আমাদের বঞ্চিত করছেন কেন? আমাদের জন্য আপনারা কিছু করেন। কেন আমাদের বঞ্চিত করছেন ভোট ও জন্মনিবন্ধন হতে। সন্ত্রাসী করে নয় আমরা সমাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত বিধায় মানুষের কাছ থেকে জোর করে নয় মানুষকে বুঝিয়ে দু’চার টাকা নিয়ে আমাদের জীবন যাপন করছি। আমাদের নিরাপত্তা ও বাসস্থান ব্যবস্থা আপনাদের কাছে আমাদের কাম্য। আমরা আর উপহাসের পাত্র হয়ে বাঁচতে চাই নাই। একজন সন্ত্রাসী মানুষ হত্যা ও লুটতরাজ করে তাদের যদি মানবাধিকার থাকে তাহলে আমাদের নেই কেন?
আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ। আলাদা কোন প্রাণী হতে আমরা জন্মগ্রহণ করিনি, আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই, চাকরি শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই, সমাজে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আপনারা আমাদেরকে দূরে ঠেলে দিবেন না। বিপদগামী করে তুলবেন না, জন্মগত ত্রুটির কারণে হিজড়া হিসেবে জন্ম গ্রহণ করাই কি আমাদের আজন্মের পাপ? এভাবেই করুণ এই আর্তিগুলো শোভা, লীমা, শাবনূর হিজড়ার মুখ হতে ভেসে আসছিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বেসরকারি সংগঠন নোঙ্গর সমাজ উন্নয়ন সংস্থা আয়োজিত প্রান্তিক হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং এইচ আইভি/এইডস প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মশালায় এই জনগোষ্ঠীর কথা এভাবে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের অত্যন্ত অবহেলিত, বঞ্চিত, প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর নাম ‘হিজড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের। ভাষায়-ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয় মূলত তারাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বুঝায় যা দৈহিক বা জেনিটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণীতে পড়ে না। বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় পনের হাজার, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অস্থায়ী ভাসমান। বসবাসকারী প্রান্তিক হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ২৫০-৩০০ জন।
যৌন প্রতিবন্ধী প্রান্তিক এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি। আগে সামাজিক বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ ছিল। বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে তা হারিয়ে গেছে। হিজড়াদের মধ্যে স্থান ভেদে বেশ কয়েকজন গুরু থাকে। বয়স ও মান ভেদে তাদেরকে নানগুরু, দাদগুরু, গুরুমা বলে সম্বোধন করা হয়। চট্টগ্রামে হিজড়াদের মধ্যে নেতৃস্থানে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে গুরু মধুমালা, সীতা, গীতা, নাসু, শাবনূর, লিমা, রীনা, রঙিলা, রত্মা, নার্গিস কবিতা, শোভা উল্লেখযোগ্য। হিজড়ারা সাধারণ মানুষের কটূক্তি থেকে রেহাই পেতে সবাই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। চট্টগ্রামে, ঝাউতলা, হালিশহর, নীমতলা, নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, পাহাড়তলী বন্দরটিলা এলাকায় তাদের বসবাস। হিজড়াদের সাথে আলাপে জানা যায় হিজড়াদের অধিকার রক্ষায় কোন বিশেষ আইনি ব্যবস্থা নেই। প্রতি নিয়তই তারা বৈষম্যের শিকার। প্রতিকুল পরিবেশ ও অনুকূল সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গির অভাবে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক এই হিজড়া জনগোষ্ঠী। সমাজের অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বাসস্থানের মতো অতি প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক অধিকার হতেও বঞ্চিত। চরম অস্বাস্থ্যকর গিঞ্জি এলাকায় গাদাগাদি করে তারা বসবাস করছে। ফলে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন তাদেরকে আরো অসুস্থ করে তুলছে। বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগ এবং ভয়াবহ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি এই জনগোষ্ঠীর। চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা, বিনোদন ও ভোটপ্রদানের অধিকার আদায়ে সহায়ক জনপ্রতিনিধিরাও তাদেরকে এড়িয়ে চলেন দায়িত্বহীনভাবে। হিজড়া গুরু মধুমালা এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপ কালে জানান হিজড়া হওয়ার কারণে তাদের কে কেউ চাকরিতে নেয় না, কেউ ঘরভাড়া দিতে আগ্রহী হয় না। ভোটার তালিকায় তারা কেউ ছেলে বা মেয়ে হিসেবে ভোটার হয়েছেন। চলমান জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমেও তাদের হিজড়া হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ নেই। চরম অভাব অনটনে তারা দিনাতিপাত করছে। দল বেধে তারা ছল্লা (টাকা) তুলতে যায় দোকানে, দোকানে। এক এলাকায় সপ্তাহে কেবল একবারই যায় ২ টাকা ৫ টাকা করে নেয়। প্রাপ্ত এ টাকার বেশির ভাগ ব্যয় হয় সাজগোজে। নিরাপত্তার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করেও জন্মত্রুটি নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ অনৈতিক আচরণ থেকে রক্ষা পান না। চট্টগ্রামে হিজড়াদের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করছে নোঙ্গর সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, নোঙ্গরের প্রধান নির্বাহী এ এস এম জামাল উদ্দিন রানা বলেন প্রান্তিক হিজড়া জনগোষ্ঠী সংখ্যায় খুবই কম। তাই তাদেরকে সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা সহজতর। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের দেশের ন্যায় বৈষম্যমূলক হিজড়া সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। অন্যান্য দেশের হিজড়ারা তাদের পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করেন। ফাইট ফর ওমেন রাইটস এর সভানেত্রী অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন হিজড়াদের অধিকার রক্ষায় এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি উল্লেখযোগ্য কোন আইনি সহায়তা কেন্দ্র। শারীরিক সমস্যার কারণে সবাই তাদেরকে উত্যক্ত করে হিংসাত্মক করে তুলছে।
হিজড়া হতে কখনো হিজড়া জন্মগ্রহণ করতে পারে না। আমাদের যে কারো পরিবারেই হিজড়া সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে। তাই বিষয়টিকে অবশ্যই সাধারণভাবে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। হিজড়া সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, নিরাপত্তা, ধর্মচর্চা, পেশা, আয়, দাম্পত্য জীবন, পোশাক পরিচ্ছেদ, সংস্কৃতি চর্চা, রাজনৈতিক অধিকার। সরকারি ভাতা, প্রেম-বিয়ে, পারিবারিক জীবন। উত্তরাধিকার প্রাপ্তিতে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনার অসংখ্য ইতিহাস। এছাড়া ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গ্যারান্টেট না পাওয়া, জীবন বীমা পাসপোর্ট এবং রাষ্ট্রীয়ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা এবং স্থায়ী ঠিকানা নিরুপণে তারা চরম ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। দেশে সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতো তাদের জন্য এখনো পর্যন্ত গড়ে উঠেনি আলাদা প্রতিষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে হিজড়াদের চাকরি অলিখিত এক নিয়মে প্রায় বন্ধ বললেই চলে। সরকারি খাসজমি বরাদ্দ করে হিজড়া ভিলেজ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা সম্ভব ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিজড়াদের নির্দিষ্ট হারে ভাতা দেওয়ার প্রচলন ছিল। এবং পরিবহন ভাড়া চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য সিনেমা হল ফ্রি ছিল। এখন এসব কেবলই গল্প। সরকারের বয়স্কভাতা কার্যক্রমে ও বয়স্ক হিজড়ারা বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার অভাবে পৈতৃক সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারীর দাবিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না।
পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আলাদা হয়ে পড়া অনেক হিজড়া বাঁচার তাগিদে যৌন পেশা, চোরাচালানও মাদক ব্যবসার মতো নিষিদ্ধ পেশা ও অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে ওসি ডবলমুরিং মোঃ ইলতুৎ মিশ বলেন এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কঠোর অবস্থানে আছে। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী কাউকেই কোন প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। তবে মানবিক বিবেচনায় সরকারি, বেসরকারিও স্বায়ীত্তশাষিত প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের জন্য কর্মমুখি প্রশিক্ষণ ও কর্মস্থান করে দিলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হতে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। হিজড়া সন্তান জন্মদানকারী পরিবারের সচেতনতা ও সহায়তা বিষয়ে প্রচারণার পাশাপাশি সরকারের বিশেষ সুবিধা পৃষ্ঠপোষকতা এবং সকল নাগরিকের মত প্রচলিত আইনি সুবিধা সমূহ হিজড়ারা যথাযথ ভাবে পাচ্ছে কিনা তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সুচারু নজরদারি এখন সময়ের দাবি।
সময়ের পরিক্রমায় হিজড়ারাও এক সময় বৃদ্ধ হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অপরের অনুকম্পায় অর্ধাহারে বা অনাহারে জীবনাবসান ঘটে। ঝাউতলা হিজড়া গল্লিতে গেলে দেখা যায় সেখানে মানবতা কতটা অসহায়। সারা দুনিয়া জুড়ে যখন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যদূর করে মানব অধিকারের আন্দোলন চলছে তখন এদেশের প্রান্তিক হিজড়া জনগোষ্ঠী চরম অবহেলিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর অন্ধকার জীবনে মানবাধিকারের উজ্জ্বল আরো কি কখনোই পৌঁছবে না? তাদের অবদমিত ইচ্ছাগুলো কি শুধুই তাদের বাসনার খেলাঘরে দোল খেতে থাকবে? তাহলে আসুন আমরা আরেকবার প্রমাণ করি এখনো মিথ্যে হয়ে যায়নি মহান সেই ধর্ম মানুষ মানুষের জন্য।
ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




