন্য সুযোগ হল না প্রিয়তমের প্রিয় প্রাঙ্গন কাবা প্রাঙ্গনে হাজির হওয়ার! লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে নিজেকে হারিয়ে আপন প্রভূর বিরহে ডুবে যাওয়ার!
প্রিয়তম নবীজীকে দেখি নি। এ চর্মচোখে তাঁর দর্শন পাওয়ার উপায় নেই। তিনি ছিলেন। তিনি নেই। তিনি আছেন। অনুভূতিতে তাঁকে আগলে রেখেছি বুকের গহীনে। সযতনে। জীবনভর পবিত্র সীরাত পড়ে, মানবতার মুক্তির বারতা হাদিসের কিতাব পড়ে পড়ে আর তাঁর এসব মর্মস্পর্শী না'ত আর গজল গেয়ে/ শুনে প্রান জুড়াতাম। সারা জীবনের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। তাঁর পাক রওযার পাশে দাড়িয়ে 'আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলে প্রান শীতল করার তীব্র অনুভূতি মনের কোনে শুধু জিইয়েই রাখতে হয়েছে। প্রিয় মদিনার সবুজ গম্বুজের নিচে প্রিয় দুই সহচরকে পাশে নিয়ে চির প্রশান্তির পরশে যিনি শুয়ে আছেন তাঁকে কাছে থেকে মনের কোনে জমে থাকা ব্যাথা জানাবো সে সুযোগ তো হয়ে উঠলো না।
অবশেষে আরশের মালিক, জমিনের মালিক, আমার জীবনের মালিক, পরম প্রভূ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা কবুল করেছেন। মঞ্জুর করেছেন। জীবনভর দেখে আসা স্বপ্নের বাস্তবায়ন তিনি একসেপ্ট করেছেন। তাঁর দয়ায়, তাঁর করুনা-মহিমায় ইনশাল্লাহ হজ্বের সফরে রওনা দেয়ার প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছি প্রায়। বাইতুল্লাহর মুসাফিরের দীর্ঘ দরাজ কাতারের ভেতরে নিজেকে কল্পনা করতে পেরে অদ্ভূত এক ভালোলাগা শরীর মনে শিহরন জাগিয়ে যায়। নাম লিখিয়েছি। কিন্তু এখনও তো জানি না। কাল কি হবে। আমি কি পারব যেতে? আমার তাকদীর কি আমাকে সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে সহায়ক হবে? এ জন্যই ভরসা কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের প্রতি। যদি তিনি দয়া করে তাঁর পবিত্র ঘর বাইতুল্লাহর যিয়ারত আর প্রিয়তম নবীর শহর মদিনার যিয়ারত কিসমতে আমাদের মত পাপীর জন্য রেখে থাকেন, তবেই কেবল এ মহাসৌভাগ্য আশা করতে পারি। এমনও তো হতে পারে, মক্কাতুল মোকাররমা আর মদিনাতুল মোনাওওরায় প্রবেশের পূর্বে আমার নিকট পৌঁছে গেল পরলোকে গমনের চিঠি। আয় আল্লাহ, আপনি হায়াত মউতের মালিক। পরিপূর্ন সুস্থতার সাথে আপনার পবিত্র ঘর যিয়ারত করে ফিরে আসার তাওফিক আপনি দান করুন। সে সময় পর্যন্ত আমার হায়াতকে প্রলম্বিত করুন। মকবুল মাবরুর হজ্ব সম্পন্ন করার তাওফিক দিন। আমাদের যেসব ভাই বোনগন যেতে পারেন নি, ইচ্ছুক, সকলকে গমনের ব্যবস্থা কুদরতিভাবে করে দিন। আমীন।
সকল ব্লগার ভাই বোনদের নিকট সফরের সুস্থতা, মাকবুল মাবরুর হজ্ব করার তাওফিক ইত্যাদির লক্ষ্যে মহান আল্লাহর দরবারে দোআর আবেদন রাখছি। দীর্ঘ দিন সামুতে একত্রে থেকেছি। আমি জানি, কথা-বার্তা আমার এমনিতেই একটু শক্ত, কাঠখোট্টা টাইপের। বিভিন্ন সময় কথা বলাতে কেউ হয়তো কষ্ট পেয়ে থাকতে পারেন। দয়া করে ক্ষমার চোখে দেখবেন আশা করি। সকলের উজ্জ্বল আগামী প্রত্যাশা করছি। ভাল থাকুন প্রত্যেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:২৫