হোক আমাদের ছোট বিভাগ, কিন্তু মন তো আর ছোট নয়; হই আমরা ‘পড়ুয়া’ পাবলিক, কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া দিতে তো আর পিছপা নই। স্মরণকালের এক ভয়াবহ দুর্যোগের বিভীষিকার বিপরীতে অন্য সবার মতো আমাদের প্রিয় বিভাগও দাঁড়িয়েছিল সাহসিকতার সাথে। অদূর অতীতের সেই দুঃখজনক ঘটনা ও তার মোকাবেলার ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের এটি এক আনাড়ি উপস্থাপন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি বিভাগের একজন গর্বিত ছাত্র।
-----------------------------------------------------------------------
সেদিনের সকালটা প্রচণ্ড মেজাজি ছিল। গনগনে আভা না ছড়ালেও তার পূর্বাভাস ঠিকই জানান দিয়ে যাচ্ছিলো। পরিবেশটা আগাপাছতলা বিরক্তিকরই বলা যায়। অন্তত আমার কাছে লাগছিলো। কিন্তু এসব বিষয় এখন নেহায়েতই অগ্রাহ্য বিবেচ্য। রাস্তায় নেমেই রিক্সা ঠিক করলাম। আমার সাথে খুব সম্ভব নাদভী উঠেছিল। আমার যতদূর মনে হয়- প্রথমদিকে আমরা ছয়জন ছিলাম। পরে বিএমএ-এর সামনে তোপখানা রোডে আমাদের সাথে রাব্বি আর শাহিদুল যোগ দেয়। শুক্রবার থাকায় সেদিন বিএমএ বন্ধ ছিল। একটা মাত্র দোকান ছিল খোলা। জিজ্ঞাসা করলাম অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে কিনা। ওদের কাছে ছিল। এমনিতে ওরা নাকি এগুলো ৮০০ টাকার নিচে ছাড়ে না। কিন্তু আজ সাভার কথাটা উচ্চারণ করতেই সাথে সাথে দিয়ে দিল। কতোতে জানেন? ৬০০ টাকায় অর্থাৎ যে দামে ওরা জিনিসটা কিনে আনে। ওদের একজনের সাথে আমার কথোপকথনটা কি ছিল একটু দেখুন-
-ভাই, অক্সিজেন সিলিন্ডার হবে?
-হবে। একদাম ৮০০ টাকা। কয়টা লাগবে?
-লাগবে তো অনেকগুলা। সাভারে নিয়ে যাবো।
-ওহ! সাভারে নিয়ে যাবেন। তো আগে বলবেন না। তাহলে ৬০০ টাকা। কয়টা দিবো, বলেন?
একজন ফার্মাসিস্ট হোক সে জীবনরক্ষাকারী জিনিসের বিক্রেতা; কিন্তু সেও তো ব্যবসায়ী। তার মাথায়ও তো লাভের একটা সূক্ষ্ম চিন্তা খেলা করে। কিন্তু আজ...... আমি জানি না এই ৬০০ টাকায়ও সে কোন লাভ করেছিল কিনা। আমার জানারও দরকার নাই। কারণ, তার কথা বলার ধরন আর অভিব্যক্তিই বলে দেয় আজ সে হয়তো লাভের আশায় দোকান খুলে বসেনি। আজ সে তার অন্তরের অন্তস্তল থেকে মানবতা বিকবে।
ফিরে আসলাম সবার কাছে। কয়টা অক্সিজেন সিলিন্ডার নেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমাদের সাথে আরেকটা সংগঠনের কিছু সদস্য অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে এসেছিল। ওদের টীম লিডারকে আমি চিনি। কিশোর ভাই। “ওয়াইল্ড টীম” নামের একটা সংগঠন আছে ওনাদের। সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে মূলত ওনাদের কাজ-কারবার।
-কিশোর ভাইয়া, আপনারা কয়টা সিলিন্ডার নিচ্ছেন?
-এখনো ঠিক করতে পারিনি। দেখি কয়টা নেওয়া যায়।
-এতো ছোট ছোট সিলিন্ডার! আমি তো ভেবেছিলাম অনেক বড় হবে। হাসপাতালে যেরকম দেখি।
-এগুলো এমনই। একবার স্প্রে করলে সাড়ে তিন মিনিটে সব শেষ।
-এখান থেকে নিয়ে নিই, কি বলেন?
-হ্যাঁ, নিয়ে নাও। আমরাও নিচ্ছি।
ফিরে এসে ২০টা সিলিন্ডারের অর্ডার দিলাম। নাদভীর কাছে সব টাকা ছিল। ওখান থেকে বিশাল ১২ হাজার টাকা গুনে ফার্মাসিস্টকে দিলো। এখন যাবার পালা। তবে তার আগে জালি ব্যাগে দেওয়া সিলিন্ডারগুলোকে আমাদের কাঁধ ব্যাগে ঢুকাতে হবে। আমাদের সাথে তিনজন মনে হয় ব্যাগ এনেছিল। রিয়াদেরটা খুব সম্ভব ল্যাপটপের ব্যাগ। সবকটায় ধরে গেলো ২০টা সিলিন্ডার। আমি ওদের একজনের ব্যাগ আমার কাঁধে নিলাম। কাঁধে ব্যাগ না থাকলে আমার দম আটকায় আসে। নিজেকে কেমন যেন ন্যাংটো ন্যাংটো লাগে। যাইহোক, সবাই মিলে রাস্তা পার হলাম। এখন একটা বাস ধরতে হবে। বিশাল বলল, “ভাই, কলাবাগান চলেন। লাজ ফার্মাতে গিয়ে বাকি টাকা দিয়ে অন্যকিছু কিনে ফেলি।” সবাই তাতে সায় দিল। তো আর কি করা। চল্।
মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সবাই টপাটপ বাসে উঠে পড়লাম। আমরা উঠতে না উঠতেই বাস দিল এক ভোঁদৌড়। শুক্রবার ছিল বিধায় সাঁই সাঁই করে বাস টেনে নিয়ে গেলো। অভাবিত দ্রুততায় আমরা কলাবাগান পৌঁছে গেলাম। রাস্তা পার হয়ে সোজা লাজ ফার্মা। ওখানে গিয়ে শুনি অক্সিজেন সিলিন্ডার শেষ। আমরা যদি বিএমএ থেকে সিলিন্ডারগুলো না কিনতাম তাহলে এখন মাথার চুল ছিঁড়তে হতো বসে বসে। লাজ ফার্মাতে সাভারে লাগার মতো অনেক কিছুই ছিল না, শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষে ২০টা ৭ ইঞ্চি সার্জিক্যাল গ্লাভস কিনলাম। পাশের আরেকটা দোকান থেকে কিনলাম ১০০ পিস মাস্ক। এখানেও সেই একই কাহানি। ওরা জানতো না আমরা কি কাজে এতোগুলা মাস্ক নিচ্ছি। তাই প্রতি পিসের দাম চাইলো ১০ টাকা। কিন্তু যখনি সেই সাভারের কথা বললাম; সাথে সাথে প্রতি পিসের দাম নেমে আসলো পাঁচে! অর্থাৎ তাদের কেনা দামে। তারপরও কিছু টাকা বেঁচে ছিল। ভাবলাম আর কি কেনা যায়। বাসে আসার সময় স্বপ্নচারীর একজনের সাথে আমি আর বিশাল ফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম। তাদের সাথে এতো কথা বলার কারণ যাতে সেমসাইড (!) না হয়ে যায়। দেখা গেলো আমরা যা কিনছি ওরাও তাই নিয়ে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু মিনারেল ওয়াটার নিই। কিন্তু কোনটা নেবো। প্রথমে ভাবলাম ২ লিটারের কয়েকটা নিই। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম এতো বড় বোতল বিধ্বস্ত ভবনে বিভিন্ন জায়গায় করা ফুটো দিয়ে গলানো যাবে না। তারচেয়ে হাফ লিটারের কয়েকটা বোতল নিই। পার্শ্ববর্তী এক গলিতে ঢুকে এক দোকান থেকে হাফ লিটারের ৮৪টা বোতল কিনলাম। এখানেও বিনা লাভে কেনা দামে। এখানে অবশ্য আমাদের বলতে হয়নি সাভারের কথা। দোকানদার ছেলেটা আমাদের দোকানে ঢুকে এতোগুলো পানির বোতলের অর্ডার শুনেই বুঝে নিলো সবকিছু। আমরা অবশ্য ১০০টা বোতলের অর্ডার দিয়েছিলাম। ১৬টা বোতল কিনতে না পারায় ঐ টাকা দিয়ে ৫০ প্যাকেট দুই টাকার বিস্কুট কিনলাম। আমাদের একদল এইসব কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল। এদিকে আমি শাহিদুল আর রাব্বিকে নিয়ে সিএনজি ঠিক করতে চলে গেলাম। এবং পেয়েও গেলাম। এমনি সময়ে সিএনজি চালকদের আচরণে মেজাজ সপ্তমে ওঠার দশা হয়। অথচ আজ তারা কিনা বিনা বাক্যব্যয়ে সিএনজির গেট খুলে দিলো। তবে সিএনজি আমাদের গাবতলি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তারপর নাকি রাস্তা বন্ধ। যদি বন্ধ না থাকে তাহলে যতদূর যাওয়া যায় আমাদের পৌঁছে দেবে। দুইটা সিএনজিতে আমরা দুভাগ হয়ে উঠলাম। একটাতে বিশাল উঠলো নাদভী, রাব্বি আর নোমানকে নিয়ে। ওরা প্রায় সিংহভাগ জিনিস নিয়ে আগে চলে গেলো। আমি শাদলী, শাহিদুল আর রিয়াদকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। মূলত অক্সিজেন সিলিন্ডারের বেশীরভাগ আমাদের কাছে ছিল। তো যাই হোক, শুরু হল আবার ছুটে চলা।
যা হয় সচরাচর তাই হল। আমাদের দুই দল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। আমরা নিজেরা যেমন নিজেদের মধ্যে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম তেমনি আমাদের সাথে মাহবুব স্যার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন। কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই শ্যামলী পর্যন্ত আসলাম। শ্যামলী সিগন্যাল পার হয়েছি ঠিক তখনই দেখি আমাদের লেনের সব গাড়ী উল্টা ঘুরিয়ে পাশের রাস্তায় চলে যাচ্ছে। কাহিনী কি? আমাদের সিএনজি চালক মোটামুটি বয়স্ক, প্রৌঢ় ধরণের। উনি ব্যাপারটা দ্রুত ধরতে পারলেন আর ধরতে পেরেই দ্রুততার সাথে সিএনজিকে ঘোরালেন। আমি ড্রাইভারের সাথে সামনে বসেছিলাম। সিএনজি ঘোরানোর সময় দূরে দেখতে পেলাম একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে এদিকে আসছে। উদ্দেশ্য- গাড়ী ভাংচুর করা। কারা এরা? ড্রাইভার জানালেন এরা কল্যাণপুর আর গাবতলিতে যেসব গার্মেন্টস আছে সেখানকার বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিক। সিএনজি ড্রাইভার আমাদের যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেল সেখান থেকে একটা রাস্তা পাইকপাড়া, আনসার কলোনি হয়ে দারুস সালাম রোডে গিয়ে পড়েছে। একটু পরেই শুনি গাড়ীর গ্লাস ভাঙার শব্দ। তাকিয়ে দেখি বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা অনন্যোপায় গাড়িগুলোকে নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। আর তার হাহাকার ঝুরি ঝুরি কাঁচ ভেঙে প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা সেখানে বেশিক্ষণ থাকলাম না। একে তো আমাদের ‘অগ্রবর্তী’ দল থেকে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তার উপর এমন জায়গায় এসে ঠেকেছি যেখানে জন্মাবধি কখনো আসা হয়নি। আমার সাথের তিনটাও আসেনি আগে।
জায়গা নতুন, চারিদিক অচেনা, পথ অজানা; কিন্তু এহেন পরিস্থিতি সামাল দেবার অভিজ্ঞতা তো আর অজানা নয়। দ্রুত দুইটা রিক্সা ঠিক করলাম। একটাতে শাদলীকে নিয়ে আমি এবং অন্যটাতে শাহিদুল আর রিয়াদ। ঠিক করলাম আমার রিক্সা আগে আগে যাবে। কারণ এই রিক্সাওয়ালা এখানকার রাস্তাঘাট ভালমত চেনে। এককথায় চাল্লু মাল! সে আমাদের ক্যামনে ক্যামনে জানি এই রাস্তা সেই রাস্তা ঘুরিয়ে শেষতক আমাদের নিরুপায় গন্তব্য মিরপুর-১ এ নিয়ে আসলো। ভাড়া দেওয়ার সময় বলল, “আইজকা খুশিমত একটা ভাড়া দিয়া দ্যান।” এবার আর অবাক হলাম না। কারণ ততক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশ আজ মানবতার অভিব্যক্তিতে উন্মুখ হয়ে আছে। ভাড়া মিটিয়ে এবার নতুন লক্ষ্যে যাত্রা। মাজার রোড ধরে গাবতলি। অনেকক্ষণ চেষ্টাচরিত করেও কোন সিএনজি বা ভ্যানের সন্ধান পেলাম না। হঠাৎ দেখি উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে আরেকদল বিক্ষুব্ধ শ্রমিক লাঠিসোটা নিয়ে এদিকে আসছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম। জুনিয়রদের কাছে কাছে রেখে বিকল্প পন্থা হিসেবে আবার রিক্সা ঠিক করার চেষ্টা করছি। শেষমেশ পেয়ে গেলাম। বাকি পথটুকু নির্বিঘ্নই কাটল। পথে ফোন করলাম কয়েকজনকে। তবে সবার আগে বিশালদেরকে। ওরা কেমন আছে, কোথায় আছে- এটা জানা সবচেয়ে জরুরী। জানলাম ওরা ঐ সিএনজিতে করেই নিরাপদে গাবতলিতে পৌঁছে গেছে। ওদের সাথে থাকা জিনিসগুলো দেখে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা নাকি উল্টো যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। এখন বাস টার্মিনালে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। নিশ্চিন্ত হয়ে এবার ফোন দিলাম বিএনসিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর)-র আর্মি উইংয়ের ক্যাডেট আন্ডার অফিসারকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্মি সেকশন থেকে কেউ আজ যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। যাচ্ছে না শুনে খারাপই লাগলো। যাইহোক, আজ আমি না হয় আমার ডিপার্টমেন্টের ‘ব্যানারেই’ গেলাম। বরং এটাই আমার জন্যে বেশী গৌরবের। একসময় গাবতলি পৌঁছে গেলাম। বিভক্ত দুই দল আবার একত্রিত হল। এবার একসাথে যাবার পালা।
অন্য সময়ে যেসব বাস সাভার বা নবীনগর যায় তারা আজ হেমায়েতপুর পর্যন্ত যাবে। কারণ তারপরে রাস্তা বন্ধ। বাসে উঠলাম সবকিছু নিয়ে। ঝামেলা বাধল পানির বোতল তুলতে গিয়ে। যে ইয়া বড় ব্যাগে সব বোতল ভরছিলাম সেটা গেলো ছিঁড়ে। কোনোরকমে সেটাকে বেধেসেধে ইঞ্জিনের উপর রাখলাম, তারপর ব্যাগে পা দুইটা ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সবাই আজ মানবতায় উন্মুখ- আমার এই ধারণাটা বাসে উঠে ভাঙলো। বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারকে পায়ে ধরা কেবল বাকি ছিল। কিন্তু বদমাইশগুলা বাস না ভরে গাড়ী কিছুতেই ছাড়বে না। এতো এতো জিনিস থাকায় চুপচাপ অনুরোধই করে গেলাম কেবল। অন্য সময় হলে কানের উপর বা হাতের যে স্পেশাল চপটা মারতাম এটা আর এখন মারলাম না। সব জায়গায় সব খাটে না, খাটানো যায়ও না। হঠাৎ দেখলাম ট্রাকে করে কমলা ইউনিফর্মের কিছু রেসকিউয়ারকে রানা প্লাজা অভিমুখে যেতে। অকস্মাৎ দেখাতে ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলাম না। ওদেরকে প্রথমে আমি দেখিনি। রিয়াদ আর নাদভী দেখেছে। যাইহোক, পুনর্বার ড্রাইভার ফাজিলটাকে অনুরোধ করলাম। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী আর ফাজিলে কি শোনে অনুরোধের বানী। একসময় ফাজিলগুলা বাসটা ছাড়ল। সবেমাত্র আমিন বাজার ব্রিজ পার হবো বা হয়ে গেছি (তেমন একটা মনে নেই এখন) এমন সময় দেখলাম একটা একটনী পিকআপে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি নিয়ে কয়েকজন যাচ্ছেন সাভারপানে। সশব্দে ডাকলাম ওদের। ওরা শুনল কিন্তু থামাল না। আরো জোরে ডাকলাম। ডেকেই চললাম আমরা। একসময় ওরা থামাল। আমি আর বিশাল নেমে ওদের সাথে কথা বললাম। ওরা আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হল। তবে সবাইকে নেওয়া সম্ভব না। ঠিক করলাম যা আছে সব নিয়ে আমি, বিশাল, শাদলী আর নাদভী এই পিকআপে করে বখতিয়ার খিলজির মতো আগে আগে চলে যাবো। অন্যরা বাসে করে আসবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ শুরু করলাম। সব নামাতে লাগলাম। বাসের সবাই আমাদের সাহায্য করলো। বিশাল সামনে বসলো। আমি পেছনের সিটে। আর একেবারে পেছনে খোলা হুডে নাদভী এবং শাদলী। আবার আমাদের দলে ভাগ, আবার দৌড়।
যাদের সাথে এখন যাচ্ছি ওনারা মিরপুর থেকে এসেছেন। ওনাদের একজন আমার হাতে একটা এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে বললেন, “এটা জানালার বাইরে ধরে রাখুন।” এটা দেখলে রাস্তার সবাই আমাদের চিনবে, আমরা কি কাজে যাচ্ছি তা জানবে। বিশালের হাতে একদলা কাফনের সাদা কাপড়। বর্তমানে তা শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেখে ব্যস্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সরে সরে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। তুমুল গতিতে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ী। হেমায়েতপুর আসার পর একটু গতি কমলো; কারণ এখান থেকে সব গাড়ীর যাতায়াত বন্ধ। আমাদের পিকআপের মতো যেসব গাড়ী রানা প্লাজা অভিমুখী কেবল তারাই সামনে এগোতে পারছে। সব বাঁধা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এক ভৌতিক মৃত্যুপুরীর দিকে। আস্তে আস্তে মানুষের ঘনত্ব বাড়তে লাগলো। একসময় গোচরে এলো বিধ্বস্ত রানা প্লাজা। আমরা একেবারে রানা প্লাজার সামনে এসে থামলাম এবং নামলাম। দ্রুত গাড়ী থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে দৌড়ে দৌড়ে অস্থায়ী ক্যাম্পে জমা করলাম। অক্সিজেন সিলিন্ডার আমাদের ব্যাগেই রাখলাম। জায়গামত ওগুলোকে ছাড়লাম। পুরোটা পথই আমাদের এটা নাও আর দাও দৌড় করতে করতে গিয়েছে। সেগুলো হয়তো এই চূড়ান্ত ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুতিমূলক ছিল। কারণ এই মৃত্যুপুরী থেকেই যে শুরু আমাদের আসল কাজ- টেক এন্ড রান।
চলবে......
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ মৃত্যুঞ্জয় মানবতা (প্রথম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




