somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

গল্প: স্মৃতিগুলো জোছনা হয়ে ঝরে, পর্ব-০১

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গভীর রাত। শুনশান নিরবতা। সবাই ঘুমে। বারান্দার লাইটটা জ্বালানো। ওটা জ্বালানোই থাকে। সামনের জানালা লাগোয়া আমার শোবার ঘর। জানালা দিয়ে হাত ঢুকালে আমার বিছানা বালিশ স্পর্শ করা যায়। হঠাৎ রুমের বাইরে কারও হাঁটার শব্দ শোনা যায়। পা ফেলার পষ্ট শব্দ। কোনো একজন হাঁটছে নিশ্চয়। ভৌতিক আওয়াজ মনে হচ্ছে। শুনতে কেমন যেনো ভয় ভয় লাগে। ভাবতে চেষ্টা করি, এত রাতে কে? কে হাটাহাটি করবে এখানে?

শক্ত মাটিতে ঘোড়ার হাঁটার মতো খটখট শব্দ। মানুষ কি এভাবে হাটে? সাধারণত দেখা যায় না। লোকটা এমনভাবে পা ফেলছে, যেনো বারান্দা মাপছে। আস্তে আস্তে হাটছে। মাঝে মাঝে থামছে, শুরু করছে আবার। লোকটার হাঁটা ভূত এবং মানুষ দু'টোর কোনো ক্যাটাগরিতেই পড়ে না। ভূতের হাটা অনেক দেখেছি। ভূতের হাঁটার ভেতরে ভৌতিক একটা ভাব থাকে। ভূত মানুষ সেজে মানুষের মত করে হাটার চেষ্টা করলেও তাদের হাটা মানুষের মত হয়ে ওঠে না।

আর মানুষেরটা আমার জানাই আছে। সেটা স্বাভাবিক।

আপদমস্তক কম্বলে আবৃত লোকটা হাটছে খুবই শান্তভাবে। দৌঁড়াচ্ছে না। হাঁপাচ্ছেও না। তার হাটা দেখে ভেতরে জেগে ওঠে একটা অচেনা ভয়। কে লোকটা? কেন এত রাতে এমন করে আমার জানালার পাশে হাটাহাটি করছেন? আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। গলা শুকিয়ে খটোমটো। ঢোক গিলতে পারছি না। অতি সাবধানে হাটুর উপর থেকে কাঁথা টেনে মাথা ঢেকে নিই। একটু নড়াচড়া করতেও ভয় হচ্ছে।

পাশ পরিবর্তন করতে ইচ্ছে হলেও খাটের কটকট শব্দের ভয়ে তা করিনি। এতক্ষণে ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুর মতো ঘাম জমে উঠেছে কপালে। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করে। নি:শ্বাস ঘন হয়ে আসছে যেন।

পিনপতন নিরবতার গভীর রাত। পাতা পড়ার শব্দ পরিমাপ করা যায়। লোকটার নি:শ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, লোকটা দরোজায় কান পেতে আছে। যেন ভেতরের কিছু শুনতে চায়। আমি খুব আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়ছি। অনুভব করলাম, কাঁথা ধরে কেউ টানছে। হৃৎপিন্ডে শুরু হয় হাতুড়ি পেটা। ডানহাত চেপে ধরি বুকে। কাঁপা থামে না। দুআ ইউনূস পড়তে থাকি মনে মনে। বিপদে আপদে পড়ার জন্য বাবার শিখিয়ে দেয়া দুআ।

পরিস্থিতি ক্রমে ভয়াকুল হচ্ছে। ভয়ংকর সব প্রশ্ন বরফের মতো বুকে জমাট বাঁধছে ক্রমশ:। লোকটা কি রুমে ঢুকে গেল? রুমে ঢুকল কিভাবে? আমি কি দরোজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিলাম? কেউ এলে তো অবশ্যই শব্দ পেতাম। একবার ভাবি, কাঁথার ফাঁক দিয়ে দরোজাটা দেখে নিই। ভয়বিহবলতার ভেতরেও অনায়াসে এটা করতে পারতাম। কিন্তু অদৃশ্য কোনো এক বাধা চোখ মেলে তাকাতে দিল না সেই মুহূর্তে। একসময় বন্ধ হয় কাঁথা টানাটানি।

এখন লোকটা স্থির দাঁড়িয়ে। কাচের জানালা দিয়ে লোকটার কালো ছায়া দেখা যায়। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল, সাদা কালো দাড়ি। আলোক দীপ্ত চেহারা। উজ্জ্বল চোখ দু'টো থেকে যেন ঠিকরে পড়ছিল জ্যোতির্ময় নীলাভ আলো।

লোকটা হাতের ইশারায় কি যেন বলতে চাইছে আমাকে। তার অদ্ভূত আচরণ আমাকে বিস্মিত করে তোলে। তাকাতে পারছি না আর। চোখ বন্ধ করে নিই। হঠাত মনে হলো, লোকটা তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। গ্রামের চির চেনা কাঁচা রাস্তায় ছুটে চলছি দ্রুতবেগে। প্রানপন দৌঁড়াচ্ছি। হাপিয়ে যাচ্ছি। পেছন পেছন দৌঁড়াচ্ছে লোকটা। আমাকে ধরার জন্য। আমার হাঁটা যেন এগোয় না। আমি যেন ভেঙ্গে চূড়ে পড়ে যাব। ধরা পড়ে যাব তার হাতে।

নাহ, আমি আর পারছি না। যতই সামনে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করি, পা যেনো পেছনের দিকে নিয়ে যায় অামাকে। একেবারে কাছে চলে এলো লোকটা। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে আমাকে।

একটা সময় বুঝতে পারি, আমি আর দৌঁড়াতে পারছি না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করি, ভয়বিহবলতার লেশ মাত্র নেই। সব কেটে গেছে। লোকটা কাছে আসে। আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় আমার মাথা। কত জনমের আপন মনে হয় তাকে। সাহস নিয়ে তাকাই লোকটার চেহারার দিকে।

চমকে উঠে অজান্তেই বলি- 'আব্বা! আপনি?'

কোনো কথা বললেন না তিনি। শরীর থেকে পুরনো সেই আতরের সুঘ্রান। আব্বা বেঁচে থাকতে এরকম তীব্র সুগন্ধযুক্ত আতর ব্যবহার করতেন। চেহারাটা অনেক বদলে গেছে। আলো ঝলমলে লাগছে তাকে। সেলাই ছাড়া সাদা কাপড় পরে এসেছেন। যেন ইহরামের কাপড় গায়ে জড়ানো। যেন হজ্ব কিংবা উমরাহর যাত্রী তিনি।

আব্বার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। ঠোঁট নড়ে ওঠে তাঁর। শব্দ করে কথা বলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু শব্দ হচ্ছে না কোনোভাবে। আমার কাছে এই মুহূর্তে আব্বাকে অতি স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়। আগের মত। অবিকল মৃত্যুর পূর্বে তিনি যেমন ছিলেন।

-'তালহা, এই তালহা, ওঠ্ বাবা, ফজরের আজান হয়ে গেছে।'

মা ডেকে দেন। প্রতি দিনই ডাকেন। ফজরের সময় হলে মা ঘুমে থাকেন না। যায়নামাজের পাটিতে তার সময় কাটে। মায়ের ডাক শুনে আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে ধরফর করে বসি। মা ঘাবড়ে যান আমার অবস্থা দেখে।

-'তালহা, এমন করে লাফিয়ে উঠলে কেন, বাবা? কী হয়েছে? স্বপ্নে কিছু দেখেছো? ভয় পেয়েছো?'

-'হুম। আব্বাকে দেখছিলাম।'

-'আব্বাকে দেখেছো? কী করতে দেখলে? বলোতো স্বপ্নটা।' কথাটা বলতে বলতে আমার পাশে এসে বসে পড়েন মা। আমি পুরো স্বপ্নটা বললাম মাকে।

মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। দীর্ঘ সংসার জীবনের হাজারো স্মৃতি হয়তো একে একে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে মায়ের। স্বপ্নটা মাকে বলে দিয়ে নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে এই মুহূর্তে। কারন, মায়ের চোখের পানি এমনিতেই ফুরোয় না। তাকে না জানি আরও কষ্ট চাপিয়ে দিলাম।

-'তোর আব্বা জান্নাতি মানুষ। তার মত মানুষ পৃথিবীতে কমই আছেন। অভাবের সংসারে তার জীবনে তাকে কখনো মুখ মলিন করতে দেখিনি। কষ্টে নীল হয়ে যেতেন কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতেন না। না খেয়ে না খেয়ে শরীরটাকে অচল করে দিয়েছেন। আমাদের সবাইকে খাইয়ে কত রাত যে না খেয়ে থেকেছেন তার ইয়ত্তা নেই।'

খুব অসহায় ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন মা। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। কিছু বলতে পারছি না। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। মাকে কী বলে শান্তনা দেব? মাকে বুঝাবো কী করে? অনেক কষ্টের ভেতরেও মাকে শুধু বললাম,

-'মা, আব্বার জন্য শুধু দুআ করো। তোমার দুআ আব্বাকে ঠিকই জান্নাতের বাসিন্দা হতে সাহায্য করবে।'

মা আরেকবার আঁচলে চোখ মুছে ফজরের নামাজের জন্য যায়নামাজে দাঁড়ালেন।

পেছনের কথা: গল্প কখনো লিখিনি। এই প্রথম প্রচেষ্টা। মাঝে মধ্যে লিখতে ইচ্ছে হলেও কখনো চেষ্টা করে দেখিনি। সাহস করে আজ একটু এগিয়ে এলাম। জানি না, আসলে গল্পের মত কিছু হয়ে উঠছে কি না। তবু চেষ্টায় তো আর দোষ নেই। ব্লগে অনেক অনেক ঋদ্ধ গল্পকার রয়েছেন, তাদের পরামর্শের জন্য আগাম শুভকামনা।

যেসব ব্লগার বন্ধুগন গল্প লিখতে প্রেরনা দিয়ে আসছেন অনেক দিন থেকে। তাদের সবাইকে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:৫৬
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×